আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সমাগমে আনন্দ বৃদ্ধি। চারুকলা শিল্পে উপার্জনের শুভ সূচনা। উচ্চশিক্ষায় সুযোগ। কর্মক্ষেত্রে অযথা হয়রানি। ... বিশদ
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ মানেই একটা তীব্র আবেগ, যার মূলে থাকে সাম্প্রদায়িক চেতনা। এই জাতীয়তাবাদ নিজের গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়কেই শুধু গৌরবান্বিত করার চেষ্টা করে, সেই স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্য গোষ্ঠী, জাতি, দেশ বা সম্প্রদায়ের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণার বীজ বোনে। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের লাগাতার অসহিষ্ণুতার অভিযান এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী আবেগের আড়ালে লুকনো বিদ্বেষকেই বাংলা ও বাঙালি প্রত্যাখ্যান করেছে এই ভোটে। একক জেদ আর সাহসে সেই ভয়ঙ্কর অভিযানকে থামিয়ে দেশজুড়ে তুমুল বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যা গোটা দেশের কাছে এক মহান শিক্ষা। আঞ্চলিক দলগুলোও এর মধ্যে নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে।
কে না জানে, বিজেপি একটা ক্যাডারভিত্তিক দল। তার ক্যাডারদের মুখ্য অস্ত্র হিন্দুত্ববাদ। ৮০ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বীর দেশে এরকম এক শক্তিশালী বিশাল আয়তনের ক্যাডারভিত্তিক অভিযানকে মোকাবিলা সহজ কথা নয়। মমতা সেখানেই বিকল্প রাস্তা দেখিয়েছেন। তিনি সরাসরি সংঘাতে হাজির হয়েছেন মূলত ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা নিয়ে। যাকে বলে, বাঙালি জাতিসত্তার রাজনৈতিক তাস! অমিত শাহরা যে অভিযানকে ধর্মীয় মেরুকরণের যুদ্ধে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন, মমতা তাকে ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদ দিয়ে সামলেছেন। মমতা বারবার বলেছেন, মোদি-অমিত শাহরা অনেকটা নাদির শাহের মতো আক্রমণ করতে এসেছে এবং বঙ্গসংস্কৃতিকে তছনছ করে দিতে চাইছে। এখানেই জোর ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি।
বাঙালি সম্পর্কে হোমওয়ার্ক বা ব্যাকগ্রাউন্ড রিসার্চ-এর দুর্বলতাই বিজেপির বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দিয়েছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ১৮ আসনে জিতে এবং ১২২টি বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে থেকে যে পদ্মফুল ঘাসফুলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিল বলে মনে হচ্ছিল, তাদেরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাড় ধরে পাঠিয়ে দিয়েছেন পরাজিতদের ডেরায়। এই বঙ্গে যে আজও মীরজাফর বা জগৎশেঠদের মতো ষড়যন্ত্রকারীদের ঘৃণা করা হয়, সেটা বিজেপি ভাবতেই পারেনি। আসলে মোদি-অমিত শাহরা পশ্চিমবাংলার মাটি চিনতেই পারেনি। তাই সারাক্ষণ ন্যক্কারজনক সাম্প্রদায়িক উসকানির মধ্যেই আটকে ছিল গেরুয়া শিবির। বিজেপি খুব খোলাখুলি এই তাসটি খেলেছিল ৭০ শতাংশ হিন্দু ভোট এককাট্টা করতে। পারেনি। রাম দিয়ে এখানে যাত্রাপালা হতে পারে, ভোট পাওয়া মুশকিল। বাংলার ভোট সামনে রেখে রবীন্দ্রনাথের দাড়ির নকল বানানো যায়, কিন্তু তাতে বাঙালির মনে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করা সম্ভব নয়। ধর্মীয় জিগির তুলে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটানোও এখানে বড্ড কঠিন। ফলে মরিয়া প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাংলার ভোটারদের সামগ্রিক ভাবে ধর্মীয় মেরুকরণের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারেনি বিজেপি। যদি তাই হতো, তাহলে ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ‘হিন্দুত্ব’-এর জিগির তোলা দলটি এইভাবে খড়কুটোর মতো উড়ে যেত না। তাই আজ এটা দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে, বাংলার জনগণ ভোটের মেশিনে বোতাম টেপার সময় হিন্দু-মুসলিম বিচার করেনি। ‘এক দেশ-এক জাতি’র যে স্লোগানে বহু সংস্কৃতির ভারতকে আরএসএস-বিজেপি এতদিন বাঁধতে চেয়েছে, সেই জবরদস্তির বিকল্প দেখিয়েছেন মমতা। প্রতিটি প্রান্তিক রাজ্যের সাংস্কৃতিক নিজস্বতার শক্তিই ফুটে উঠেছে মমতার ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে। ঠিক এখানেই নয়া সম্ভাবনা দেখা শুরু করেছে ওড়িশা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যের আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদীরা। তারা এখন দ্রুত আঞ্চলিক ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ইস্যুগুলোতে সংঘবদ্ধ হওয়াকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বাড়তি গুরুত্ব দেবে, যা দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক ছক পাল্টে দিতে পারে।
ভারতের রাজনীতিতে সদ্য যুক্ত হওয়া এই ‘মমতা মডেল’ একইসঙ্গে বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়ের জন্য সাংগঠনিক ও আদর্শগত সঙ্কটও তৈরি করবে। ‘মমতা মডেল’ নিয়ে বিজেপির সঙ্কটের জায়গা দু’টি। হিন্দুত্ববাদ হিন্দুসমাজকে ভোটবাক্সে নিয়ে আসার একমাত্র অস্ত্র হতে পারে না, একইসঙ্গে হিন্দুরা বিজেপির পুরোনো রাজনৈতিক পণ্যটিকে আর গ্রহণ করছে না—মমতা সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন। বিজেপি নেতারা ভাবতেই পারেনি, মসজিদ-মন্দিরের রাজনীতি এবং মুসলিম-খ্রিস্টান বিদ্বেষ প্রতিপক্ষের নতুন কোনও কৌশলের সামনে যে ভোঁতা হয়ে যেতে পারে। বিজেপি আদৌ তার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আর দ্বিতীয়ত, গেরুয়া শিবির অমিত শাহের নির্বাচনী কৌশলবিদ্যাকে অপ্রতিরোধ্য হিসেবে ব্র্যান্ডিং করেছিল, মমতা সেই বিশ্বাস ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। মমতা প্রমাণ করেছেন, সঠিক রণকৌশল গ্রহণ করে অসমযুদ্ধেও জেতা যায়। সঠিক রণকৌশল নেওয়া হলে নির্বাচন কমিশন, মিডিয়া, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর বৈরিতা এবং অর্থশক্তিতে দুর্বল থেকেও শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে মাটিতে নামিয়ে আনা যায়। জরুরি হল, আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে বুঝে সরাসরি মেঠো জনসংযোগ। মানুষ চায় সংবেদনশীল ও সৎ প্রশাসন, সুষ্ঠু পরিষেবা ও কর্মের অধিকার। রাজনীতির কাছে মানুষের চাহিদা খুবই সামান্য। রাজনীতির পরিসরও সমাজের কাছে খুব অল্প। ধর্ম, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সামাজিক জীবন, ব্যক্তিস্বাধীনতা—এসবই রাজনীতির পরিসরের বাইরে। তবু রাজনৈতিক দলগুলো এসবের মধ্যে ঢুকে তালগোল পাকিয়ে ফেলে, যা করেছে গেরুয়া শিবির।
