ভক্তিধর্ম অতি সুপ্রাচীন, তথাপি মহাপ্রভুর যুগ হইতেই যেন ভক্তিপথে বান ডাকিয়াছে। ভক্তিধর্মের প্লাবনে সমগ্র দেশ ভাসিয়া গিয়াছে। প্লাবনে ভাসিয়া গিয়াও আজ চিন্তা করিতে আনন্দ লাগে— এই ভক্তিধর্মের মূলে কি এক অপূর্ব অনির্বচনীয় শক্তিশালী তত্ত্ব রহিয়াছে, যাহার মহিমায় আজও ভক্তিধর্ম প্রাণবন্ত। অদৃষ্ট কারণ সাধারণে দৃশ্যপথে না আসিলেও, ভক্তিপথে ত্যাগ-বৈরাগ্যের আদর্শকে যে মহাপ্রভু অম্লান-অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন—ইহা নিঃসঙ্কোচে এবং নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। ত্যাগ-বৈরাগ্যের শৈথিল্যের জন্য তিনি নির্মমভাবে আপন ভক্তদের উপরও শাসন দণ্ড পরিচালনা করিতেন। ‘ভাল না খাইবে আর ভাল না পরিবে,’ ‘জিহ্বার লালসে সেই ইতি উতি ধায়’—এই ধরনের সাবধান বাণী মহাপ্রভুর শ্রীমুখে সতত উচ্চারিত হইত। ভক্তিধর্ম্ম যে কঠোর ত্যাগ-বৈরাগ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, স্বয়ং মহাপ্রভুই তাহা সুপ্রমাণিত করিয়া গিয়াছেন। গৌরাঙ্গের পথে অর্থাৎ ভক্তিপথে ত্যাগ-বৈরাগ্যের কোন প্রয়োজন করে না, এইরূপ সর্বনাশা মনোবৃত্তি ভক্তিধর্ম প্রচারকদের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করিয়া বসিয়াছে। ইহার ফলে ভক্তিপথে যে কি আবর্জনাস্তূপ জাগিয়া উঠিয়াছে তাহা আর বলিবার নয়। ভক্তিপথ সহজ, কেননা এই পথে ত্যাগ-বৈরাগ্য সংযমের বালাই নাই, এইরূপ কথা আমরা প্রায়ই শুনিতে পাই। কিন্তু ভক্তিপথে যদি ত্যাগ-বৈরাগ্যের অগ্নিশিখা না থাকে, তবে কিরূপ জঞ্জালের সৃষ্টি করে তাহা কি আর এই অধঃপতনের যুগে বিশেষ করিয়া কীর্তন করিতে হইবে? আদর্শ নিষ্ঠার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত সংস্থাপনের জন্য দয়ার অবতার শ্রীগৌরাঙ্গ কিরূপ নির্মমভাবে ছোট হরিদাসকে বর্জন করিয়াছিলেন, ভক্তিধর্ম প্রচার করিতে গিয়া ত্যাগের এই মহিমার কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়া যাই। প্রেমিক মহাপ্রভু জগতের সকলকেই ভালোবাসিতেন; তাঁহার শ্রীমুখ হইতেই ভজনপরায়ণ বৈষ্ণবদের প্রতি এই বাণী উচ্চারিত হইয়াছিল—
বিষয়ীর অন্ন খাইলে দুষ্ট হয় মন।
মলিন মন হইলে নহে কৃষ্ণের স্মরণ।।
ভাল-মন্দ, হেয়-উপাদেয়, খুকু, অধিকারী-অনধিকারী—এই প্রশ্ন এইখানেই উত্থিত হয়। ‘‘সর্ব জীবে সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ অধিষ্ঠান’’—এই কথা যিনি বলিয়াছেন, তিনিই আবার দুঃসঙ্গ পরিত্যাগের নির্দেশও দিয়াছেন। ভক্তি অর্থাৎ ঈশ্বর-ভজনের মূলে ত্যাগ বৈরাগ্য আছে কি না সর্বদা মহাপ্রভু ইহাই লক্ষ্য করিতেন। বৈষ্ণব ধর্মের বিকৃতি উপস্থিত হইয়াছে বলিয়াই আমরা ত্যাগবৈরাগ্যহীন ভক্তির কথা শুনিতে পাই। গৌরাঙ্গের প্রেমধর্ম সংসার ভোগাসক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নহে। ত্যাগ-বৈরাগ্যের সুদৃঢ় স্তম্ভের উপরই প্রেমধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত। কলিযুগে ত্যাগবৈরাগ্যকে বাদ দিয়া কেবল নামে, কিম্বা কেবল ভক্তিতেই যদি ইষ্টলাভ হইত, তবে শ্রীমন্মহাপ্রভু নিজে এবং তাঁহার প্রিয় অনুরক্ত ভক্তগণ এত কঠোর ত্যাগ-বৈরাগ্যের আচরণ এবং কৃচ্ছ্রব্রত অবলম্বন করিয়াছিলেন কেন? ভাবের বন্যায় ভাসিয়া গিয়া যদি আমরা ত্যাগ বৈরাগ্যের শক্ত খুঁটিকে পরিত্যাগ করি, তবে সেই প্রেমধর্মের স্থায়িত্ব কোথায়?
গুরুপদ মণ্ডলের ‘ভক্তি শতদল সঞ্চয়ন’ থেকে