বেশি বন্ধু-বান্ধব রাখা ঠিক হবে না। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য আসবে। বিবাহযোগ আছে। কর্ম পরিবেশ পরিবর্তন হতে ... বিশদ
কিন্তু, তাই বলে তো আর ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক লড়াই থেমে থাকতে পারে না। লোকসভা ভোটে ১৮ আসন পাওয়ার পর সঙ্গত কারণেই বিজেপি পাখির চোখ করেছে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা। ২০২১ সালের ভোটে বিধানসভায় গরিষ্ঠ দল হিসেবে রাজ্যের ক্ষমতার মসনদ দখলের জন্য দিল্লি কলকাতা একাকার করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিজয়বর্গীয়, মুকুল রায়, দিলীপ ঘোষেরা। একদিকে তৃণমূলের দল ভাঙানো চলছে, পুরসভা পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভা—সর্বস্তরে শাসক সদস্যদের দলে টানার চেষ্টা চালাচ্ছে পদ্মশিবিরের নেতৃবৃন্দ। তাতে বেশকিছু ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে সাফল্যও মিলেছে। বেশ কয়েকটি পুরসভা, পঞ্চায়েত থেকে একটি জেলাপরিষদ কার্যত দখলে চলে এসেছে বিজেপির। বিধানসভায় সদস্য সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বিজেপির পরিষদীয় নেতারা বসার জন্য স্পিকারের কাছে বড় ঘরের দাবি জানিয়েছেন বলে খবর। টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়াতেও বিজেপির পদসঞ্চার শুরু হয়ে গেছে। এর পাশাপাশি নানান অপ্রীতিকর ঘটনাকে শিখণ্ডী করে চলছে ক্ষমতাসীন তৃণমূল প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলে রাজনৈতিক মাইলেজ ও জনসমর্থন বাড়ানোর রাজনৈতিক প্রয়াস। চলতি অশান্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে কদিন আগে লালবাজার অভিযান চালিয়েছে বিজেপি ও তার সহযোগীরা। পুলিসের সঙ্গে ধস্তাধস্তি, জলকামান অবরোধে মধ্য কলকাতা বেশ কিছুক্ষণের জন্য অচল হয়েছে, বিজেপির এক রাজ্য নেতা সেই ধস্তাধস্তিতে অসুস্থ হয়েছেন। কাঁচরাপাড়া ভাটপাড়া নিয়েও তাঁরা আন্দোলন প্রতিবাদে সরগরম করে তুলছেন শহর, শহরতলি। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে একটা রাজনৈতিক সংঘাত সংঘর্ষের আবহ ক্রমশ সাধারণ জনজীবনে চিন্তার ছায়া ফেলতে শুরু করেছে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর প্রশাসন পুলিস এই ছায়া পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারছে না!
আর এখানেই পুলিসের একাংশের ভূমিকা ও সক্রিয়তার ধরন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে! এনআরএসে ডাক্তার নিগ্রহই হোক কি ভাটপাড়া কাঁচরাপাড়া—পুলিস যে যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে একেবারে নিষ্ক্রিয় নীরব থেকেছে—এমন অভিযোগও উঠেছে! এনআরএসে আন্দোলনরত ডাক্তারদের অনেকে সে সময় অভিযোগ করেছেন, বহিরাগতরা যখন ট্রাকে করে হামলা চালাতে এসেছিল তখন পুলিস তাদের ঠেকাতে নাকি কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। নিলে জুনিয়র ডাক্তার পরিবহকে অমন মারাত্মক আহত হতে হতো না। হাসপাতালের হাজার হাজার মরণাপন্ন রোগীকে অত দিন অত কষ্টও স্বীকার করতে হতো না। ভাটপাড়া কাঁচরাপাড়া সমেত বারাকপুর-নৈহাটি শিল্পাঞ্চলের অশান্তির ক্ষেত্রেও সেই এক কথা—এলাকায় পুলিসের অভাব ছিল না। কিন্তু, কার্যকালে তাদের একাংশের ভূমিকা সন্তুষ্ট করতে পারেনি যুযুধান রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রী থেকে সাধারণ মানুষ কাউকেই! অভিযোগ এমনই। কিন্তু কেন? রাজ্য পুলিসের বড় কর্তারা এলাকা সফর করে আসার পরও নাকি পরিস্থিতিতে খুব একটা রকমফের হয়নি! এটা আশ্চর্যের নয়! বিশেষ করে খোদ মুখ্যমন্ত্রী যখন বলছেন, যে কোনও মূল্যে হাঙ্গামা সন্ত্রাস থামান, কে কোন দলের কী গোত্রের তা না দেখে গুন্ডা বদমাস বহিরাগতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করুন— তখনও পুলিসের একাংশের এই আচরণ কি সন্দেহ জাগায় না?
