খরচের চাপ এত বেশি থাকবে সে সঞ্চয় তেমন একটা হবে না। কর্মক্ষেত্রে নানান সমস্যা দেখা ... বিশদ
আমাদের দেখেই সাগ্রহে জানতে চাইলেন অ্যান্তলোনি। বছর বাইশের শিল্পীর হাতে পেন্সিল। সামনে ক্যানভাস। পাশে ফাঁকা টুল। ওই টুলে বসিয়ে মাত্র ৫ ডলারের বিনিময়ে অ্যান্তলোনি আগ্রহীদের মুখের ছবি আঁকেন। উল্টো দিকে সোনালি রঙা ডলবি থিয়েটার। রাস্তাজুড়ে ভিনদেশি পর্যটকের ভিড়। হাতে যে সময় নেই! অ্যান্তলোনির চটজলদি উত্তর, ‘পনেরো মিনিটে এঁকে দেবো।’ জাত শিল্পী বলে কথা। হলিউডের রাস্তায় তখন ভেসে আসছে জন ডেনভারের গানের সুর। ইউ ফিল আপ মাই সেন্সেস, লাইক আ নাইট ইন দ্য ফরেস্ট/ লাইক দ্য মাউন্টেন ইন স্প্রিং টাইম, লাইক এ ওয়াক ইন দ্য রেন...। নিক জোনসের সঙ্গে এই রাস্তাতেই নাকি হুল্লোড়ে মেতেছিলেন অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। কেট উইন্সলেট নাকি অস্কারের অনুষ্ঠানে এসে উল্টো ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যান্তালোনিদের দেখে হাত নাড়িয়েছিলেন। লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও, জুলিয়া রবার্টস, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, মেরিল স্ট্রিপ থেকে টম হ্যাঙ্কস— এই রাস্তাজুড়েই রয়েছে হলিউড তারকাদের কত গল্প।
রাস্তা মানে, হলিউড ওয়াক অব ফেম। সিনেমা জগতে অসামান্য অবদানকে স্মরণ করে রাখার জন্য হলিউড ওয়াক অব ফেমে কিংবদন্তি তারকাদের নাম খোদাই করে বসানো হয়। এগুলো তাদের অবদানের স্থায়ী স্বীকৃতি। হলিউড বুলভার্ডের ১৫টি ব্লক এবং ভাইন স্ট্রিটের ৩টি ব্লক মিলে এই ওয়াক অব ফেম। আড়াই হাজারের বেশি তারা বসানো রয়েছে হলিউড ওয়াক অব ফেমের মেঝে, দেওয়ালে। তারাগুলো পিতল এবং টেরাজো টাইলস দিয়ে তৈরি। মাইকেল জ্যাকসন, ড্যানিয়েল রেডক্লিফ, টম ক্রুজ, চার্লি চ্যাপলিন, আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার, ড্রু ব্যারিমোর, কেট উইন্সলেট, দ্য বিটলস, ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ, ওয়াল্ট ডিজনি, মহম্মদ আলিসহ আরও অনেক তারকার নাম খোদাই করা রয়েছে ওয়াক অব ফেমে। মিকি মাউস, স্নো হোয়াইট, ডোনাল্ড ডাক, উডি উডপেকার এরকম অনেক কাল্পনিক চরিত্রের নামও ফুটপাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামও। ফি বছর এই তল্লাটেই জমে ওঠে অস্কারের আসর। হলিউডের এই ডলবি থিয়েটার যেন হয়ে ওঠে স্বর্গরাজ্য। অধরা তারারা নেমে আসেন বাস্তবের মাটিদের। গ্ল্যামার কোশেন্টে পিছিয়ে থাকেন না কেউই। নিজেদের সেরাটাই উজাড় করে দেয় হলিউড। ডিজাইনার পোশাকে চোখ ধাঁধিয়ে দেয় বেভারলি হিলসের একের পর এক নামী দামী মুখ। দ্য বিগেস্ট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডস অন আর্থ। এক নামে যাকে গোটা বিশ্ব জানে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস বলে। চারদিকে সেই অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের রেপ্লিকার ঝলক।
