আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
দ্ব্যর্থহীন ভাষায় হুঁশিয়ারি। স্বৈরাচারী কালিমালিপ্ত শাসককে। হুঁশিয়ারি দিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি রাজনীতি সচেতক এবং আপসহীন। তাই কুণ্ঠাবোধ করলেন না দ্ব্যর্থহীন ভাষা ব্যবহারে। এমনটাই দস্তুর। স্বৈরাচারী শাসককে হুঁশিয়ারি দিতে। শুধুমাত্র বাক্ স্বাধীনতার প্রয়োগ। তুলে নেননি আইন ও শাসন-কে নিজের হাতে। ভাষা মার্জিত হলেও তার তীব্রতা নিয়ে কোনও কথা হবে না । সমানভাবে গর্জে উঠেছেন তথাকথিত নেতার বিরুদ্ধে। যিনি কেবল মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন। আদতে ঠক্। বাক্ চাতুর্যে। দেহের ভাষায়। চলনে-বলনে। আচারে-আচরণে। এককথায় বহিরঙ্গে (বহিঃ অঙ্গে) আকৃষ্ট করেন দেশের মানুষ-কে। ‘‘মধু তিষ্ঠতি জিহ্বাগ্রে, হৃদয়ে তু হলাহলম্।’’—এর একেবারে বাস্তবরূপ।
সন্দীপ এমনই এক তথাকথিত নেতা। ‘ঘরে-বাইরে’-এর। রবীন্দ্রনাথের একটি কালজয়ী রাজনৈতিক উপন্যাস। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে যাঁর জুড়ি মেলা ভার। যে প্রতিশ্রুতি তিনি কোনওদিনই পালন করেন না। জনসমাবেশে দেশের জন্য স্বার্থ ত্যাগ করতে বলেন সমবেত জনসাধারণকে। কিন্তু নিজে নিজের শরীরের বর্জ্য পদার্থ ছাড়া অন্য কিছু ত্যাগ করেন না। আপাদমস্তক সৌখিন এক মানুষ। বিলাতি জিনিসই ব্যবহার করেন। কিন্তু দেশের মানুষকে বলেন বিলাতি জিনিস বর্জন করতে। আবার চরিত্রের দোষও যাঁর পুরোদস্তুর। এহেন অকৃতদার জড়িয়ে পড়লেন অবৈধ সম্পর্কে। আদর্শবাদী বন্ধু নিখিলেশের স্ত্রী পর্দানসীন বিমলার সঙ্গে। তারপর ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করলেন। জনরোষ তাঁর ওপর উগরে পড়ার আগে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেন। পরে তাঁর বন্ধু নিখিলেশ, বন্ধুর স্ত্রী বিমলা, তাঁর অনুগামী এবং দেশবাসী তাঁর স্বরূপ বুঝতে পারে। ততদিনে সংশ্লিষ্ট সকলের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। এমন একটি চরিত্র হাজির করে রবীন্দ্রনাথ আমাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে দিলেন। সতর্ক করলেন আমাদের যাতে আমরা কোনওভাবেই এঁদের কথার জালে জড়িয়ে না পড়ি। এর থেকে বড় প্রতিবাদ আর কী হতে পারে!
অথচ রবীন্দ্রনাথ তো হলেন একজন কবি-ঔপন্যাসিক-নাট্যকার-গীতিকার-সুরকার-ছোট গল্পকার আরও কত কী তার ইয়ত্তা করা যাবে না। তিনি তো এহেন সত্তাগুলি নিয়ে পাহাড় পর্বতের গুহায় চলে যাননি। অথবা অরণ্যের গভীরে কুটির নির্মাণ করে জগৎ বিচ্ছিন্ন, মানব বিচ্ছিন্ন, সমাজ বিচ্ছিন্ন সৃষ্টিমগ্ন সাধনার আসন বিছিয়ে বসেননি। সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে একজন রাজনীতি সচেতকের ভূমিকাও পালন করলেন পুরোদস্তুর। একথা এখন এখানেই থাক। এখন তাঁর রাজনীতি সচেতনতার প্রেক্ষাপটটি দেখে নেওয়া যাক।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে স্বামী বিবেকানন্দকে বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথই অন্যতম মহামানব যিনি ভাবীকালের পৃথিবীকে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে চিনতে পেরেছিলেন। এটা অনস্বীকার্য যে বিবাদ বিদীর্ণ দেশ রাজনৈতিক মতাদর্শের বৈষম্য, অর্থনৈতিক স্তরবিন্যাসের বৈচিত্র্য, প্রগতির বিভিন্ন মানকে স্বীকার করে নিয়েও সামগ্রিক ক্রমোন্নতির পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। বৈষম্যের মধ্যে সাম্য। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের অন্তর্লীন প্রয়াস মানব সভ্যতাকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে। সভ্যতার বিচিত্র ধারার মধ্যে এই অন্তঃসলিলা মূল স্রোতটির কলধ্বনি শুনতে পান একালের ক্রান্তদর্শী ঋষি রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ দেশের সার্বিক সমস্যার প্রাণস্পন্দনটি অনুভব করলেন। তাঁর অনুভবে একক মানব চরিত্র পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদের ক্ষুদ্রতম প্রকাশ। যখন পরিবারের সকল সদস্যই চরিত্রবান হন, তখনই একটি আদর্শ স্থানীয় চরিত্র তৈরি হয়।
আজকাল ‘Good governance’ কথাটি খুবই প্রচলিত। যার অর্থ হল সুশাসন। শাসনের দুটি দিক। একটি তাত্ত্বিক দিক। অপরদিকে তত্ত্বের রূপদানের আজ্ঞাবাহী কয়েকজন রূপকার (Executor)। সমাজে কল্যাণমুখী তত্ত্বের অভাব নেই। আসল অভাব লোককল্যাণে নিবেদিত প্রাণের।
এই প্রসঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের সামনে তুলে ধরলেন আদর্শ নাগরিক এবং আদর্শ শাসক ঠিক কেমন হওয়া উচিত। যাতে উভয়েই আদর্শ আচরণবিধিকে লঙ্ঘন করবেন না। রাজনীতি সচেতক রবীন্দ্রনাথ তা আমাদের জানালেন তাঁর গানের মাধ্যমে। এখন আমরা সেটাই শুনব।
‘‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে—/ নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?/ আমরা যা খুশি তাই করি, তবু তাঁর খুশিতেই চরি।/ আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে—/ নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?/ রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান,/ মোদের খাটো করে রাখে নি কেউ কোনো অসত্যে—/নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?/আমরা চলব আপন মতে, শেষে মিলব তাঁরি পথে,/ মোরা মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে—/ নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?