বেশি বন্ধু-বান্ধব রাখা ঠিক হবে না। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য আসবে। বিবাহযোগ আছে। কর্ম পরিবেশ পরিবর্তন হতে ... বিশদ
অবশ্য শুরুতে একটা সাফল্য ও প্রাপ্তি আসবে সেটা ভাবা যায়নি। বরং আশা-আশঙ্কার দোলাচলে ভারত ভেবেছিল স্পোর্টসম্যানের মতো বৈঠকে শামিল হওয়াটাই হবে একটা পজেটিভ বার্তা দেওয়া। ভাবটা হল, দেখা যাক কতদূর কী হয়। এর কারণ চীন মার্কিন বাণিজ্য-সংঘাত, যা থামার কোনও উল্লেখযোগ্য লক্ষণ এর আগে আমরা দেখিনি। এমনকী চলমান বাণিজ্য সংঘাতে এশিয়া ও ইউরোপের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির থেকেও জনসমর্থন পাওয়ার আশা ট্রাম্প করেছেন, কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের বাণিজ্যিক লেনদেন চীনের সঙ্গে অনেক বেশি। ফলে আশঙ্কার জায়গা হল, চীন বাণিজ্যে যত সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠবে ততই সে নিজের আধিপত্য ক্ষুদ্রাকার রাষ্ট্রগুলির উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করবে। এতে কেবল মুক্ত বাণিজ্যই নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা, পছন্দ ও উদারনীতিবাদের পরিসরটাই বেমালুম হারিয়ে যেতে পারে। আশঙ্কার আরেক হেতু অবশ্যই ডলারের বিকল্প বিনিময় মুদ্রা আনতে চীনের তৎপরতা এবং তার সঙ্গে বেল্ট এন্ড রোডের পরিকল্পিত যোগসূত্র।
প্রসঙ্গত মনে পড়ে, সমাজতান্ত্রিক কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ব্যবস্থাকে সমালোচনা করে লেখা ফ্রেডারিখ হায়েকের ‘দ্য রোড টু সার্ফডম’ বইটির কথা। সেখানে লেখকের ক্ষুরধার লেখনীর কল্যাণে উঠে আসে সর্বগ্রাসী সরকারের দ্বারা স্বাধীনতা হরণের প্রসঙ্গ। অনেকটা সেই বাঁধা বুলির জায়গা থেকেই যেন ট্রাম্প চীনের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এমনকী তাঁর যুক্তি হল সর্বগ্রাসী ব্যবস্থার আওতায় সমৃদ্ধি লাভ অপেক্ষা স্থবিরতা বরং শ্রেয়। তবে এই পারস্পরিক আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের আঁচ সামলে যদি আমরা স্থির ও খোলা মনে দেখার চেষ্টা করি তাহলে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের কার্যকরী মুখ্য অধিকর্তা ক্রিস্টিন লেগার্ডের সঙ্গে সহমত না হয়ে উপায় নেই। তিনি যথার্থই সাবধানবাণী শুনিয়েছেন যে বিশ্ব অর্থনীতি সংকটপূর্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে এই বিশ্লেষণের দুটো দিক রয়েছে। গভীরতর দিকটি হল বাজারনির্ভর নয়া-উদারনৈতিক ব্যবস্থার যে সংকট তা আদতে পশ্চিমি শক্তিসমূহের কাছে অশনিসংকেত, কারণ অর্থনৈতিক সংকটে ঘায়েল হলেও এশিয়ার অর্থনীতি কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছে তার নিজস্ব শক্তিতে। উপরন্তু চীনের উত্থান প্রমাণ করে বিশ্ব অর্থনীতিকে পশ্চিমি শক্তি জোট একতরফাভাবে নিয়ন্ত্রণে অক্ষম। সুতরাং কাঁদন পালা গেয়ে যদি ড্যামেজ কন্ট্রোল করা যায়। দ্বিতীয়ত, সাধারণভাবে কে বেশি, কে কম ক্ষতিগ্রস্ত সেই আলোচনায় না-গিয়ে লেগার্ডের বক্তব্য অনুযায়ী ফ্যাক্ট হল, বিশ্ববাজারে বৃদ্ধির গ্রাফ দ্রুত নিম্নগামী। ২০১৯-এ বহির্বাণিজ্যের যে ট্রেন্ড তা এক অর্থে তথৈবচ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার তৈরি করে দেওয়া যে সব সূচক দেখে আমরা বলতে পারি, সেইসব অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো বটেই, তাছাড়া বিমান মারফত পণ্য পরিবহণ, গাড়ির উৎপাদন ও বিক্রি, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ইত্যাদি ক্ষেত্রে পতন নজর কাড়ার মতো। শুধু তাই নয়, সংকট সামলে বৃদ্ধির চাকা যে আবার গতিশীল হবে সে সম্ভাবনাও দূর অস্ত। কারণ ব্রেক্সিট নিয়ে অচলাবস্থা, ইরানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে তেল বাণিজ্যের উপর। ফলে অবস্থার আশু উন্নতি না হলে