লস এঞ্জেলেস শহর থেকে হলিউড যাওয়ার রাস্তায় পড়ে সানসেট বুলেভার্ড। ১৯১১ সালে এই সানসেট বুলেভার্ডে ছোট্ট একটি স্টুডিও নির্মাণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় হলিউড সিনেমার যাত্রা। হলিউড অভিনেত্রী নরমা ডেসমন্ড-এর কল্পিত কাহিনী নিয়ে ১৯৫০ সালে নির্মিত হয়েছিল সানসেট বুলেভার্ড নামে সিনেমাটি। নরমার ভূমিকায় গ্লোরিয়া সোয়ানসন-এর অসামান্য অভিনয়ে এটি আমেরিকার সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটি। তারপর থেকে হলিউড নামটিকে বিশ্বের দরবারে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি আর। কালক্রমে চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলা-কুশলী সবাই এসে ভিড় করেছে এখানে। নামীদামী হোটেল কিংবা বার, বিশাল ব্যয়বহুল মুভি সেটে আজ পরিপূর্ণ হলিউড। আগের শতাব্দীর দুইয়ের দশকের পরের ২০ বছর পরিকাঠামোগতভাবে হলিউড এগিয়েছে তরতর করে। সেই বুলভার্ড অব হলিউডের দুই পাশে এখন বড় বড় পাম গাছ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সম্ভাষণ জানায় প্রত্যেক আগন্তুককে। যাদের চোখে মুখে রয়েছে রঙিন স্বপ্ন। প্রতি সপ্তাহে গড়ে শুধু ৪ কোটি আমেরিকান নাগরিকই ছুটে যায় হলিউডের থিয়েটারগুলোর টানে। সেই জরাজীর্ণ হলিউড আজ স্বপ্নের আঁতুড়ঘর।
যেখানে মূল আকর্ষণ অবশ্যই ডলবি থিয়েটার। ২০১২ সালে ইস্টম্যান কোডাক কোম্পানি যখন দেউলিয়া ঘোষণা করে, তার তিন মাসের মাথায় ডলবি ল্যাব ইস্টম্যানের কাছ থেকে এই থিয়েটারের মালিকানা গ্রহণ করে। সেই থেকে কোডাকের বদলে ডলবি। চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বনেদি পুরস্কারের আসর বসে এই ভবনেই। সে যেন চাঁদের হাট। হাজির হন বিশ্বের নানা প্রান্তের চলচ্চিত্র বোদ্ধা থেকে শুরু করে তারকা শিল্পীরা। অতিথিদের জন্য ৩ হাজার ৪০০টি আসনের পাশাপাশি মিলনায়তনের যে কোনও স্থান থেকে বক্তার কথা সব জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য ডলবি থিয়েটারে রয়েছে ২০০টি স্পিকার। এছাড়া ছবি দেখার জন্য ৬০ গুণ ৩২ ফুটের দৈত্যাকার স্ক্রিন তো রয়েছেই। শব্দের খোঁজখবর যারা জানেন, তারা বোধ হয় ওয়াকিবহাল— অস্কারের সাউন্ড সবসময় হয় স্টেরিও, নয়তো মনো টাইপের।
২৫ ডলার খরচ করলেই ডলবি থিয়েটারের গাইড আপনাকে চেনাবেন হলিউডের আদ্যপ্রান্ত। কত ইতিহাস। এই ভবন থেকেই চোখে পড়বে দূরে পাহাড়ের কোলে হলিউড সাইন। সাইনটি হলিউডকে পরিচিতি এনে দিয়েছে সারা পৃথিবীতে। মাউন্ট লির শীর্ষে অবস্থিত যে সাইনটি দেখলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে হলিউড চলচ্চিত্রের চোখ ধাঁধানো কোনও অ্যাকশন বা লাস্যময়ী কোনও অভিনেত্রীর মিষ্টি চেহারা কিংবা কোনও হার্টথ্রব নায়কের নাম। কিন্তু নজর কাড়া এই সাইনবোর্ডের পিছনেও রয়েছে লম্বা ইতিহাস। রয়েছে শত সহস্র মানুষের পরিশ্রম, রয়েছে আত্মত্যাগ। গাইড শোনাবেন সেই ইতিহাসও।