শুধু কি তাই? গত কয়েক দিনে তো দেখা গেল অবস্থা সামাল দিতে না পেরে পুলিসের হাতিয়ার থেকে গুলিও চলে যাচ্ছে! তাতে হতাহতও হচ্ছে! কী মর্মান্তিক! এ আবার কী! এসব চলতে থাকলে বিরোধীরা তো বলবেই, সিপিএম আমলের শেষদিকে নন্দীগ্রাম সিঙ্গুর নেতাইয়ের মতো জায়গায় যে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ পুলিস দেখা দিয়েছিল তাদের উত্তরসূরিরা এখন রাজ্যের কোথাও কোথাও দেখা দিচ্ছে! বৃহস্পতিবার গুড়াপে বিজেপি সমর্থকের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাতে পুলিসের বিরুদ্ধে আঙুল তো উঠেছে! সাম্প্রতিকে এর আগেও পুলিসের গুলি চলেছে অন্যত্র। পুলিসের কারও কারও এমন উগ্র ভূমিকায় বিশিষ্টজনেরা যে বিশেষ উদ্বিগ্ন এবং সাধারণ মানুষজনের মধ্যে যে যথেষ্ট উদ্বেগ ছড়িয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে রাজ্যের সাধারণ জনতা তো এমন পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত নন। তাঁদের তাই এখন একটাই প্রশ্ন, হিংসা হানাহানি ঠেকাতে পুলিস লাঠি চালাক, গ্যাস ছুঁড়ুক, জলকামান ব্যবহার করুক কিন্তু গুলি কেন? অনেকেই এও বলছেন, পুলিসের গুলিচালনা একটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর ব্যাপার। জনমনে তার একটা আলাদা এবং গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সিপিএমের সর্বনাশ করে ছেড়েছিল পুলিসের এই গুলি। আবার তার পুনরাবৃত্তি কেন? এতে তো বিরোধীরা, বিশেষত বিজেপি তাঁদের শাসকবিরোধী আন্দোলনে বাড়তি রসদ পেয়ে যাচ্ছে! সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে উদ্বেগ উত্তেজনা বাড়ছে। এহেন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এমন সংশয় জড়িত প্রশ্নও উঠছে যে, অশান্তি ঠেকাতে পুলিসের একাংশের এই অপ্রত্যাশিত ভূমিকা অশান্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে না তো?
