বেশি বন্ধু-বান্ধব রাখা ঠিক হবে না। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য আসবে। বিবাহযোগ আছে। কর্ম পরিবেশ পরিবর্তন হতে ... বিশদ
এবার আসা যাক রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে। বর্তমান অর্থবর্ষে কর রাজস্ব থেকে ধরা হয়েছে ঋণবিহীন মোট আয়ের ৮২ শতাংশ। এই আয়ও সম্পূর্ণ আদায় হওয়া দুরূহ ব্যাপার। গত অর্থবর্ষেই সংশোধিত বাজেট হিসেবে আয়কর বাবদ রাজস্ব ধরা হয়েছিল ১১.৮৯ লক্ষ কোটি টাকা। আজকের বাজেটে অর্থমন্ত্রী জানালেন ৫২ হাজার কোটি টাকা আদায় কম হয়েছে—আদায়ের পরিমাণ ১১.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রীর হিসেব অনুযায়ী, গত চার বছরে প্রত্যক্ষ কর বাবদ আয় গড়ে বছরে ১.২৫ লক্ষ কোটি বেড়েছে। অথচ, গত বছর সংশোধিত বাজেটে অতিরিক্ত বৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ২ লক্ষ কোটি টাকা। প্রকৃত আদায় ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু, গত বছরের প্রকৃত আদায় থেকে ধরলে প্রত্যক্ষ কর থেকে অতিরিক্ত ২.৩০ লক্ষ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। যেহেতু রাজস্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তেমন পরিবর্তন এই বাজেটে লক্ষ করা যায়নি তাই এই অতিরিক্ত আদায় অনেকটাই কম হবে। পরোক্ষ করের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা আদায় কম হয়েছে। তাই, গত বছরের প্রকৃত আদায় থেকে ধরলে এবছর অতিরিক্ত প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষ কোটি টাকা অতিরিক্ত কর রাজস্ব আদায় করতে হবে, যদি বর্তমান বাজেটের লক্ষ্য পূরণ করতে হয়। গত বছর কার্যত অতিরিক্ত ২ লক্ষ কোটি টাকার সামান্য বেশি আদায় হয়েছে মাত্র। বর্তমান অর্থবর্ষের প্রথম তিনমাসে জিএসটি আদায় অনুমিত হিসেবের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। তাই, এবছর অতিরিক্ত প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষ কোটি কর থেকে আদায় করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়। অথচ, অন্যদিকে অতিরিক্ত খরচের বহর আগের থেকে অনেক বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মাননিধি প্রকল্প ছাড়াও অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিভিন্ন পেনশন প্রকল্পের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। এমনকী আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পরিকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে ১০০ লক্ষ কোটি টাকা কীভাবে আসবে তারও কার্যকরী কোনও সূত্র এই বাজেট থেকে পাওয়া যায়নি। ফলে, এই বাজেটে অর্থনীতির উন্নয়নসহ সামাজিক উন্নয়নমূলক ব্যয়ের সঙ্কুলান কীভাবে হবে তার রূপরেখা এই বাজেটে নেই। আসলে প্রকৃত রাজস্ব ঘাটতি অনুমিত বাজেট থেকে আরও অনেক বেশি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
এই বাজেটে যে পরিকল্পনাগুলি সরকার কার্যত গ্রহণ করেছে কার্যত তার সিংহভাগই দুই থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি। ২০২৪ অর্থবর্ষের মধ্যে ভারতকে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে এই বাজেটে। বর্তমানে ভারতীয় অর্থনীতির বহর প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব তার রূপরেখা এখানে নেই। আর্থিক সমৃদ্ধির হার একবারে তলানিতে। একই অবস্থা চাহিদা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। ৪৫ বছরের মধ্যে বেকারত্ব সর্বোচ্চ। বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগ গত ১৫ বছরে সর্বনিম্ন। উৎপাদন ও বিক্রয়ের নিশ্চয়তা না-থাকায় বেসরকারি বিনিয়োগের চাকা কার্যত ঘুরছে না বলা যায়। এমতাবস্থায় কিছু কিছু পদক্ষেপ অবশ্য এই বাজেটে গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন কর্পোটের ক্ষেত্রে প্রায় সমস্ত কর্পোরেট ট্যাক্স ২৫ শতাংশে আনা হয়েছে। আড়াইশো কোটি টাকা কার্যকরী মূলধন বা ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের ক্ষেত্রে কোনও শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট ট্যাক্স ছিল ২৫ শতাংশ। কার্যকরী মূলধনের এই সীমা বাড়িয়ে ৪০০ কোটি টাকা করা হল। অর্থমন্ত্রীর মতে, এই সীমার মধ্যে ৯৯.