ইতিহাস তো সঙ্গে নিয়েই এসেছি! ১৯২০ সালের গোড়ার দিকে ‘দ্য লস এঞ্জেলেস টাইমস’ পত্রিকার মালিক হ্যারি চ্যান্ডলার কয়েকজন ধনী ব্যবসায়ীকে নিয়ে প্রোমোটিং ব্যবসায় নেমেছিলেন। ব্যবসায়ী গ্রুপটি মাউন্ট লির পাদদেশে বিপুল পরিমাণে জায়গা কিনে বাড়ি তৈরির কাজে হাত দেয়। প্রকল্পের নামকরণ করা হয় ‘হলিউড ল্যান্ড’। নিজেদের কোম্পানির নামকে অক্ষয় ও ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় করতে বেশ জমকালো একটি সাইনবোর্ড তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানিটি। ওই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ১৯২৩ সালে বিখ্যাত ডিজাইনার থমাস ফিস্কের ডিজাইনকৃত হলিউড ল্যান্ড লেখা ১৩ অক্ষরের সাইনবোর্ড তৈরি করে পাহাড়ের শীর্ষে স্থাপন করা হয়। মাত্র বছর দুয়েকের জন্য স্থাপন করা হলেও সাইনবোর্ডটি আর সরানো হয়নি। গ্রিফিথ পার্কের মাউন্ট লি নামে পাহাড়ের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত এই সাইনবোর্ডটির প্রতিটি অক্ষরের উচ্চতা ৪৫ ফুট অর্থাৎ ছয়তলা উঁচু দালানের সমান এবং প্রস্থ ৩১ থেকে ৩৯ ফুট। রাতের বেলায়ও এটি যাতে দিনের মতো স্পষ্ট দেখায় সেজন্য ৪ হাজার বৈদ্যুতিক আলো লাগানো আছে!
শুনলে অবাক হবেন, একসময় হলিউড সাইনটিকে অপয়া হিসেবে বিবেচনা করা হতো। অবশ্য এর পিছনে কিছু কারণও ছিল। ১৯৩২ সালে হলিউড অভিনেত্রী ‘পেগ এন্টউইসটল’ হলিউডের এইচ অক্ষরের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। এরপর ১৯৪০ সালে ওই সাইনের কেয়ারটেকার আলবার্ট কোথ পাহাড়ের উপর দিয়ে গাড়ি চালানোর সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওই এইচ অক্ষরের উপরই পড়েছিলেন। ওই দুর্ঘটনায় কোথ বেঁচে গেলেও এইচ অক্ষরটি দুমড়ে মুচড়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল অনেকদিন। ১৯৪৯ সালে হলিউড চেম্বার অব কমার্স ‘ল্যান্ড’ শব্দটি বাদ দিয়ে এটিকে হলিউড সাইন হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যেগ নেয়। কাঠ এবং টিনের শিট দিয়ে তৈরি করা হয় সাইনটি। তবে অল্পদিনেই হলির ‘ও’ অক্ষরটি ভেঙে ইউ আকার ধারণ করে এবং ‘উড’-এর একটা ‘ও’ গায়েব হয়ে যায়। ১৯৭৮ সালে হলিউড চেম্বার মোটা অঙ্কের ডলার খরচ করে অস্ট্রেলিয়া থেকে স্টিল শিট এনে সাইনটি নতুন করে স্থাপনের কাজ শুরু করে। আর ওই বছর ১৪ নভেম্বর হলিউডের ৭৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে হলিউড সাইন উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে উদ্বোধনের কয়েকদিন পরেই একজন স্কুল ছাত্রী এর উপর থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। এরপর থেকে সাইনটির কাছে যাওয়া একেবারেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একসময় এক প্রোমোটিং কোম্পানি ঘরবাড়ি নির্মাণসহ এলাকা উন্নয়নের নামে বিশ্বখ্যাত হলিউড সাইন সরিয়ে ফেলারও পরিকল্পনা করে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বব্যাপী আমেরিকার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিত্ব করা হলিউড সাইনটি রক্ষার জন্য স্থানীয়রা উদ্যোগ গ্রহণ নেন। জায়গাটি কিনে নেওয়ার জন্য ‘দ্যা ট্রাস্ট ফর পাবলিক ল্যান্ড’ নামে একটি ফান্ড গঠন করা হয়।
