বেশি বন্ধু-বান্ধব রাখা ঠিক হবে না। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য আসবে। বিবাহযোগ আছে। কর্ম পরিবেশ পরিবর্তন হতে ... বিশদ
১৯৪৭ সালে ভারতভাগ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির গর্ব করার অনেক কিছুই হারিয়ে গিয়েছে। যতটুকু বেঁচে আছে তার মধ্যে একটি নাম নিঃসন্দেহে এই বিজেপি। জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে চরম মতপার্থক্যের পরিণামে ১৯৫১ সালে শ্যামাপ্রসাদ ভারতীয় জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫২ সালে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে দলটি লোকসভায় তিনটি আসন পায়। ওই তিনজন এমপির একজন ছিলেন স্বয়ং তিনি। আর সেবার বিধানসভায় জনসংঘের ন’জন প্রার্থী জয়ী হন।
কিন্তু ১৯৫৩ সালে কাশ্মীরে তাঁর রহস্যমৃত্যুর পর জনসংঘ বস্তুত অনাথ হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন দলটির অস্তিত্ব দেশবাসীর নজর কাড়েনি। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার অবসানের পর চরণ সিংয়ের লোক দল, মোরারজি দেশাইয়ের কংগ্রেস (ও) এবং অটলবিহারী বাজপেয়ি-লালকৃষ্ণ আদবানিদের জনসংঘ মিশে গিয়ে জনতা পার্টি নাম নেয়। মোরারজি সরকারের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সাবেক জনসংঘি অংশ বেরিয়ে গিয়ে ১৯৮০ সালে গড়ে তোলে ভারতীয় জনতা পার্টি। ১৯৯৬
সালে লোকসভায় একক বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে দলটি। দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন অটলজি। তারপরের ইতিহাস সারা দুনিয়া জানে।
সহজ করে বললে এটাই সত্য যে এক বঙ্গসন্তানের হাতে রোপণ করা চারাগাছ আজ এক বিস্ময় মহীরুহ হয়ে উঠেছে। বাংলামায়ের সেই বরেণ্য সন্তান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আজ জন্মদিন। ১৯০১ সালের ৬ জুলাই তাঁর জন্ম।
আমরা জানি ভারতকেশরী শ্যামাপ্রসাদের পিতা হলেন বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। শিক্ষাজগতে আশুতোষ এক কিংবদন্তিপুরুষ। শ্যামাপ্রসাদ সর্বার্থেই ছিলেন তাঁর যোগ্য সন্তান ও উত্তরসূরি। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পাশে আর একজনমাত্র বঙ্গসন্তান বসার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন তাঁর নাম শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ১৯৩৯ সালে ৩৮ বছর বয়সে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন আরও অনেক আগে, তাঁর পিতার মৃত্যুর পরই। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি সেখানে উপাচার্যের দায়িত্বভারও নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে নিছক ডিগ্রি বিতরণের একটি কারখানা হিসেবে দেখতে চাননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করাটা তাঁর এক বিরাট অবদান। চিকিৎসা বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস, পদার্থ বিজ্ঞানী সি ভি রমন-সহ সে-যুগের অনেক প্রণম্য পণ্ডিতের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলে তার নেপথ্য কারিগর ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ।
বাংলা এবং বাঙালির স্বার্থে তিনি ছিলেন আপসহীন। পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪৩) নিয়ে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সরব ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। ১৯৪৬-এ কলকাতায় ও নোয়াখালিতে অশান্তি এবং ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের উপর সঙ্কীর্ণমনাদের নিপীড়ন তাঁকে বিশেষভাবে প্রতিবাদী করে তুলেছিল। ১৯৪৭ সালে নেহরু মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে বাংলা গঠনে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি), চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা (সিএলডব্লু), খড়্গপুরে আইআইটি, কলকাতায় ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান (আইআইএসডব্লুবিএম) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার পিছনে তাঁর বিরাট ভূমিকা ছিল। ভারতের প্রথম শিল্পনীতি প্রণয়ন এবং শিল্প উন্নয়ন নিগম প্রতিষ্ঠা তাঁরই কীর্তি।
শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতির কালটি ছিল অত্যন্ত গোলমেলে এবং স্পর্শকাতর। আমরা জানি, হিন্দু-মুসলিম বিরোধের আবহে দেশভাগ হয়েছিল। হিন্দুদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি সরব ছিলেন। এমনকী হিন্দু মহাসভার মতো সংগঠনে যোগ দিয়ে তার সভাপতির পদও অলংকৃত করেছেন। এই কারণে অনেকে তাঁকে সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদী নেতা বলে চিহ্নিত করে থাকেন। ফজলুল হকের মতো নেতা, কাজী নজরুল ইসলামের মতো কবিরা কিন্তু এই অভিযোগ কোনোদিন আমল দেননি। তাঁরা বরং শ্যামাপ্রসাদকে যথেষ্ট উদার এবং নিরপেক্ষ মানুষ হিসেবেই প্রশংসা করেছেন। তাঁর বাস্তবজ্ঞান ছিল সর্বজনবিদিত।
শ্যামাপ্রসাদ ভারতভাগের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু ভারতভাগ অনিবার্য হয়ে উঠলে তিনি বাংলাভাগের দাবিতে সোচ্চার হন। কারণ, তিনি মনে করতেন অখণ্ড বাংলা পাকিস্তানে চলে গেলে বাঙালি হিন্দু ঘোর দুর্দশায় পড়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গ যে স্বাধীন ভারতের অন্তর্ভুক্ত—এটা বস্তুত শ্যামাপ্রসাদের ইচ্ছাই ফলবতী হওয়া।
ভারতের অন্যতম বৃহৎ সমস্যা হল কাশ্মীর সমস্যা। সাড়ে ছয় দশক আগেই এটা নির্ভুলভাবে অনুমান করেছিলেন যিনি তাঁর নাম শ্যামাপ্রসাদ। তাই এই সমস্যার মূল শুরুতেই উপড়ে ফেলার প্রতিজ্ঞা নিয়ে ১৯৫৩ সালে তিনি কাশ্মীর অভিযান করেন। তাঁর সেই অভিযানের অন্তরায় হয়ে উঠেছিল খোদ স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রশক্তি। কে বলতে পারে, যদি শ্যামাপ্রসাদ সেদিন জয়ী হতেন তবে ভারতে কাশ্মীর সমস্যা বলে আজ কিছুই হয়তো অবশিষ্ট থাকত না। ভারতের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার ব্যয়ভার এতটা গুরু হতো না আমাদের পক্ষে।