উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
নন্দরাজ বলিলেন—আমার সখা বসুদেব কেমন আছেন হে উদ্ধব? উদ্ধব, তোমরা আমার পর নও। তোমার পিতা, আমি ও বসুদেব এক পিতামহের সন্তান। আমাদের পিতামহ দেবমীঢ় দুই বিবাহ করিয়াছিলেন। ক্ষত্রিয় পত্নীর ঘরে জন্মেন দেবভাগ ও বসুদেবের পিতা শূর, আর বৈশ্যা মাতার পুত্র আমার পিতা পর্জন্য। বসুদেব কেবল আমার ভাই নয়, খেলার সাথী—ছেলেবেলায় কত একসঙ্গে খেলিয়াছি মাঠে ঘাটে। পুত্র-কন্যাগণসহ বসুদেবভাই কুশলে আছেন তো? তাঁহার সব সুহৃদ্গণ, যাঁহারা কংসভয়ে ভীত হইয়া নানা দেশ-বিদেশে ছদ্মবেশে ঘুরিতেছিলেন, তাঁহারা কি সম্প্রতি মিলিত হইয়াছেন মথুরায় আসিয়া?
আহা! বসুদেব ভাই আমার কত কষ্টই না পাইয়াছেন সুদীর্ঘকাল ধরিয়া দুষ্ট কংসের কারাগারকক্ষে। সম্প্রতি সেই দুঃখ হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছেন। সৌভাগ্যের কথা পাপাচারী কংস মরিয়া গিয়াছে অনুজবর্গের সহিত। নিজের পাপাগুনেই নিজে পুড়িয়াছে। পুড়িবেই—সজ্জনের উপর অত্যাচার চালায় যাহারা, অনিবার্য্য তাহাদের মরণ। সদাচারী যাদবকুলের উপর কী অমানুষিক দৌরাত্ম্যই না করিয়াছে! সেই মহাপাতকের ফলও ফলিয়াছে।
“দিষ্ট্যা কংসো হতঃ পাপঃ, সানুগঃ স্বেন পাপ্মনা।
সাধুনাং ধর্মশীলানাং যদূনাং দ্বেষ্টি যঃ সদা।।
কংসের মৃত্যুর কথা বলিতেই নন্দরাজের কৃষ্ণের প্রসঙ্গ আসিয়া পড়িল। আর পারিলেন না চাপিয়া রাখিতে। বলিলেন, আচ্ছা উদ্ধব, জিজ্ঞাসা করি, কৃষ্ণ আমার কি মথুরায় আছে? থাকিলে কোনো খবর পাই না কেন? পরস্পর শুনিয়াছি যজ্ঞোপবীত হইবার পর দুই ভাই নাকি সুদূর অবন্তীনগরে গিয়াছে গুরুগৃহে। কথা শুনিয়া আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে। গুরুগৃহে কঠোরতার কথা জানত উদ্ধব! ভিক্ষা করিতে হয়, যজ্ঞের সমিধ্ বহিতে হয়। আমার দুধের বালক, যে দণ্ডে খায় দশবার, তার উপর গুরুগৃহের কঠোরতা; অত কাঠ কাটা, পায়ে হাঁটা তপশ্চর্য্যার নির্য্যাতন কি কৃষ্ণের সাজে?
আমি ওকথা বিশ্বাস করি নাই উদ্ধব। আমার ভাই বসুদেব এত বিচারহীন নির্দ্দয় নিশ্চয়ই নয় যে কৃষ্ণের মত বালককে গুরুগৃহের তপস্যাচরণে পাঠাইবে। আচ্ছা, যদি দিয়াই থাকে সম্প্রতি কি মথুরায় আসিয়াছে ফিরিয়া? সেই নবজলধর বরণ গোপাল কি তাহার পরম স্নেহময়ী মায়ের কথা মনে করে? প্রিয় সুহৃদগণের অকৃত্রিম সৌহার্দ্দের কথা কি স্মরণে আছে? খেলুয়া সখাগণের কথা কি তাহার একটিবারও হৃদয়ে জাগিয়া উঠে? যে গোপগণ তাহাকে কত আদরে স্নেহে কোলে তুলিত সেই গোপদের কথা কি মনে করে? যে ব্রজভূমিতে সে কত আনন্দে ক্রীড়াকৌতুকে বিচরণ করিত, সে ব্রজের কথা কি তার স্মৃতিপথে উদিত হয়? ধেনুগণকে কৃষ্ণ কত ভালবাসিত। নিত্য নিজ হাতে তৃণগ্রাস লইয়া প্রত্যেকটি গাভীকে খাওয়াইত। গাভীরাও তাহার দিকে পলকহারা দৃষ্টিতে তাকাইয়া অশ্রু বিসর্জ্জন করিত, অঙ্গ লেহন করিত। সেই গাভীগুলির কথা কি সে এখনও ভাবে? যে ব্রজবনে খেলিতে খেলিতে সে আহার নিদ্রা ভুলিয়া যাইত, সেই ব্রজবিপিনের কথা কি সে একেবারে অন্তর হইতে মুছিয়া ফেলিয়াছে? যে গিরিরাজ গোবর্দ্ধনকে সে ছাতাটির মতন করিয়া ধরিয়াছিল, যে গিরি গাত্রে সর্ব্বত্র চরণচিহ্ন অঙ্কন করিয়া দিয়াছে সেই গিরি যে আজ তাহার বিরহে কেমন করিয়া কাঁদিতেছে তাহা অনুভব করিবার অবসর কি তাহার হয়?’
“অপি স্মরতি নঃ কৃষ্ণো মাতরং সুহৃদঃ সখীন্।
গোপান্ ব্রজঞ্চাত্মতনাথনং গাবো বৃন্দাবনং গিরিম্।।