অভিনেতা ও ক্যালিফোর্নিয়ার তৎকালীন গভর্নর আর্নল্ড শোয়ার্জনিগারের উদ্যোগে আমেরিকার পঞ্চাশটি রাজ্য ও কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্র থেকে সাহায্য আসে। চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত শিল্পী এবং কলাকুশলীসহ হাজারো মানুষ এই সাইন রক্ষায় মাঠে নামেন। ওই সময় বিশ্বখ্যাত প্লেবয় ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা হিউ হেফনার এককভাবে ৯ লাখ ডলার অনুদান দেন। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে ১ কোটি ২৫ লাখ ডলারের সংস্থান করে ১৩৮ একর ভূমি রক্ষা করা হয়। একই সঙ্গে আগামী পৃথিবীর জন্যই রক্ষা করা হয় হলিউড সাইন। হলিউড সাইন এখন হলিউডের নিজস্ব সম্পত্তি। এখানে ঘর বাড়ি করার জন্য আর কোনও প্রোমোটিং কোম্পানি ছুটে আসে না।
লস অ্যাঞ্জেলস আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। বিশ্বের এই সৃজনশীল শহর লস অ্যাঞ্জেলেসে আছে বিশ্ববিখ্যাত হলিউড, আছে ডিজনিল্যান্ড, আছে অস্কার আয়োজনকারী ডলবি থিয়েটার, ইউনিভার্সাল স্টুডিওসহ নামকরা আর সব স্টুডিও। রয়েছে মাদাম তুসো মিউজিয়ামও। সবার উপরে আছে মন মাতানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর অনন্য প্রশান্ত মহাসাগর। এখানকার নাগরিকদের প্রতি ছ’জনের একজন কোনও না কোনও সৃষ্টিশীল প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গোটা মানব সভ্যতার ইতিহাসে পৃথিবীর আর কোনও শহরে একসঙ্গে এত বেশি শিল্পী-লেখক-নির্মাতা বসবাস করেনি। তবে, অন্য আরেকটা ব্যাপার তারা বলতে ভুলে গিয়েছে। আমেরিকার ইতিহাসে অন্য আর কোনও শহরে একসঙ্গে এত বেশি ট্র্যাফিক জ্যামও সৃষ্টি হয়নি। ট্র্যাফিক জ্যামের জন্য গোটা আমেরিকায় কুখ্যাত এই শহর। তবুও এত এত দর্শনীয় জিনিস এই শহরে। কোনটা রেখে কোনটা দেখবেন!
ধরুন ডলবি থিয়েটার লাগোয়া মার্শাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কথাই। ঠিকানা ৭০১৩ হলিউড বুলেভার্ড। ৮৯তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস পাওয়া ‘লা লা ল্যান্ড’-এর নামেই এই স্টোরের নাম। যেখানে রয়েছে এলভিস প্রেসলির বিখ্যাত সেই আকাশি রঙের ক্যাডিল্যাক গাড়িটি। গোটা স্টোর জুড়েই হলিউডের নানা রেপ্লিকা। কিন্তু এই বিশাল স্টোরের নাম কেন ‘লা লা ল্যান্ড’ বেছে নেওয়া হয়েছে জানেন? আসলে লা লা ল্যান্ড মানেই লস অ্যাঞ্জেলেস। লা লা ল্যান্ড মানেই হলিউড। আবার লা লা ল্যান্ড মানে এমন একটা জায়গা, যেখানে রোজ শ’য়ে শ’য়ে মানুষ আকাশকুসুম স্বপ্ন নিয়ে আসেন। এই সিনেমা স্বপ্ন দেখতে শেখা আর স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখা নিয়ে। বিষণ্ণ সময়ে ‘লা লা ল্যান্ড’ আশার আলো দেখায়। হলিউডের আড়ম্বরকে ফের ভালবাসতে শেখায়। বলেছিলেন মার্শাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কর্মী এমা ক্যালম্যান।