ভারতবাসীর সবচেয়ে বড় কষ্ট ছিল পরাধীনতা। ইংরেজের শোষণের যন্ত্রণা সয়েছে দু’শো বছর। ভারতবাসীর আক্ষেপ, বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েও ভারত এগতে পারেনি শুধু এই জন্যে। চার্চিলকে ভারতবাসী ক্ষমা করবে না কোনওদিন। বিশেষ করে বাংলার মানুষ। কারণ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের অমানবিক নীতির বলি হয়েছিল ৩০ লক্ষ নর-নারী-শিশু। যুদ্ধবাজ চার্চিল ১৯৪৩-এ বিপুল পরিমাণ চাল মজুদ করেন সৈনিক ও যুদ্ধের কাজে যুক্ত কর্মীদের জন্য। তার ফলে বাংলার বুকে নেমে আসে ভয়ঙ্কর অনাহারের অভিশাপ। সেটা ছিল বঙ্গাব্দের ১৩৫০। মনুষ্যসৃষ্ট পঞ্চাশের মন্বন্তরে বাংলার ৩০ লক্ষ মানুষ না-খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিল। বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধটাকে চার্চিল নিরীহ নিরপরাধ ভারতবাসীর বিরুদ্ধে গোপন যুদ্ধে রূপান্তরিত করেছিলেন। ভারত তার প্রতিশোধ নিয়েছিল স্বাধীনতার লড়াইটাকে দ্রুত শেষ করে। ভারতের সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার ৭৫ বছর আসন্ন। আর সেই গর্বের মুহূর্তের আগে ভারতজুড়ে মৃত্যুর মিছিল। শুধু শনিবারে একদিনে ২,৬২৪ জনের প্রাণ গিয়েছে। তার ফলে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১ লক্ষ ৯০ হাজার প্রায়। সম্প্রতি করোনায় এত সংখ্যক মৃত্যুর একটা বড় কারণ অক্সিজেনের অভাব। তীব্র সঙ্কট ভেন্টিলেটর, কিছু জরুরি ওষুধ এবং বেডের। অর্থাৎ চিকিৎসার অভাবেই মৃত্যুর মিছিল! স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এমন মর্মান্তিক পরিস্থিতি অভূতপূর্ব। শনিবার একদিনে করোনায় নতুনভাবে সংক্রামিত হয়েছেন নানা বয়সি প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ ভারতবাসী। সব মিলিয়ে সারা দেশে সক্রিয় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ২৬ লক্ষ। তার ফলে এ পর্যন্ত মোট সংক্রামিতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১ কোটি ৬৭ লক্ষ প্রায়। সংক্রমণ আর মৃত্যুর গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। এর শেষ কোথায় তা বোধহয় স্বয়ং ঈশ্বরেরও অজানা!
স্বভাবতই অনেকগুলি হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। শনিবার দিল্লি সরকার আদালতে দাবি করে যে, দৈনিক ৪৮০ মেট্রিক টন অক্সিজেনের জোগান জরুরি। না-হলে সেখানকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। কড়া অবস্থান নিয়ে কোর্ট তখন জানতে চায়, কার বাধায় অক্সিজেনের এই সঙ্কট। তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোরও হুমকি দেয় কোর্ট। কোর্টের আরও পর্যবেক্ষণ, করোনার সুনামি শুরু হয়েছে! জাতীয় রাজধানী শহরের প্রতিটি হাসপাতালের সামনে মর্মান্তিক দৃশ্য। গেট বন্ধ। সামনের রাস্তায় অথবা হাসপাতাল চত্বরে সারি দিয়ে রোগীরা শুয়ে। একটি সিলিন্ডার থেকে তিনটি পাইপ মারফত তিনজন রোগীকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। হাসপাতালের সামনে গাড়ির পিছনের সিটে রোগীরা শুয়ে দিনের পর দিন, বেড মেলার আশায়। নামী বেসরকারি হাসপাতালগুলিতেও অক্সিজেনের হাহাকার। একই কারণে ছোট হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলি একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভাবা যায়, এইমসের মতো জাতীয় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ইমার্জেন্সি বিভাগ একঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দিতে হয়েছিল শনিবার! অক্সিজেনের অভাবে সেখানেও রোগী ভর্তি কমানো হয়েছে।
ভারতই হল পৃথিবীর বৃহত্তম ভ্যাকসিন উৎপাদক দেশ। করোনা জব্দ করার জন্য একবছরেরও বেশি সময় পেয়েছে মোদির ভারত। তার পরেও ভারতবাসীকে অবর্ণনীয়, কল্পনার অতীত দুর্দশায় পড়তে হল। একদিকে অক্সিজেনসহ চিকিৎসার জরুরি জিনিসের সঙ্কট, অন্যদিকে অবাধে চলছে সেসবের কালোবাজারি। ভারত এক যন্ত্রণার নামান্তর হয়ে উঠেছে। দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াবার বার্তা দিয়েছে আমেরিকা, এমনকী চীন ও পাকিস্তানও। ভারত আজ সারা পৃথিবীর করুণার পাত্র। অথচ, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল ভারতের। তার যথষ্টে কারণও ছিল। মহান দাতার আসন থেকে ভারতকে এই যে সটান ভিখারির আসনে নেমে আসতে হল এর দায় স্বঘোষিত ভারতেশ্বর নরেন্দ্র মোদিকেই নিতে হবে। মিথ্যে আস্ফালনের ‘আত্মনির্ভর’ গলাবাজি ছেড়ে ভুবনায়নের বাস্তবের মাটিতে পা রাখুন মোদি। সরকারকে করে তুলুন মানবিক। অক্সিজেনসহ চিকিৎসার যাবতীয় জিনিসের সঙ্কট মোকাবিলায় দক্ষতার পরিচয় দিতে আরম্ভ করুন। প্রয়োজনে বিরোধীদের, বিশেষজ্ঞদের এবং বিদেশি সরকার ও সংস্থাগুলিরও সাহায্য নিন। সব মানুষকে বাঁচাবার থেকে বড় রাজধর্ম কিছু নেই। স্বাধীন ভারতও সেই রাজধর্ম পালনে ব্যর্থ হলে ইতিহাসে মোদির নেতৃত্বের ঠাঁই হবে বহু নিন্দিত চার্চিলেরই পাশে।