আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
৩০ হাজার কোটি টাকাটা গরিব ভারতের অর্থনীতির সাপেক্ষে নিঃসন্দেহে বিরাট। কত লোককে অক্সিজেন দেওয়া যেত, কত মানুষকে ভ্যাকসিন দিয়ে মারণ রোগ থেকে বাঁচানো যেত। কিন্তু তা না করে শুধু ‘দিদি ও দিদি’ গালাগালি নিক্ষেপে ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রী। তা এত বিপুল অর্থ ব্যয় করে, এত তেল পুড়িয়ে মাত্র ৭৭টা আসনে জয় চোখ কপালে তোলার মতোই ঘটনা বইকি। তাহলে জেতা আসন পিছু খরচ দাঁড়াল প্রায় ৪০০ কোটি টাকার মতো। কত কিছুই না করা যেত ওই টাকায়। ভারতের মতো দেশে অঙ্কটা ভাবা যায়! আরও বিস্ময় লাগে যখন জানতে পারি, এই মুহূর্তে জিএসটি বাবদ আমাদের রাজ্যের বকেয়া ৪০০ কোটি টাকার অনেক বেশি। তার জন্য রাজ্য সরকার ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কম দরবার করেননি। কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি। কানাকড়ি কিছু মিললেও অধিকাংশটাই এখনও বকেয়া। কত পরিযায়ী শ্রমিক গতবছর শুধু একটু জল আর খাদ্যের অভাবে রাস্তায় মাথা কুটেছেন। কত মানুষ কাজ হারিয়ে ঘরের অন্ধকার কোণে হারিয়ে গিয়েছেন, তাও তো শাসকের অজানা নয়। তবু সামান্য একটা রাজ্য দখলে কেন্দ্রের এই আগ্রাসনের কারণটা কী?
নিঃসন্দেহে বাংলায় দলের এই লজ্জাজনক পরিণাম নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। তার চেয়েও বড় কথা—এত সভা, এত রোড শো, সব কাজ লাটে তুলে গোটা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার কুশীলবদের এক-একটা হেলিকপ্টার নিয়ে টানা পড়ে থাকা সব জলে গেল। প্রশ্ন উঠছে, এই জলের মতো হাজার হাজার কোটি টাকার জোগান দিল কে? একটা হিসেব বলছে, ২৫ হাজার কোটি গলে গিয়েছে। আবার কোনও কোনও পণ্ডিত বলছেন, অঙ্কটা তারও বেশি। ৩০ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে। স্বভাবতই বিজেপি শাসিত ভিন রাজ্য থেকে কোটি কোটি টাকার স্রোত বয়েছে এরাজ্যকে কেনার জন্য। দখলদারির নেশায়। বস্তা ভর্তি টাকার বান্ডিল কখনও এসেছে দিল্লি আর উত্তরপ্রদেশে থেকে। কখনও আবার মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় থেকেও। কখনও আকাশপথে, কখনও সড়কে।
বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর নির্বাচন কমিশনের ডজন ডজন পর্যবেক্ষকরা তার হদিশ পাননি। পাওয়ার কথাও নয়। একের একের পর এক চার্টার্ড বিমানকে জায়গা দিতে একসময় হিমশিম খেতে হয়েছে কলকাতা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে। সবমিলিয়ে প্রায় দু’শো বিমান ও কপ্টারকে কাজে লাগানো হয়েছে। আগে কখনও বাংলার ভোট ঘিরে এত সংখ্যক হাওয়াই জাহাজ, প্রাইভেট জেটের ভিড় আর টাকার স্রোত দেখা যায়নি। যেমন দেখা যায়নি বিশ্বকাপের মতো আর্ন্তজাতিক মানের মিডিয়া সেন্টার খুলে বসতে কোনও রাজনৈতিক দলকে। একই দিনে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে শহরের একাধিক পাঁচতারা হোটেলে সম্মেলন, সেমিনার চলেছে চুটিয়ে। এক একটা বড় সভায় খরচ হয়েছে কয়েক কোটি টাকারও বেশি। বেশকিছু সভায় আবার তার আট দশগুণও খরচ হয়েছে।
