উচ্চতর বিদ্যায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় আগ্রহ বাড়বে। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতে আনন্দলাভ হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ... বিশদ
যাত্রার দুরন্ত অভিনেতা শেখর গঙ্গোপাধ্যায় আপন প্রতিভায় একটি নিজস্ব ধারা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু দেখা যায় যে উচ্চতায় তিনি আরোহণ করতে পারতেন, সেই শিখরে তিনি পৌঁছতে পারেননি। তিনি যেন শেক্সপিয়ারিয়ান ট্রাজেডির একটি চরিত্র। একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে তাঁর পরিণতি হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি নিজেই ছিলেন বিয়োগান্তক জীবননাট্যের এক হতভাগ্য চরিত্র। অথচ অভিনয়ের যে সমৃদ্ধ ইতিহাস তিনি নিজে তৈরি করে গিয়েছেন, তা অনেকদিন অমর হয়ে থাকবে। শেখর গঙ্গোপাধ্যায় মানে আধুনিক যাত্রার রূপকথার এক নায়ক।
বহরমপুরের একটি সিনেমা হলের কর্মী ছিলেন তিনি। স্ত্রী-কন্যা নিয়ে ছিল তাঁর ভরা সংসার। মনের ভিতর তখন অভিনয়ের অদম্য বাসনা। তাই মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বীরভূম, বর্ধমানের বিভিন্ন অঞ্চলে অ্যামেচার দলে অভিনয় করতেন। সেই সময় তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন শোয়ে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতেন বীরভূমের খয়রাশোলের শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী। আসল নাম তাঁর নমিতা চক্রবর্তী।
বহরমপুরে যাত্রার শো করতে গিয়েছিলেন পঞ্চু সেন। সেখানে তাঁর নজরে পড়ে যান শেখরবাবু। তাঁর ডাকেই কলকাতার চিৎপুরে পেশাদার দলে যোগদান। তবে থাকতে পারেননি। কয়েক মাস অভিনয় করে দল ছেড়ে চলে যান। পরে আবার ফিরে এলেন। যাত্রা গবেষক দিবাকর ভৌমিক তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘শেখর গঙ্গোপাধ্যায় স্থায়ীভাবে চিৎপুরে এসেছিলেন ১৯৬৪ সালে। ধৃতিশ্রী নাট্য শিল্পমে। সেবার ওই দলের পালা ছিল ব্রজেন্দ্র কুমার দে’র ‘চাঁদের মেয়ে’, ‘নিষিদ্ধ ফল’, ‘শেষ নমাজ’ এবং বিজয় কুমার ঘোষের ‘মধুমতী’। এর কিছু ছিল পুরনো পালা, কিছু ছিল নতুন পালা। সব পালায় তিনি নায়ক হিসাবেই অভিনয় করেছিলেন। সেই দলে ছিলেন পঞ্চু সেন, দেবেন বন্দ্যোপাধ্যায়, গায়ক তিনকড়ি ভট্টাচার্য। নায়িকা ছিলেন শতদল রানি, ক্ষিতীশ রানি। তার পরের বছর তিনি নট্ট কোম্পানিতে যান। সেখানে দু’ বছর ছিলেন। নট্টয় তিনি ‘বিল্বমঙ্গল’ করলেন। সেই পালায় তাঁর চরিত্র ছিল স্বামী সনাতন ঠাকুর।’
পরে আবার তিনি ফিরে এসেছিলেন নট্টতে। ১৯৭৯ সাল। সেবার অরুণ দাশগুপ্ত, বীণা দাশগুপ্তর সঙ্গে কিছুটা মতানৈক্য হল মাখনলাল নট্টের। বীণার থেকে বেলা সরকারের চরিত্র বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই অরুণ-বীণা বেরিয়ে আসার পর শেখরবাবু গেলেন নট্ট কোম্পানিতে। সেবার সাড়া ফেলে দিল ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের পালা ‘ময়লা কাগজ’। নট্টয় পরপর কয়েক বছর হল ‘কাগজের ফুল’, ‘গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম’, ‘কুবেরের পাশা’, ‘রাত্রির তপস্যা’ ইত্যাদি। তবে কয়েক বছর পর মাখনবাবুর সঙ্গে আইনি জটিলতায় জড়িয়ে গেলেন শেখরবাবু। এ ব্যাপারে নট্ট কোম্পানির তরফে উত্তম নট্ট বলেছেন, ‘শেখরবাবু নট্ট