প্রশ্নটি নিতান্ত অমূলক বলা যাবে কি? যাবে না। তার কারণ, সাম্প্রতিকে এনআরএস, ভাটপাড়া ইত্যাদি কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট পুলিসের একাংশ তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন তো করেইনি, উল্টে এমন সব আচরণ করেছে যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল এবং উত্তেজক করে তুলেছে! কেবল আমরা নয়, তথ্যভিজ্ঞরাও বলছেন এমন কথা। আমরা বলছি না যে সব পুলিস এমন করছেন। কিন্তু কয়েকজনের জন্য বদনাম হচ্ছে গোটা পুলিস বাহিনীর, পুলিসের উপর লোকের বিরূপতা বাড়ছে। তার চেয়েও বড় কথা পুলিসমন্ত্রী হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী মমতার অস্বস্তি বাড়ছে! বিজেপি কংগ্রেস সিপিএমের মতো বিরোধীরা মুখ্যমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে স্ব-স্ব রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। এবং ওইসব পুলিসের জন্য জনমনেও যে কাঁটার খোঁচা বাড়ছে তাতেই বা সন্দেহ কী? ইতিমধ্যেই রাজ্যের পুলিস প্রশাসনে কিছু রদবদল করেছেন মমতা। তাতে হয়তো পুলিসের কাজকর্মে কিছু উন্নতি হয়েছে বা হবে। কিন্তু, মাদক বিরোধী অনুষ্ঠানে যে পুলিস অফিসার আকণ্ঠ পান করে অংশ নেওয়ার দুঃসাহস দেখায় বা চোখের সামনে মারদাঙ্গা খুনোখুনি হতে দেখেও যে পুলিস উদাসীন দর্শকের ভূমিকা নেয় বা যে পুলিস হাইওয়েতে লরি-গাড়ি থামিয়ে যানজট বাধিয়ে তোলা আদায় করে বা যে পুলিস অকারণে সাধারণ মানুষকে হেনস্তা করে নির্বিকার চিত্তে— শুধু বদলিতে তাদের চিত্তশুদ্ধি হবে, তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে সৎ স্বচ্ছ স্বাভাবিক জনদরদি হয়ে পড়বে এমনটা ভাবা বোধহয় একটু বেশিই হয়ে যায়, তাই না? কিন্তু উপায় কী? রদবদল করেই এদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়—এমনটাই বলছেন কর্তারা।
এখন কথা হল—লোকসভার ভোটফল প্রকাশের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে যে মেজাজি রাজনীতি শুরু হয়েছে, তৃণমূল বিজেপির মধ্যে সমানে সমানে রাজনৈতিক লড়াইয়ের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে (এবং যার জন্য মাঝেমধ্যেই রাজ্যের নানা এলাকা গরম হয়ে উঠছে, রক্ত ঝরছে) তার সুর যে আগামী দিনে আরও চড়া হবে তা বলাই বাহুল্য। এ রাজ্যে আগামী বছরের পুরভোট বা তার পরবর্তী বিধানসভার নির্বাচন কতটা শান্তিতে হবে তা নিয়ে তাই এখন থেকেই রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞদের অনেকে বিশেষ চিন্তিত। সাধারণের মহলেও তা নিয়ে একটা চাপা উদ্বেগ লক্ষ করা যাচ্ছে। ভোট পরবর্তী উত্তপ্ত পরিস্থিতি সন্ত্রাসের চোখরাঙানি, বিবদমান রাজনৈতিক শিবিরগুলির হুমকি প্রতিহুমকি নিঃসন্দেহে সেই উদ্বেগে শঙ্কার বাড়তি ইন্ধন জোগাচ্ছে। এমন অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বা জনজীবনকে রাজনৈতিক সংঘাতের তাপোত্তাপ থেকে বাঁচাতে অন্যতম ভরসা পুলিস।
পুলিসি দক্ষতা এবং সময়ানুগ সক্রিয়তা বজায় থাকলে অনায়াসে অনেক কিছুই সহজে মিটে যায় বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রাণও বাঁচে। কিন্তু, মার ঠেকাতে গিয়ে যদি পুলিসই প্রাণঘাতী মারমুখী হয়ে ওঠে তবে তো বিপদ। সেই বিপদের আভাস মিলেছে। যতদূর খবর, বিপদ যাতে বাড়তে না পারে তার
জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নিচ্ছে মমতা সরকার।
সেই ব্যবস্থায় শেষপর্যন্ত কতটা কাজ হয় এখন
সেটাই দেখার।