৭ মার্চ মোদির ব্রিগেডের সভায় উড়েছে কোটি কোটি টাকা। ছোট-বড় নেতাদের জন্যও যেখানে সেখানে হেলিপ্যাড তৈরি, মঞ্চ ঘিরে রোড শোতেও খরচ তার প্রায় কাছাকাছি। তারপর নেতা কিনতে, মস্তান ভাড়া করতে দেদার টাকা উড়েছে। শহর ও শহরতলির, বিমানবন্দর লাগোয়া সব সাততারা, পাঁচতারা, মাঝারি মাপের হোটেল মাসের পর মাস গেরুয়া নেতা ও তাদের বহিরাগত সাঙ্গোপাঙ্গদের জন্য বুকড। এর ওপর বস্তা বস্তা ফুল, আধুনিক স্টেজ ও লাগোয়া দামি ছাউনি, সভাপিছু কয়েকশো মাইক-সবমিলিয়ে এলাহি কাণ্ড! প্রশ্ন উঠবেই সাতমণ তেল পুড়িয়ে মোদি অমিত শাহের প্রাপ্তিটা কী? শোনা যায়, এই বিপর্যয়ের আগাম আঁচ পেয়ে শেষ দিকে কলকাতার এক হোটেলে একরাতে রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত একাধিক নেতাকে ব্যাপক ভর্ৎসনাও করেছিলেন অমিত শাহ। তুলেছিলেন পাঠানো টাকার ব্যাপক নয়ছয়ের অভিযোগও। কারণ, সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স ভোটের ফল বেরনোর আগেই সতর্ক করেছিল আশির আগেই আটকে যাবে দল। হলও তাই, যতই তেল আর টাকা পোড়াও রাধা কিন্তু নাচেনি। উল্টে কিছু বহিরাগত নেতা টাকাপয়সা নিয়ে ব্যাপক নয়ছয় করেছে। অনেক প্রার্থীও মোটা টাকা নিয়ে চেপে গিয়েছে। সাহস থাকলে দল তার তদন্ত করুক।
প্রায় দেড়শো বিতর্কিত প্রার্থীকে টিকিট দেওয়া নিয়েও দলে অসন্তোষ শুরু হয়েছে, ফল বেরনোর পরই। প্রশ্ন উঠেছে, কারা কীসের বিনিময়ে ওদের প্রার্থী করল? ফুল ফুটুক না ফুটুক টাকার এই ঝড় হার মানিয়েছে উম-পুনকেও!
কিন্তু মণ মণ তেল পুড়িয়েও কেন রাধা একটুও নাচল না? উত্তরটা সহজ, নাচার আদৌ কথা ছিল কি? সংগঠন তৈরি না করে শুধু সকাল সন্ধে জিতে যাওয়ার মিথ্যে অভিনয় আর আস্ফালন করলেই যে ভোটে জেতা যায় না, তা আবার প্রমাণ হল। সঙ্ঘ পরিবারের বারবার মিথ্যে বলে সেটাকেই সত্যি প্রমাণিত করার কৌশল বাংলায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, রাজ্যটা ত্রিপুরা নয়। এর সবচেয়ে বড় কারণ গুটখা খাওয়া বহিরাগতদের বাংলার মানুষ পুরোপুরি বর্জন করেছে। ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছে ধান্দাবাজ দলবদলু মীরজাফরদেরও। বাংলার আবেগ ও সম্মান আর জননেত্রীর মর্যাদা যে একটা সুতোয় গাঁথা, তা ধরতে পারেননি দিলীপ ঘোষরা। সেই সঙ্গে হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছেন বিশ্বাসযোগ্য কোনও বিকল্প মুখ। তাই তারা চারদশকের জননেত্রীকে যত অশ্লীল ভাষায় ‘বারমুডা’ পরার নিদান দিয়েছেন, ততই এরাজ্যের ভোটার, বিশেষত বাংলার মহিলারা দূরে সরে গিয়েছেন। ভোট কেন্দ্রে ঘাসফুলের সমর্থনে ঢল নেমেছে বাংলার নারী শক্তির। ঢেলে ভোট দিয়েছেন মা বোনেরা। একদল কপালে লাল টিকা লাগানো আগ্রাসী দেহাতির গলায় ক্রমাগত ঘরের মেয়ের অসম্মান আর ‘জয় শ্রীরাম’ নিক্ষেপ বাংলার গড় ভোটার সহ্য করতে পারেননি। ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন মোদির ডবল ইঞ্জিনের তত্ত্ব। দ্বিতীয়ত, মেরুকরণের তাস খেলতে গিয়ে তার ফাঁদেই জব্দ হয়েছে গেরুয়া পার্টি। পাহাড় থেকে সমুদ্র এই নির্বাচনে মুসলিম ভোট একজোট হয়ে তৃণমূলের বাক্সে পড়েছে। অথচ হিন্দু ভোটের মেরুকরণে করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি। মুসলিম ও হিন্দু দু’তরফেই বাংলায় প্রত্যাখাত হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। উল্টে নাক উঁচু বাম প্রগতিশীল সমাজও বিজেপিকে ঠেকাতে খোলা মনে মমতার নেতৃত্বে আস্থা রেখেছেন। মেরুকরণের বিষ ব্যুমেরাং হয়ে বিধ্বস্ত করেছে গেরুয়া দলকেই। প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, মিথ্যার দ্বারা মহৎ কাজ হয় না।
অথচ, এতবড় জয়ের পরও বাংলার জননেত্রী কতটা সংযত। কোনওরকম মিছিল বিজয় উৎসব করতেও তিনি নিষেধ করেছেন দলকে। ভোটযুদ্ধ শেষ করেই মন দিয়েছেন করোনা মোকাবিলায়। আর গেরুয়া নেতারা এখনও ফেক হামলার ছবি দেখিয়ে হিন্দু-মুসলমান করে যাচ্ছে। বিজেপি নেতাদের একটা কথাই বলব, বাংলার মানুষ আপনাদের সবক শিখিয়েছে, সতর্ক হয়ে যান। দিল্লির চারদিক ঘিরে হিন্দিবলয়ের চাষিরা সেই নভেম্বর থেকে বসে আছেন। তাই বিক্ষোভের আঁচ কিন্তু ধিকিধিকি জ্বলছেই। তার উপর করোনায় স্বজন হারানো মানুষের আর্তনাদ কিন্তু আপনাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। একটু অক্সিজেন নেই, তাহলে লোকসভায় ৩০০ আসন একা জেতার মানে কী? উত্তরপ্রদেশে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সাম্প্রতিকতম ফল প্রমাণ করছে নরেন্দ্র মোদির পায়ের তলার মাটি কিন্তু এবার আলগা হচ্ছে। রাজস্থানের স্থানীয় নির্বাচনেও ভরাডুবির খবর এসেছে। রাজ্যে রাজ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ করে আগামী দিনে দেশের সব স্তরের বিজেপি বিরোধী শক্তিকে সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে। বিরোধীরা এককাট্টা হলে আগামী চব্বিশের সাধারণ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির প্রত্যাবর্তনও কষ্টকল্পিত হয়েই থেকে যাবে। শুধু অযোধ্যার মন্দির দেখিয়ে শেষরক্ষা হবে না। সেইদিক দিয়ে বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক জয় দিয়েই মোদি-অমিত শাহের জমানারও শেষের শুরু। এখন শুধু মমতাকে অনুসরণ করে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী বিরোধী শক্তির সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার পালা। এবং, সেই পথ দেখাবে বাংলাই।