জন্মের সূচনা থেকেই কর্ণাটকের কুমারস্বামী সরকার অপুষ্টিতে ভুগেই চলেছে। বারবার মরতে মরতে সে বেঁচে উঠছে। ক্রমাগত রক্তাল্পতায় ভুগতে ভুগতে এই সরকার বেঁচে আছে। কাজ করার কোনও ক্ষমতাই তার আর অবশিষ্ট নেই। এখন শুধু তার মরার অপেক্ষা। সেই সময়টুকু জুড়ে তার তীব্র নাভিশ্বাস চলছে। আসলে সরকার গঠনের সময় থেকেই মুখ্যমন্ত্রী পদ-প্রত্যাশী কয়েকজনের উচ্চাশার কাঁটা বিছিয়ে আছে বর্তমান সরকারের পথ জুড়ে। একদিকে কুমারস্বামী। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। অন্যদিকে কংগ্রেসের সিদ্ধারামাইয়া, আবার ওঁৎ পেতে রয়েছেন বিজেপির ইয়েদুরাপ্পা। দুজনের দৃষ্টিই মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সির দিকে। গত এগারো মাস ধরে কর্ণাটকে চলছে কুমিরডাঙা খেলা। মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামীর তথৈবচ অবস্থা। জলে নামলে তাঁকে কুমিরে খাবে আর ডাঙায় থাকলে তাঁকে বাঘে খাবে।
গত কয়েকদিন ধরে অবস্থা চরমে উঠেছে। ছেলের সরকারকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া। সিংহাসন বাঁচাতে সফর কাটছাঁট করে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামী। ঘনঘন বৈঠক চলছে। ড্যামেজ কন্ট্রোল করার জন্য কংগ্রেস মাঠে নামিয়েছে তাদের বিশিষ্ট নেতা ডি কে শিবকুমারকে। কংগ্রেসের মধ্যেই দু’টি শিবির। একদল বিজেপির কাছে আত্মসমর্পণ করে ঢুকে পড়তে চায় তাদের শিবিরে, যাতে বিজেপি সহজেই কর্ণাটকে নতুন সরকার গড়তে পারে। আর একদল বর্তমান সরকারেই থাকতে চায়। তবে কয়েকটি শর্তে। কয়েকজন নিজের নাক কেটে কংগ্রেসের যাত্রাভঙ্গ করতে চান। তাঁরা চান সরকার পড়ে যায় পড়ে যাক, কিন্তু সিদ্ধারামাইয়া যাতে মুখ্যমন্ত্রী হন। এঁরা সব সিদ্ধারামাইয়া শিবিরের বিধায়ক। সিদ্ধারামাইয়া মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার বাসনাটি দীর্ঘদিন ধরে লালন করছেন। একদিক থেকে এই সঙ্কট তারই ফল। পাশাপাশি রয়েছে বিজেপির গোপন খেলাও। গত কয়েকদিনে একে একে মন্ত্রী, বিধায়করা পদত্যাগ করে বর্তমান সরকারকে ঠেলে দিয়েছে খাদের কিনারে। স্পিকারের কাছে সেইসব পদত্যগপত্র জমা পড়েছে। স্পিকার সেইসব পদত্যগপত্র গ্রহণ করলেই সংখ্যার বিচারে কুমারস্বামী সরকার পড়ে যাবে। দলত্যাগীদের অনেকেই এখন বিজেপির হেফাজতে। বেঙ্গালুরু থেকে তাঁদের উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মুম্বইয়ে। সেখানে তাঁদের জামাই আদরে রাখা হয়েছে। যে বিমানটি করে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেই বিমান কোম্পানির মালিক বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য রাজীব চন্দ্রশেখরের। এসব নিয়ে অভিযোগ উঠছে। বিজেপি কীভাবে সরকার ফেলায় মেতেছে তা নিয়ে রাজ্যের মানুষের মধ্যে তুমুল আলোচনা। আলোচনার মূল বিষয় হল এর পিছনে কত হাজার কোটি টাকার ডিল হয়েছে! বিজেপি কিন্তু নির্বিকার। তাঁরা এমন সব বিবৃতি দিচ্ছেন যাতে তাঁরা ভাজা মাছটি উল্টেও খেতে জানেন না। কিন্তু সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। এর আগেও এই স্টাইলে বিজেপি কয়েকটি রাজ্যে কম আসন সত্ত্বেও ক্ষমতা দখল করেছে। তাদের এই কৌশল এখন মানুষের কাছে খুবই চেনা। কিন্তু সরকারকে বাঁচাতে তৎপর কংগ্রেস এবং জেডি (এস)।
সঙ্কটের হাত থেকে বাঁচতে দেবেগৌড়া কংগ্রেস শিবিরের কাছে একটি প্রস্তাব রেখেছেন। সেটি হল, কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী হোক। সেক্ষেত্রে একটি শর্তে তাঁরা সেই সরকারকে সমর্থনে রাজি হবেন। মল্লিকার্জুন খাড়গে যদি মুখ্যমন্ত্রী হন, তবে তাঁরা সেই সরকারে থাকবেন নচেৎ নয়। খুব কৌশলী চাল, সিদ্ধারামাইয়ার স্বপ্নকে ভেঙে দিয়ে সরকার বাঁচানোর ফর্মুলা। কিন্তু এখন আর ওষুধে কাজ দেবে বলে মনে হয় না। বিষ এখন মাথায় উঠে গিয়েছে। বিধানসভার শক্তির লড়াইয়ে এখন পরোক্ষভাবে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে গেরুয়া শিবির। এখন বিধানসভায় মোট সদস্য সংখ্যা ২১০। অর্থাৎ আস্থায় জিততে গেলে যে কোনও দলের প্রয়োজন ১০৬ জনের সমর্থন। কিন্তু কংগ্রেস ও জেডি (এস) জোটের মোট শক্তি এখন ১০৪। বিজেপির ১০৫। একজন নির্দল এবং একজন বিএসপি সদস্য। আরো পদত্যাগের আশঙ্কা রয়েছে। কংগ্রেস ও জেডিএস শিবিরের একে একে নিভিছে দেউটি। বিজেপি শিবির উল্লসিত। এর মধ্যে দ্বিধা দ্বন্দ্বে জর্জরিত কুমারস্বামী। ক্রমেই অতলে তলিয়ে যাচ্ছে তাঁর ক্ষমতা। রাজ্যের মানুষের মনে প্রশ্ন কখন তিনি পদত্যাগ করবেন! সঙ্কটের এই সপ্তব্যূহ থেকে বোধহয় বেরিয়ে আসার তাঁর আর কোনও উপায় নেই। কর্ণাটকে জমে উঠেছে কিস্‌সা কুর্সিকা।