ঊনবিংশ শতাব্দী ভারতবর্ষের ইতিহাসে সর্বপ্রকারে এক স্মরণীয় যুগ। এই শতকে ভারতবর্ষ বহুবিধ কারণে জীবনমরণের সন্ধিক্ষণে আসিয়া উপনীত হয়। ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই নিদারুণ পরিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মতবিরোধ এবং বহিরাগত শিক্ষাদীক্ষার সহিত সংঘর্ষে ভারতের জীবনধারা, বিশেষতঃ ধর্মজীবন বিপর্যস্ত হইয়া পড়ে। অন্য কোন জাতি হইলে এই প্রচণ্ড আঘাতে একেবারেই হয়তো নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইত, কিন্তু যুগযুগান্তরের সঞ্চিত আধ্যাত্মিক তপঃশক্তির প্রভাবে ভারতবর্ষ কোনক্রমে তাহার সনাতন বৈশিষ্ট্যরক্ষায় সমর্থ হইল। মৃত্যুর পর জন্ম যেমন ধ্রুব, অন্ধকারের পর আলোক যেমন অবশ্যম্ভাবী, তেমনই জাতির পতনের পর উত্থান চিরন্তন নিয়ম। ‘পতন এবং অভ্যুদয়ের বন্ধুর পন্থা’ অবলম্বন করিয়াই চলে মহাকালের রথ। এইরূপে যখন ভাব ও আদর্শের ভীষণ সংঘর্ষ চলিয়াছে এবং তজ্জন্য ধর্মে গ্লানি উপস্থিত হইয়াছে, ঠিক সেই যুগসন্ধিক্ষণে ভারতের পূর্বকোণে পুণ্যতোয়া ভাগীরথীর তীরে নব্যশিক্ষাদীক্ষাহীন আত্মভোলা ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের সমন্বয়ের পাঞ্চজন্য বাজিয়া উঠিল। সমন্বয়ের এই শান্তিমন্ত্রে সকলের মিথ্যা দ্বন্দ্ব এবং অহমিকা অপনীত হইল। নব্যভারতের প্রাচীনপন্থী এবং নবীনপন্থী আচার্যগণ একে একে প্রায় সকলেই এই যুগাবতারের আকর্ষণে যুগতীর্থ দক্ষিণেশ্বরে, মহাশক্তির বিরাট মন্দিরের মঙ্গল-ছায়াতলে মিলিত হইয়া আবার গাহিলেন ভারতের তপোবনের সেই আর্ষবাণী,—
“অসতো মা সদ্গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মামৃতং গময়।”
দক্ষিণেশ্বর তপোভূমি—চিরতীর্থ, ভবিষ্যৎ বিশ্বমানবধর্মের অপূর্ব মিলনক্ষেত্র। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সকল প্রকার সাধনাকে সিদ্ধির গৌরব দিলেন, অসাধ্য সাধন করিলেন এই দক্ষিণেশ্বরে। শ্রীরামকৃষ্ণের স্বরূপ কি, তাহা আমাদিগের ক্ষুদ্র বুদ্ধি এবং শক্তি দ্বারা নিরূপণ করিতে যাওয়া সম্ভব নহে। মনীষীগণ নিজ নিজ বুদ্ধি এবং বিচারের মাপকাঠিতে কেহ তাঁহাকে সাধক বলিয়াছেন, কেহ বলিয়াছেন প্রেমিক, কেহ মহাপুরুষ, আবার কেহ তাঁহাকে ভগবান বলিয়া পূজা করিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণকে যদি ভগবান বলিয়া স্বীকার না করিয়া সাধক মহাপুরুষের পর্যায়েই স্থান দেওয়া যায়, তথাপি তাঁহার অমিয় জীবনচরিত আলোচনা করিলে আমরা যাহা লাভ করি তাহার তুলনা কোন যুগের কোন জাতির ইতিহাসে পাওয়া যায় না। বাল্যকালে বিদ্যাভাসে শ্রীরামকৃষ্ণের তাদৃশ অনুরাগ দেখা যায় নাই, যৌবনেও তিনি কোন চতুষ্পাঠী অথবা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন নাই, বরং স্পষ্ট কথায় বলিয়াছেন, “তোমাদের ও চালকলা-বাঁধা বিদ্যা আমি শিখতে চাই না।”
শ্রীদুর্গাপুরী দেবীর ‘গৌরীমা’ থেকে