কোম্পানি ছাড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সেই সিজনের কন্ট্রাক্ট ছিল। তাছাড়া এমন সময় তিনি দল ছাড়তে চাইলেন যখন চিৎপুরে দল গড়া হয়ে গিয়েছে। বায়নাও অনেক হয়ে গিয়েছে। তাই আদালতেই বিষয়টির মীমাংসা হল। তখন ‘দেবী সুলতানা’ পালার রিহার্সাল শেষের পথে। নির্দেশনায় ছিলেন মহেন্দ্র গুপ্ত। ততদিনে প্রধান চরিত্র মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমিকায় তৈরি হয়ে গিয়েছিলেন তরুণকুমার। তাই শেখরবাবুকে তুলনায় কিছুটা কম প্রভাবের একটা চরিত্র আলিবর্দি খাঁ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যেই তিনি নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন। সেই পালায় তাঁর মুখে একটি সংলাপ ছিল। সেটা হল— মসনদ তুমি কার? তখন সেটা মানুষের মুখে মুখে ফিরত।’
পঞ্চু সেনের সঙ্গে অনেকদিন অভিনয় করেছেন। শিখেছেনও অনেক কিছু। আবার একদিন পঞ্চুবাবুর সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্যও হয়। পঞ্চুবাবু ‘শেষ নমাজ’ পালায় একটি শোয়ে সময়মতো অভিনয়ের আসরে পৌঁছতে পারেননি। তার আগের দিনের শোয়ে সেই আসরে বড় ফণী না আসায় প্যান্ডেলে ভাঙচুর হয়েছিল। তাই দল মালিকের সিদ্ধান্তে পঞ্চুবাবুর অনুপস্থিতিতে সেদিন দায়ুদ খাঁর চরিত্রটি করেছিলেন শেখরবাবু। তখন তিনি করতেন মোবারক চরিত্র। সেকথা শুনে পঞ্চুবাবু আর সেই দলে অভিনয় করেননি।
কিন্তু যেদিন থেকে উৎপল দত্তের নজরে পড়ে গেলেন, সেদিন থেকে শেখর গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিনয়ে ধারা অনেটাই বাঁধুনি পেল। যেমন দম, তেমন গলা, তেমনই মডিউলেশন। অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতেন চরিত্রকে। সেটিকে সুন্দরভাবে ব্যবহার করলেন উৎপল দত্ত। তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ লোকনাট্যে। ১৯৭০ সালে পালা ছিল ‘দিল্লি চলো’ এবং ‘সমুদ্রশাসন’। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের একটি অধ্যায় নিয়ে ‘দিল্লি চলো’ পালাটি রচিত। এই পালায় গেরিলা প্রদ্যোৎ মজুমদারের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করলেন শেখর গঙ্গোপাধ্যায়। ‘সমুদ্রশাসন’ও উৎপল দত্তের। সেই নাটকে শেখরবাবুর চরিত্র ছিল সমুদ্রগুপ্ত। ‘দিল্লি চলো’ পালায় একটি শিশু চরিত্র মাতুংয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রুনু অধিকারী। আজ তিনি প্রবীণ। তাঁর মুখেই শুনেছিলাম সেই সব অভিনয়ের কথা, তাঁর জীবনের কথা।
যাত্রা বিশেষজ্ঞ প্রভাত কুমার দাস বলেছিলেন, ‘লোকনাট্যে উৎপল দত্তের সংস্পর্শে আসার পর থেকেই তাঁর ক্ষমতার পূর্ণ প্রকাশ। ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’ পালায় তিনি রামানন্দের ভূমিকায় স্মরণীয় অভিনয় করেছিলেন। তাতে একটা হাসি ব্যবহার করেছিলেন, সেটা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তারপর থেকে বহু পালায় তিনি সেই হাসি ব্যবহার করতেন। সেটা হয়ে উঠেছিল তাঁর সিগনেচার। পরে পরিচালনায় এলে তিনি উৎপল দত্তের ঘরানাকেই অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু তা সেভাবে পূর্ণতা পায়নি। অভিনেতা শেখরবাবুকেই মানুষ মনে রাখবে।
মানুষও মনে রেখেছে তাঁর অভিনীত ‘ঝড়’, ‘জানোয়ার’, ‘সরমা’, ‘গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম’, ‘পাণ্ডবজননী কুন্তী’র মতো অমর পালাগুলির কথা।
