অনেক সময়ই আমরা পুকুর চুরি কথাটি বলি। পুকুর চুরি কথাটি আক্ষরিক অর্থেই সত্যি হয়ে দাঁড়াচ্ছিল বহু জায়গায় একশো দিনের কাজের ক্ষেত্রে। পুকুর না কেটে স্রেফ একটি গর্ত তৈরি করে খাতায় কলমে সেটাকেই পুকুর হিসেবে দেখানোর অভিযোগ অবশ্য নতুন কিছু নয়। এই কাজের জন্য কয়েক লক্ষ টাকা তুলে নেওয়া বা টাকা নয়ছয় করার অভিযোগটিও কম শোনা যায় না। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় একশো দিনের কাজে দুর্নীতির গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ বেশ কয়েক বছর ধরেই উঠছিল। আসলে এই কাজের প্রকল্পে দুর্নীতিতে একটি চক্র বেশ সক্রিয়। তাদের অসৎ উদ্দেশ্যের কারণে সত্যি বলতে কী বঞ্চিত হচ্ছেন একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি। যে-উদ্দেশ্যে সরকারি এই প্রকল্পটি চালু করা হয়েছিল সেটি যদি ব্যর্থ হয় তাহলে তা চালু রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এক্ষেত্রে সরকারি টাকা নয়ছয় তো হচ্ছেই অথচ ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না। অথচ সরকারি অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। এটা বন্ধ করা দরকার। এখন এই দুর্নীতি আটকাতে রাজ্য প্রশাসন বদ্ধপরিকর। একেবারে গরিব মানুষের জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাওয়ার সংস্থানটি করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বছরে একশো দিনের কাজ নিশ্চিত করার জন্যই সরকারি এই প্রকল্পটি চালু করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক যে সেই গরিব মানুষের রুটিরুজিতে থাবা বসাচ্ছে একটি অসাধু চক্র। কোথাও শ্রমিকের জবকার্ড প্রভাবশালীরা নিজেদের হেপাজতে রেখে দিচ্ছে, কোথাও-বা ভুয়ো মাস্টার রোল তৈরি করে লক্ষ লক্ষ টাকার প্রতারণা করছে, এই অভিযোগ তো আছেই। আবার পঞ্চায়েত এলাকায় বাগান তৈরির জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ বাগান না-করেই তুলে নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। কোথাও-বা খাতায় কলমে একশো দিনের কাজ করানো হয়েছে দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে একশো দিনের কাজের পুরো মজুরি না-দিয়ে তার থেকে টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ অনিয়ম হয়েছে নানা স্তরে। আশার কথা, এই একশো দিনের কাজে অনিয়ম ঠেকানোর জন্য রাজ্য প্রশাসন ইতিমধ্যেই কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। যেহেতু একেবারে গরিব মানুষ এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত তাই তাদের স্বার্থ যাতে রক্ষিত হয় তা দেখা যে-কোনও দায়িত্বশীল সরকারের কর্তব্য। সেই দায়িত্বপালনের লক্ষ্যেই এগচ্ছে মা-মাটি-মানুষের সরকার।
একশো দিনের কাজে দুর্নীতি হচ্ছে বা সরকারি টাকা নয়ছয় হচ্ছে বলে অভিযোগ থাকায় প্রথমবার মোদি সরকার ক্ষমতায় এসে এই প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেয়, যা নিয়ে শোরগোল পড়ে যায়। তবে, দ্বিতীয় দফায় এবার ক্ষমতায় এসে এই প্রকল্পের কাজে আরও গুরুত্ব দেওয়ার কথাই তারা বলেছে। রাজ্য সরকারও এই প্রকল্পে স্বচ্ছতা আনতে উদ্যোগী হয়েছে। রাজ্য প্রশাসন যে এ ব্যাপারে কড়া মনোভাব নিয়েছে তা আরও স্পষ্ট হয়েছে পঞ্চায়েত দপ্তরেরই নির্দেশে। পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে, ভুয়ো নথি তৈরি করে একশো দিনের কাজের টাকা হাতিয়ে নিলে এবার থেকে তা উদ্ধার করতে হবে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের। সেইসঙ্গে এই কাজের প্রকল্প নিয়ে কোনও অভিযোগ পাওয়া গেলে তড়িঘড়ি তদন্ত শুরু করা হবে। শুধু তাই নয়, অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্লকের আধিকারিকরা ‘গ্রাউন্ড জিরো’তে যাবেন এবং সেখানে গিয়ে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের সেই অর্থ উদ্ধার করতে বা ফেরত দিতে হবে। সুপারভাইজার থেকে নির্মাণসহায়ক সবার উপরেই এর দায় বর্তাবে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ গাউডলাইন মেনেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাজ করতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি আটকাতে কড়া অবস্থান নিয়েছেন। কাটমানি খাওয়া বা তছরুপের অভিযোগ সত্য প্রমাণ হলে কেউ যাতে পার পেয়ে না-যায় সেজন্য আইনগত পদক্ষেপেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সর্বস্তরের কাজেই দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান শুরু করেছে রাজ্য সরকার। সেক্ষেত্রে একশো দিনের কাজের প্রকল্পও ব্যতিক্রম হবে না। তাই ওই প্রকল্পের কাজেও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে উদ্যোগী হল রাজ্য সরকার। সেক্ষেত্রে ওই কাজের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল আধিকারিক বা সুপারভাইজারদের ভূমিকা নিঃসন্দেহে অনেকখানি। বিষয়টি স্মরণে রেখেই একশো দিনের কাজে ভুয়ো মাস্টাররোল হলে টাকা উদ্ধার করার দায়িত্বটি দেওয়া হয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাকে। এই গুরুদায়িত্বটি অর্পণ করে রাজ্য প্রশাসন একইসঙ্গে উচ্চ পদাধিকারীদের দায়িত্বশীল হওয়ার এবং দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার বার্তা দিয়েছে। ব্যবস্থাটি কার্যকর হলে একশো দিনের প্রকল্পের কাজের উপর নজরদারি যেমন বাড়বে তেমনি টাকা নয়ছয় বা অপব্যবহারের সুযোগও কমবে। সরকারি এই প্রকল্পের উদ্দেশ্যটিও সফল হবে।