৩ শতাংশ সংস্থাই অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। মাত্র ০.৭ শতাংশ কোম্পানির কর্পোরেট ট্যাক্সের ২৫ শতাংশের বেশি। এর ফলে সরকার মনে করছে, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে। বাস্তবে কতখানি বাড়বে সেটা সময়ই বলবে। এই বাজেটের বিলগ্নিকরণের ১.০৫ লক্ষ কোটি আদায় ধরা হয়েছে। অন্তর্বর্তী ধরা হয়েছিল ৯০ হাজার কোটি টাকা। তবে, যে-পদ্ধতিতে বিলগ্নিকরণের নীতিমালা ধার্য করা হয়েছে তাতে নবরত্ন সংস্থাগুলোর স্থায়িত্ব নিয়ে বিস্তর সংশয় থাকছে।
মধ্যবিত্ত এবং আম জনতা এই বাজেট থেকে কতখানি উপকৃত হচ্ছেন? চাকরিজীবীদের কর ছাড়ের ক্ষেত্রে এদিনের বাজেটে নতুন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অন্তর্বর্তী বাজেটে করছাড়ের ক্ষেত্রে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত (৫৭ এ ধারা) যে-ছাড় দেওয়া হয়েছিল সেটা বর্তমান পূর্ণাঙ্গ বাজেটেও অপরিবর্তিত থাকছে। অর্থাৎ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কোনো করছাড়ের সুযোগ এই বাজেটে নেই। তবে, উচ্চ আয়ের ক্ষেত্রে সারচার্জ কিছুটা বাড়াোন হয়েছে। ২ থেকে ৫ কোটি টাকা ব্যক্তিগত আয়কর দাতার ক্ষেত্রে সারচার্জ ২ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। ৫ কোটি টাকা উপরে সারচার্জ করা হয়েছে ৭ শতাংশ। কার্যত এটুকু বাড়িয়ে বর্তমান বাজেটে প্রত্যক্ষ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কার্যত দুরূহ।
ছোট ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র দোকানদারদের ক্ষেত্রে যে-পেনশন স্কিম ঘোষণা করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, যাদের মূলধন দেড় কোটি টাকার কম তাঁরাই প্রকল্পের আওতায় আসবেন। এই প্রকল্পে ৩ কোটি পরিবার অন্তর্ভুক্ত হবে। এমএসএমই-র ক্ষেত্রে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণে ২ শতাংশ সুদ ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এই বাজেটে মহিলাদের ক্ষমতায়ন ও স্বনির্ভতার ক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষে নেওয়া হয়েছে। দেশের প্রত্যেকটি জেলায় সেলফ হেল্প গ্রুপ গঠনের কথা বলা হয়েছে। এবং, এই ক্ষেত্রে প্রত্যেক মহিলারই জনধন অ্যাকাউন্ট থাকবে। প্রতিটি সেলফ হেল্প গ্রুপের প্রতিটি সদস্য এই অ্যাকাউন্ট থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ওভারড্রাফট নিতে পারবেন। শুধু তাই নয়, প্রতিটি সেলফ হেল্প গ্রুপের সর্বোচ্চ একজন ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ওভার ড্রাফট নিতে পারবেন।
প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ আবাস যোজনায় ২০২১-২২ অর্থবর্ষের মধ্যে ১.৯৫ কোটি নতুন বাড়ি তৈরি করা হবে। ২০২২-এর মধ্যে প্রত্যেক পরিবারই উজ্জ্বলা যোজনার আওতায় আসবে। এই সময়ের মধ্যে ক্লিন কুকিং ফেসিলিটি সম্পূর্ণ করা হবে। এই অর্থবর্ষের ভিতরে সমস্ত গ্রামীণ বাড়িতে শৌচাগার এবং বিদ্যুৎ সংযোগের চাহিদা সম্পূর্ণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ সড়ক যোজনার অধীনে ফেজ থ্রি প্রকল্পে ১.২৫ লক্ষ কিমি সড়ক আধুনিকীকরণ করা হবে। এজন্য ৫ বছরে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০,২৫০ কোটি টাকা।
এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী ‘জনশক্তি মন্ত্রণালয়’ নামে একটি নতুন মন্ত্রকের কথা শোনান। ‘হর ঘর জল’ প্রকল্পের অধীনে জল ও জল সংরক্ষণ ও জল সরবাহের সম্মিলিত পদক্ষেপ করা হবে। ২০২৪ অর্থবর্ষের সমস্ত গ্রামীণ বাড়িতে পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি রেখেছে এদিনের বাজেট। প্রত্যেক গ্রামকে সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট বা কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অধীনে আনা হবে। প্রধানমন্ত্রী শহর আবাস যোজনায় আগামী ৫ বছরের জন্য বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে প্রায় ৫ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। স্টার্ট আপের ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ প্রসারিত করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এদের আয়কর রিটার্নের ক্ষেত্রে ই ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে কোনও স্ত্রুটির ব্যবস্থা থাকছে না। এদের ক্ষেত্রে মূলধনী লাভ জনিত কর জমার সময়সীমা ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এদের ক্ষেত্রে আরও বেশকিছু সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। ডিজিটাল পেমেন্টকে আরও উৎসাহিত করার জন্য যেসব ইনসেনটিভ ঘোষণা করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত কোনও বাণিজ্যিক ডিসকাউন্ট চার্জ করা হবে না। এছাড়া যদি কেউ ১ কোটি টাকার বেশি নগদে ব্যাঙ্ক থেকে তোলেন তবে সেক্ষেত্রে উৎসমূলে ২ শতাংশ লেভি (টিডিএস) ধার্য করা হয়েছে। এটাকে নগদ লেনেদেনে নিরুৎসাহ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
কতকগুলি ক্ষেত্রে নতুন কর আরোপ করা হয়েছে অথবা করবৃদ্ধি করা হয়েছে। যেমন সোনা এবং অন্যান্য দামি পণ্য আমদানির উপর কর বাড়ানো হয়েছে। ছিল ১০ শতাংশ সেটা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২ শতাংশ। আমদানিকৃত বইয়ের ৫ শতাংশ কর ধার্য করা হয়েছে। কতকগুলি দ্রব্য যেমন পিভিসি, টাইলস, সিন্থেটিক রাবার, ডিজিটাল ক্যামেরার ক্ষেত্রে কর বাড়ছে। পেট্রলের উপর কর (কেন্দ্রীয় শুল্ক) বাড়ানো হয়েছে লিটার প্রতি ১ টাকা। বাড়ানো হয়েছে রোড সেসও।
গত ৫ বছরে মোদি সরকার বছরে ২ কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিলেও ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষের ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ৪৫ বছরের ভিতর বেকারত্ব ছিল সর্বোচ্চ। তাই এই বাজেটে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এই সদর্থক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ আশা করেছিল ভারতবাসী। কিন্তু নির্মলা সীতারামন শেষমেশ আমাদের হতাশ করলেন। একদিকে যেমন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে (এমএসএমই) কর্মসংস্থানের দিশা যেমন এই বাজেটে নেই, তেমনি সরকারি পরিকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে বর্তমান বছরের জন্য কার্যকরী রূপরেখাও এই বাজেটে নেই। গত ৫ বছরে দেখা গিয়েছে, রাজকোষ ঘাটতি যেখানে ডিজিপির ৩ শতাংশের অনেক বেশি সেক্ষেত্রে মূলধনী ব্যয় এর অর্ধেকেরও কম।
বর্তমান বাজেটেও যেখানে মূলধনী ব্যয় জিডিপর ১.৬ শতাংশ ধরা হয়েছিল বাজেটে সামাজিক এবং অন্যান্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে এই ব্যয় হ্রাসের সম্ভাবনা প্রবল। তাছাড়া আগামী ৫ বছরে ১০০ লক্ষ কোটি টাকা পরিকাঠামো উন্নয়নের সংস্থান কী হবে
তার জবাবও এই বাজেট দেয়নি। ফলে, বর্তমান বছরে একদিকে রাজস্ব আয় যথেষ্ট কমার আশঙ্কা
রয়েছে এবং অন্যদিকে কর্মসংস্থানসহ পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজনে ব্যয়ের সংস্থানও এই
বাজেটে কার্যত নেই।
লেখক প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক