উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
কর্মযোগের দার্শনিক তত্ত্বকে কর্মজীবনে পরিণত করা নিষ্কাম কর্মদ্বারা মুক্তিলাভের অন্যতম উপায়। কর্মযোগদর্শন শিক্ষা দেয় যে, মানুষের শারীরিক ও মানসিক সকল ক্রিয়া বা পরিবর্তনের অবলম্বনরূপে উহাদের পশ্চাতে এক অক্রিয় অপরিবর্তনীয় অজর অমর শাশ্বত সাক্ষিস্বরূপ আত্মা আছেন। তাঁহার অধিষ্ঠানের জন্যই ইন্দ্রিয়গণ সকল কার্য করে, কিন্তু তিনি উহাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তিনি শরীর মন ও ইন্দ্রিয়সমূহের সকল কার্য হইতে একেবারে স্বাধীন। ‘যেমন সর্বব্যাপী আকাশ অতিসূক্ষ্ম বলিয়া কিছুতে লিপ্ত হয় না, সেইরূপ সকল দেহে অবস্থিত থাকিয়াও আত্মা দেহধর্মদ্বারা লিপ্ত হন না।’’
প্রকৃতির (ব্রহ্মশক্তি বা মায়ার) সত্ত্ব রজঃ তমঃ গুণ দ্বারা সকল কার্য সম্পন্ন হয়। যাহার বুদ্ধি অহঙ্কারে আচ্ছন্ন, তিনিই ‘আমি কর্তা’ এইরূপ মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে ‘‘কায়মনোবাক্য দ্বারা কৃত সকল কর্মই প্রকৃতি দ্বারা সর্বপ্রকারে সম্পাদিত হয়।’’ প্রকৃতির বা দেহ-মন-ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়ার সঙ্গে উহার সাক্ষী আত্মাকে এক ভাবিয়া মানুষ মনে করে যে আত্মাই সকল কার্য করেন। আমরা যে বিভিন্ন দৃশ্য দেখি বা বিভিন্ন চিন্তা করি, উহাদের দ্রষ্টা জ্ঞাতা বা সাক্ষী একই। আত্মাকে যখন মনের ক্রিয়াবিশেষের সঙ্গে যুক্ত বলিয়া মনে করা হয়, তখন তিনি জ্ঞাতা বা চিন্তক। অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হইবার প্রথমাবস্থায় আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, ক্রোধ বৃদ্ধি হইতেছে। প্রথমে ক্রোধ ও ক্রোধের জ্ঞাতা স্বতন্ত্র থাকে। ক্রমে ক্রোধ যখন প্রবল আকার ধারণ করিয়া আমাদের সমগ্র মনকে আচ্ছন্ন করে, তখন উহা ক্রোধের জ্ঞাতার উপর প্রতিফলিত হয়। ক্রমে ক্রোধ হইতে আমাদিগকে পৃথক রাখিতে না পারিয়া আমরা ক্রোধের সঙ্গে একীভূত হই। প্রথমে আমরা ক্রোধকে মনের একটি অবস্থা-বিশেষ-রূপে দেখি, কিন্তু ক্রমে যখন ইহা জ্ঞাতার সঙ্গে একীভূত হয়, তখন আমরা ক্রোধের সঙ্গে একীভূত হইয়া যাই বলিয়া বোধ করি। ঠিক এই ভাবে মানুষ আত্মাকে মনের অবস্থা-বিশেষ, ইন্দ্রিয় ও দেহের সঙ্গে যুক্ত বোধ করিয়াই কর্ম ও ইহার ফলাকাঙ্ক্ষার সহিত একীভূত হইয়া উহাদের প্রতি আসক্ত হয়। ক্রোধের জ্ঞাতা হইতে ক্রোধ পৃথক—এই বোধ থাকা পর্যন্ত যেমন ক্রোধ ও ক্রোধের জ্ঞাতা একীভূত হইতে পারে না এবং ইহার ফলে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হওয়াও সম্ভব হয় না, শরীর ও মনের কর্ম এবং উহার ফল হইতে আত্মা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র—এই বোধ থাকিলে তেমন শরীর ও মনের ক্রিয়া এবং উহার ফলের সঙ্গে আত্মাকে একীভূত মনে করা সম্ভব হয় না। ফলে কর্ম ও উহার ফলের প্রতিও আসক্তি হইতে পারে না। কারণ, পৃথক বোধ থাকা পর্যন্ত পরিপূর্ণ আসক্তি অসম্ভব। দুই মিলিয়া একীভূত হওয়াই পূর্ণ আসক্তির লক্ষণ।
কর্মযোগ দৈনন্দিন জীবনে কার্যে লাগাইয়া অনাসক্ত ভাবে সকল কর্ম করিতে হইলে সর্বদা বিচার করা আবশ্যক যে, কার্য করে কে? আমাদের শরীর মন ও ইন্দ্রিয়ের মধ্যে কে কাজ করে? আমরা এই বিষয় পর্যালোচনা করিলে জানিতে পারি যে, শরীর ও মনের সাহায্যে ইন্দ্রিয়গণই কার্য করিয়া থাকে। সাধারণতঃ আমরা শব্দ শুনিলে বা রং দেখিলে উহাকে আমাদের শরীরের বাহিরে শুনি বা দেখি বলিয়া মনে করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইহা সত্য নয়। শব্দমাত্রই বায়ুর কম্পন। এই কম্পনকে শ্রবণেন্দ্রিয় স্নায়ুর সাহায্যে বহন করিয়া মস্তিষ্কে উপস্থিত করিলে এক প্রকার উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এই উত্তেজনা শরীরের বাহির নিক্ষিপ্ত হইলে শব্দে পরিণত হয়। ইহারই নাম শব্দশ্রবণ। আমরা যে রং দেখি, উহা আমাদের শরীরের বাহিরে অবস্থিত কোন বস্তু বা উহা হইতে নির্গত রঙিন রশ্মিজাল নয়; ইহা ইহার—তরঙ্গের এক প্রকার কম্পন। কম্পমান ইহার অক্ষিগোলকের পশ্চাৎবর্তী ঝিল্লী (retina) ও দর্শন-স্নায়ু, (opticnerve)-তে আঘাত করিয়া এক প্রকার স্নায়বিক ক্রিয়া জন্মায়। ইহার ফলে মস্তিষ্ক রঙের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
স্বামী সুন্দরানন্দের ‘যোগচতুষ্টয়’ থেকে