শেখরবাবু এবং শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী কিছুদিন জুটি বেঁধেছিলেন। শর্মিষ্ঠাকে যাত্রায় আনেন শেখরবাবুই। সত্যম্বর অপেরায় দুজনে অভিনয় করলেন ভৈরববাবুর ‘কান্না-ঘাম-রক্ত’ পালায়। তারপরে দুজনে গেলেন নব রঞ্জন অপেরায় সেখানে করলেন উৎপল দত্তের ‘ফেরারী ফৌজ’ এবং তারপরে অগ্রগামীতে করলেন ‘কালো তলোয়ার’।
শেখরবাবু নাট্যতীর্থ নামে একটি দলও তৈরি করেছিলেন। ওই দলের পালা ছিল কানাই নাথের ‘শের-ই বাহাদুর শাহ’। সেই সময় ওঁর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছিলেন, ওঁর অভিনয়ের এমন তেজ ছিল যে আমরা তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে অভিনয় করতে পারতাম না। অবাক হয়ে ভাবতাম, একজন মানুষ কী করে এমন দাপটের সঙ্গে অভিনয় করতে পারেন।
বর্ণালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি শেখরবাবু সম্পর্কে আলাদা একটা শ্রদ্ধা। বলেছিলেন, ‘উনি যত বড় অভিনেতা, তত বড় মানুষ। তবে পরিণতিটা খুবই দুঃখজনক। মঞ্চে যাঁর অমন দাপট, তিনি ব্যক্তিগত জীবনে একটু শান্তি খুঁজতেন।’ এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাননি তিনি। কিন্তু যাঁরা যাত্রা জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা জানেন শেষ পর্যন্ত কী পরিণতি হয়েছিল তাঁর। ধাক্কা খেতে খেতে আত্মবিশ্বাসটা মরে গিয়েছেল। একটা ভীতু মানুষের মতো। নিজের দলের উপরও কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সব ডুবে গেল। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন দলের গদিঘরে গিয়ে বলতেন, ‘আমাকে একটা কাজ দেবে?’ সেই ক্ষয়ে যাওয়া মানুষটাকে সেদিন কেউ নিতে চাইত না। বিভিন্ন অ্যামেচার দলে ঘুরে ঘুরে কয়েকটা টাকার বিনিময়ে অভিনয় করতেন।
প্রেম বহুমুখী। তা কখনও সুখ আনে, কখনও দুঃখ। বহুদিনের অভিনয়ের সঙ্গী শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই প্রণয় থেকেই শর্মিষ্ঠার মধ্যে শেখর-শাসনের অধিকার জন্মায়। কিন্তু তার ফল ভালো হয়নি। তার থেকেই সম্পর্কে এল অবিশ্বাস, সৃষ্টি হল দূরত্ব। এক সময় তা হয়ে দাঁড়াল ভাঙাহাটের সম্পর্ক।
রুনু অধিকারীর মুখেই শুনেছি, ‘মানুষ হিসাবে তিনি ছিলেন বড় মনের। পরে একদিন বাসে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কামারপুকুরের একটি যাত্রা দলে তখন শেখরকাকু অ্যামেচার শো করেন। আমাকে চিনতে পেরেছিলেন। কথায় কথায় আমাকে অনেক কষ্টের কথা বলেছিলেন। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এমন মানুষের এ কী পরিণতি! তখন আর তিনি কলকাতার বাড়ি ফিরতেন না। মনের কষ্ট নিয়ে পড়ে থাকতেন কামারপুকুরেই। একেই কলকাতায় তখন কাজ জোটে না। এছাড়া কলকাতা থেকে দূরে থাকতে গ্রামবাংলার অ্যামেচার দলে তিনি কাজ খুঁজতেন।’
সেই দাপুটে অভিনেতাকে অনেকেই চিৎপুরের পাড়ায় পাড়ায় নোংরা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। মঞ্চকাঁপানো এক অভিনেতার এই পরিণতি অনেকের চোখেই জল এনেছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন ‘গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম’। মনে পড়ে যায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের সেই বিখ্যাত পংক্তি, ‘যৌবনে অন্যায় ব্যয়ে বয়সে কাঙালী।’