অন্যদিকে, বিজেপিকে মোকাবিলায় রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসকে সঙ্গে নেওয়ার অপরিহার্যতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন মমতা। তাঁর জয় কংগ্রেস নেতৃত্বের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকেও আরেকবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মমতাকে বাদ দিয়ে বামেদের সঙ্গে কেন নির্বাচনী আঁতাত করেছিল, তার একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেওয়া সোনিয়া গান্ধীর জন্য এখন দুরূহ হয়ে উঠেছে। স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, ‘মমতা মডেল’ আঞ্চলিক দলগুলোর কাছে কংগ্রেসের গুরুত্ব আরও কমাবে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে এর বড় প্রমাণ এবারের অসমের নির্বাচন। অসমে এনআরসি নিয়ে বিজেপি এবার অত্যন্ত কঠিন অবস্থায় ছিল। যে-কোনও আঞ্চলিক দল মমতার মতো অসমিয়া জাতীয়তাবাদী অবস্থান নিলে অসমের নির্বাচনী ফল ভিন্ন হতে পারত। মূলত কংগ্রেসের ব্যর্থতার কারণেই অসমে বিজেপি-বিরোধী শিবির জেতেনি এবার। আর তাই কংগ্রেসকে পিছনে সরিয়ে ‘মমতা মডেল’ গোটা দেশে মোদি-বিরোধী শিবিরের জন্য অক্সিজেনের এক খনি হিসেবে হাজির হয়েছে। যেখানে গুরুত্ব বাড়বে অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক কৌশলের।
তবে, মুখ্যমন্ত্রী খুব ভালো করেই জানেন, বিজেপির যে নীতি অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনীতি, তা সে যে ধর্মই হোক না কেন, সেই অসুস্থ রাজনীতিটা তো মরেনি! বরং এই প্রবণতাটা হয়তো ধীরে ধীরে আমাদের রাজ্যে বাড়বে বই কমবে না। বিজেপি নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার এই ভোটের পরেই বলেছেন, ‘হ্যাঁ আমরা যা বলেছিলাম তা করতে পারিনি। তবে এটা ভুললে চলবে না যে আমরা ৩ থেকে বেড়ে ৭০ ছাড়িয়েছি— এই লাফটাও কিন্তু কম নয়।’ তার চেয়েও বড় কথা, উনি আরও বলছেন, ‘আজ বিজেপি আর তৃণমূলের মাঝখানে আর কেউ নেই। সংসদীয় বিরোধী বলতে এরাজ্যে আজ আর কংগ্রেস রইল না, যে-ক’জন বামপন্থী ছিলেন, তাঁরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছেন। বিজেপি এরাজ্যে প্রধান বিরোধী নয়, একমাত্র বিরোধী।’ ফলে বোঝাই যায়, বিজেপির সর্বভারতীয় নেতাদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস এখনও বাংলায় বইছে। সাম্প্রদায়িক হিংসার বয়ান তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করানো যায়। বিপুল অর্থব্যয়, এলোপাথাড়ি দলবদল, ভারতের নানা প্রান্ত থেকে নেতা-নেত্রী, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের উড়ে এসে ভোট প্রচার, আইটি সেলের তীব্র উত্থান, মিডিয়ার সদাসজাগ নজর, সেফোলজিস্ট-রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ, ধর্মীয় বিভাজনের অঙ্ক—সব মিলিয়ে এই নির্বাচনের রেশ দ্রুত মিলিয়ে যাবে না, বরং আগামী দিনের সামাজিক-রাজনৈতিক বিন্যাসে গভীর ছাপ রেখে যাবে বলেই মনে হয়।
সব মিলিয়ে বাংলার ভোটের পর, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন আরও ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠেছে। সমস্ত সরকারি এজেন্সিকে মাঠে নামিয়ে, বিজেপির গোটা ভোট-মেশিনারি এবং কয়েক হাজার কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যেভাবে বাংলা দখলের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করা হয়েছিল, তা মমতা যে একাই ভেস্তে দিতে পারেন, সেটা বিজেপি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। বঙ্গদখলে মরিয়া বিজেপি লড়াইটাকে করে তুলেছিল মমতা বনাম নরেন্দ্র মোদির। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পরাজয়, মমতার কাছে নরেন্দ্র মোদির হার হিসেবেই গোটা দেশ দেখছে। আর এইখানেই জাতীয় রাজনীতিতে নেত্রী হিসেবে মমতার গুরুত্ব রাতারাতি বেড়ে গিয়েছে বেশ কয়েক গুণ। মমতাই হয়ে উঠেছেন মোদির বিকল্প!