অর্থনীতিতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির করাল ছায়া ঘনিয়ে আসবে একপ্রকার তা নিশ্চিত। অর্থনীতিবিদদের মতে বিশ্বায়নের দরুন চীন-মার্কিন বাণিজ্য সংঘাতের প্রভাব পড়েছে আপাত সমৃদ্ধিশালী সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলির অর্থনীতির ওপরেও। সেইসঙ্গে আমরা যদি বৃহত্তর প্রেক্ষিতে বিচার করি তাহলে দেখব ইতিমধ্যেই রিফিউজি সমস্যায় ইউরোপের অবস্থা বেশ কাহিল। তাছাড়া ইউক্রেন ও ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপের পর থেকে অনেক ইউরোপীয় রাষ্ট্র, বিশেষত বান্টিক রাষ্ট্রগুলি নিরাপত্তার সংকটে ভুগছে। এমতাবস্থায় ট্রাম্প ইউরোপের সুরক্ষায় কতখানি আগ্রহী তা স্বয়ং দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্য! গোদের উপর বিষফোড়া ২৪ জুন থেকে ইরানের উপর আমেরিকা আরেক প্রস্থ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সেই সঙ্গে অতি সম্প্রতি আসিয়ান সম্মেলনে নির্ধারিত ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি থেকে পরিষ্কার তারা যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার হতে চায় না, তেমনি চীনের বিআরআই নিয়েও তাদের স্বতন্ত্র ভাবনা রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল জি-টোয়েন্টি কি পারবে এই জটিল ও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক জাঁতাকল থেকে আমাদের মুক্ত করতে? এর উত্তর দিতে গিয়ে কিছুটা পিছনে ফিরে তাকালে দেখব, ১৯৯৯ সালে ১৯টি বৃহৎ ও সম্ভাবনাময় অর্থনীতিকে নিয়ে জি-টোয়েন্টির উদ্ভব হয়েছিল তদানীন্তন অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে। এর পিছনে ছিল দুটো প্রধান কারণ: (১) মেক্সিকো থেকে যে সংকট শুরু হয়ে আমেরিকায় আছড়ে পড়েছিল তার নিরসনে পশ্চিমি উন্নত অর্থনীতিগুলি ছিল অপারগ।
(২) যাতে ভবিষ্যৎ সংকটের মোকাবিলা করার জন্য যথাযথ তাল-মিল ও মেকানিজম গড়ে তোলা যায়। বস্তুত: জি-টোয়েন্টির প্লাস পয়েন্ট হল তাদের মধ্যে যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমি শিল্পোন্নত রাষ্ট্র রয়েছে, তেমনি চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো সম্ভাবনাপূর্ণ রাষ্ট্রও রয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে এই ফোরামটির বার্ষিক অধিবেশনের কার্যকলাপে আমরা নতুন আশার বার্তা ও নির্ভরযোগ্য আশ্রয় পেয়েছি। আমরা দেখেছি সংকটকালে কীভাবে তারা রিকভারি প্ল্যান তৈরি করতে পেরেছে। এর অঙ্গ হল আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার থেকে প্রয়োজনে অর্থ তোলার অধিকার, বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাঙ্কগুলি যাতে প্রয়োজনীয় ধার দিতে পারে তার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা, আন্তর্বাণিজ্যকে জোরদার করা এবং দরিদ্র রাষ্ট্রগুলির জন্য বিশেষ ছাড় দিয়ে অর্থ মঞ্জুরির ব্যবস্থা করা—সামগ্রিকভাবে যাতে উৎপাদনশীল ক্ষেত্রগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় এবং সেইসঙ্গে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে প্রণোদিত করা। আর এই প্রসঙ্গে আমাদের সাবধান হতে হবে যাতে সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে কোনও রাষ্ট্র যেন Beggar-thy-neighbour policy অনুসরণ না করে। অধ্যাপক হেনার ফ্লাসবেক ইউরোজোন সংকটের জন্য জার্মানির এ জাতীয় নীতিকে যেমন দায়ী করেছেন, তেমনি চীনের সাম্প্রতিক বাণিজ্যিক সাফল্যের চাবিকাঠি হল ডলারের সাপেক্ষে চীনা মুদ্রার বিনিময় মূল্যের হ্রাস এবং মজুরি বেঁধে দেওয়া, যাতে করে রপ্তানির ক্ষেত্রে চীন তুলনামূলক বেশি সুবিধা পায়। কিন্তু চীনের এই একতরফা সুবিধা যে সামগ্রিক স্বার্থের অনুপন্থী নয়, সেদিকে নজর দেওয়া বা সাবধান হওয়া জরুরি। কিন্তু রেফারির মতো তা দেখবে কে? সেজন্য