কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
তোমার এই প্রশ্ন অতি উত্তম। প্রতি সাধকের পক্ষে হৃদয়ের জ্ঞান অত্যাবশ্যক। ইহা সকলেই জানে যে, লৌকিক মনুষ্যের জীবনেও হৃদয়কে জানিবার প্রয়োজন আছে। কারণ, সাধারণতঃ জাগ্রৎ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি বুঝিতে হইলে হৃদয়কে বোঝা অত্যন্ত আবশ্যক। কারণ হৃদয় হইতেই নাড়ীজাল প্রসৃত হইয়া সমস্ত দেহে ব্যাপ্ত হইয়াছে। জাগ্রৎ অবস্থায় কতকগুলি নাড়ী হৃদয় হইতে প্রসৃত হইয়া অন্নময় কোষে ইন্দ্রিয়দ্বার পর্যন্ত সঞ্চালিত রহিয়াছে। এই সকল নাড়ীর দ্বারা ইন্দ্রিয়সকল ক্রিয়াশীল হয় এবং রূপরসাদি বাহ্যজগতের সকল বিষয় গ্রহণ করে। অন্নময় কোষ এই প্রকারে হৃদয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
প্রাণময় কোষও তাহাই। মনোময় কোষ স্বপ্নদর্শনের সহিত সংশ্লিষ্ট। সেখানে হৃদয় অজ্ঞানে আবৃত, কিন্তু মনোবহা নাড়ীর দ্বারা পূর্ণরূপে অধিগত। স্বপ্নজগৎ ইহার অতি সংশ্লিষ্ট। কিন্তু সুষুপ্তিকালে নাড়ীর ক্রিয়া থাকে না। মন হৃদয়ে ডুবিয়া যায়। হৃদয় তখন অজ্ঞানে আচ্ছন্ন। ইহার পর যাহাদের জ্ঞানের কিঞ্চিৎ মাত্র উদয় হইয়াছে তাহাদের ঊর্ধ্ব-মার্গের সহিত সম্বন্ধ ঘটে। তখন হৃদয় হইতে সঞ্চালিত ঊর্ধ্বনাড়ীর দ্বারা তাহারা চালিত হইতে আরম্ভ করে। তখন দেহাত্মবোধ কাটিতে থাকে। তখন সুষুম্নার ক্রিয়া স্পষ্ট ভাবে অনুভূত হইতে থাকে। ভৌতিক আকাশ ও চিত্তাকাশ ভেদ হইয়া যায়। ক্রমশঃ চিদাকাশে প্রবেশ হয়। সাধক তখন মনোময় কোষ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া ক্রমশ বিজ্ঞানময় কোষ অধিকার করে। চিদাকোশে অখণ্ড সত্তা অনন্ত রূপে ভাসিতে থাকে। দিব্যরূপ, দিব্যগন্ধ প্রভৃতি প্রকাশ পায়। দেশকালের সীমা তখন আর তাহার দৃষ্টিকে আবদ্ধ করে না। এই ক্রমিক ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে অবস্থাবিশেষে উপর হইতে এক অধোগতির সংযোগ হয়। তখন ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া থাকে না এবং বাহ্য বিষয়ের গ্রহণ হয় না। কিন্তু প্রাণের ক্রিয়া থাকে এবং জীব স্বপ্নজগতে সঞ্চলন করে। জাগ্রত অবস্থার ন্যায় স্বপ্ন অবস্থানেও নাড়ীর ক্রিয়া বহিয়াছে। এই সকল নাড়ী প্রাণময় কোষের সহিত সংশ্লিষ্ট। প্রাণময় কোষ স্বপ্নাবস্থায় ক্রীয়াশীল থাকে। জাগ্রৎ অবস্থায় যেমন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা স্থূলজগতের গ্রহণ হয় স্বপ্ন অবস্থায় তেমনি সূক্ষ্মজগতের গ্রহণ হইয়া থাকে। এই উভয় কার্যই নাড়ীর সঞ্চালনমূলক। কিন্তু সুষুপ্তি অবস্থায় মন নাড়ীপথে সঞ্চরণ করে না কিন্তু হৃদয়ে নিষ্ক্রিয়ভাবে সুপ্ত থাকে। তাই ঐ অবস্থায় বাহ্য জগতের বোধ হয় না, আভ্যন্তরীণ জগতেরও বোধ হয় না—কোন বোধই হয় না।
ঐ অবস্থায় মন হৃদয়ে সুপ্ত থাকে। এটি মনের নিষ্ক্রিয় অবস্থা। এখানে অবিদ্যার সম্পূর্ণ প্রভাব। তাহার পর জীবন—যোনিপ্রযত্নের দ্বারা জীবের সুষুপ্তি ভঙ্গ হয়। এইভাবে জাগ্রৎ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তির মধ্য দিয়া সংসারচক্র আবর্ত্তিত হয়। কিন্তু যদি কোন ভাগ্যবান পুরুষ জ্ঞানের সন্ধান পাইয়া থাকেন তাহা হইলে বুঝিতে হইবে যে তিনি ঐ জ্ঞানের আলোকে হৃদয়ের অন্ধকার দূর করিতে পারিয়াছেন। এই অবস্থায় মন সুষুপ্ত থাকে না ও জাগ্রৎ হইয়া হৃদয় ভেদ করিয়া ঊর্ধ্বমুখে উত্থিত হয়। শাস্ত্র বলিয়াছেন, ‘শতং চ এক চ হৃদয়স্য নাড্যঃ’—অর্থাৎ হৃদয় হইতে অসংখ্য নাড়ী (শত শব্দের অর্থ অসংখ্য) নিম্নদিকে— চারিদিকে ব্যাপ্ত হইয়াছে। এই সকল নাড়ীর দ্বারা জাগ্রৎ ও স্বপ্ন অবস্থায় জীবনের কার্য নির্বাহ হয়। ইহা অজ্ঞানীর সংসার অবস্থার কথা।
কিন্তু যে ভাগ্যবান পুরুষ জ্ঞানপ্রাপ্ত হইয়াছেন তিনি এই সকল আবর্তে পতিত হন না। তিন ঊর্ধ্বমুখে সুষুম্নার সাহায্যে গতিশীল হন। এই যে বলা হইয়াছে ‘শতং চ একা চ’ এই এক নাড়ীটি হইল ব্রহ্মনাড়ী, ইহার নাম সুষুম্না। ইহা ঊর্ধ্বদিকে অনন্তভাবে ব্যাপ্ত রহিয়াছে। এই নাড়ীর দ্বারা বিজ্ঞানময় কোষ ও আনন্দময় কোষে গতি ও স্থিতি লাভ হয়।