প্রয়োজন ডব্লুটিও-র নজরদারি। তবে কেবল পুলিসি নজরদারি—এতটা বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে। যদিও এমন নজরদারি ক্রমশ জি-টোয়েন্টির বিবর্তনের মধ্যে প্রতীয়মান হয়ে উঠছে। যেমন ২০০৯-এর বৈঠকে ইরানের পরমাণু গবেষণার বিষয়টি এই ফোরামের বৈঠকে গুরুত্ব পেয়েছিল। এ থেকে মনে হতেই পারে, এটি আদতে মার্কিন হেগেমনির ফাসাড। তবে বর্তমানে জি-টোয়েন্টির জনপ্রিয়তার কারণ তার বৃহত্তর অঙ্গন, যা বহুপাক্ষিক আলোচনার মুক্তমঞ্চ। সেইসঙ্গে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক মিলন তথা বৈঠকের আদর্শ প্ল্যাটফর্মও বটে। যেমন এবার আমরা দেখেছি বৈঠকের অবসরে মোদি সৌদি প্রিন্স, রাশিয়ার পুতিন, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, এমনকী কানাডার রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
এর আপাত ফল নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে, কিন্তু এমন সৌহার্দপূর্ণ সাক্ষাতের সুযোগ কিন্তু দুর্লভ। সেই সঙ্গে সংকীর্ণ অর্থে জি-টোয়েন্টি কেবল অর্থনৈতিক হিসাব-নিকেশ বা দর কষাকষির মঞ্চ নয়। তবে বর্তমানে রাষ্ট্রপ্রধানদের অন্তর্ভুক্তির দরুন এর রাজনৈতিক তাৎপর্য প্রভূত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এটা মনে করা বাহুল্য হবে না যদি বলি, বিশ্বে বিদ্যমান ক্ষমতা ভারসাম্যের উপর জি-টোয়েন্টি দাঁড়িয়ে আছে। শুধু কি তাই? লক্ষণীয় জি-টোয়েন্টি কোনও আমলাতান্ত্রিক গ্রুপ নয়, কোনও হেডকোয়ার্টাস ছাড়াই সে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে চলেছে। এর কারণ অনুমান করে নিতে অসুবিধা হয় না, কেননা সহমতের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত হয় তার রূপায়ণ সদস্যদের উপর চাপিয়ে দেবার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে প্রায়শ আমরা দেখেছি, জি-টোয়েন্টির মঞ্চকে সব সদস্য রাষ্ট্রই সদ্ব্যবহার করতে আগ্রহী। সেই সঙ্গে উল্লেখ্য বিশ্বব্যাপী জিডিপি-র ভাগের দিক থেকে জি-টোয়েন্টি অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে জি-সেভেনভুক্ত উন্নত রাষ্ট্রগুলির থেকে। এর একটা কারণ অবশ্যই এটা যে জি-টোয়েন্টি বেড়াজালে আবদ্ধ আপাত সুরক্ষিত জাতীয় অর্থনীতির থেকে মুক্ত বাণিজ্যের সমর্থক। যদিও এটাই মার্কিন অ্যাজেন্ডা, তথাপি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যেন-তেন-প্রকারেণ বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়াই জি-টোয়েন্টির উদ্দেশ্য—এমনটা সহজে বলা যায় না। বরং ট্রাম্পের আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যতই অসহিষ্ণু, আক্রমণাত্মক ও একতরফা পদক্ষেপ করবে, ততই তাকে বাকি সদস্যদের কছে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তে হবে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী মনোভাব যত প্রবল হবে ততই রাশিয়া চীন শিবির নতুন অক্সিজেন পেয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
সুতরাং, আগামী দিনে বিশ্বরাজনীতিতে যদি মেরুকরণ ঘটে, তখন ক্রাইসিস ম্যানেজার হিসেবে ভারতের ডাক পড়বেই। তার জন্য তৈরি থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভারতকে বাদ দিয়ে এমনকী জি-টোয়েন্টির কোনও নতুন সংস্করণও গড়ে উঠতে পারে না। ভারতের এই উজ্জ্বল ভাবমূর্তি গড়ে দিয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিং ও সেই সঙ্গে গোপাল পিল্লাই। নরেন্দ্র মোদির সেই ক্যারিশ্মা না থাকলেও বৈদেশিক ক্ষেত্রে সফল ভূমিকা পালনের পটুত্ব তাঁর রয়েছে। তাই জি-টোয়েন্টির মঞ্চকে ব্যবহার করে সরাসরি অর্থনৈতিক কচকচির মধ্যে না ঢুকে তিনি বরং ঘুরিয়ে বার্তা দিলেন ভ্রষ্টাচার রোধের চেষ্টার উপর গুরুত্ব দিয়ে।
লেখক সিধো-কানহো বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক