বিশেষ নিবন্ধ

৪ জুন যে সব প্রশ্নের উত্তর মেলাতে হবে
হিমাংশু সিংহ

২০১৬, ২০২১ এবং ২০২৪। বিজেপি, কংগ্রেস ও সিপিএমের মুখে ছাই দিয়ে এবারও তৃণমূল কংগ্রেস জয়ের হ্যাটট্রিক করলে কী বলবেন? বিগত আড়াই বছর ধরে চলা যাবতীয় নেগেটিভ প্রচার, অবিরাম কুৎসাকে ব্যর্থ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার এই লোকসভা ভোটেও বিরোধীদের তেমন কোনও জায়গা দিল না। গ্রাম বাংলার রায় মমতার পক্ষেই অনেকটা ভারী, ইঙ্গিত এমনই। মঙ্গলবার শুধু তা মিলিয়ে নেওয়ার পালা। একুশের রিপিট টেলিকাস্ট হলে বিরোধীরা সেদিন মুখ লুকোবেন কোন অতল গর্তে!
ভোট প্রচার শুরুর আগে থেকেই বলা হচ্ছিল, দুর্নীতির অভিযোগ নাকি খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দেবে তৃণমূলকে। অলক্ষ্যে ভগবান শুধু হেসেছেন। কারণ এমন চ্যালেঞ্জ, এমন যুযুধান লড়াইয়ের মুহূর্ত মমতার জীবনে অনেক এসেছে। বারবারই তিনি ফিনিক্স পাখির মতো ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। সব হিসেব উল্টে দিয়েছেন। আর এবার ফল বেরনোর ৪৮ ঘণ্টা আগে কার্যত প্রমাদ গুনছে বঙ্গ বিজেপি। হারের চেয়েও বড় ভয়, দিল্লিতে পাঠানো ফোলানো ফাঁপানো রিপোর্ট ভুল হলে উপরতলার নেতাদের কান মলে চাকরি খেয়ে নেবেন অমিত শাহরা। কারণ উনিশ সালের কাসুন্দি চটকে ১৮টি আসন জেতাও এবার তাদের কাছে প্রায় অসম্ভব। শেষে যদি দশের নীচে নেমে যায়? প্রধানমন্ত্রীর জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি এবারও ব্যর্থ। বরং ভোট শেষের বুথ ফেরত সমীক্ষাকে পিছনে ফেলে বাস্তবে তৃণমূলের আসন সংখ্যা ২২ থেকে বেড়ে ৩০’এর আক্রা পার করে কি না, নজরটা এখন সেই দিকেই। একুশের পর এবারও যাবতীয় সমীক্ষা ও এক্সিট পোলকে ভুল প্রমাণ করে, বাংলার জননেত্রী সিংহভাগ আসনে জয়ী হলে, তাঁর জীবদ্দশায় তৃণমূলের দিকে আঙুল তোলার মুরোদ ও হিম্মত আর দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের নেতানেত্রীদের থাকবে বলে মনে হয় না। নাকি দু’কান কাটারা পরের দিন থেকেই আবার নেমে পড়বেন নেতা কেনাবেচার কর্দমাক্ত বাজারে, এজেন্সি লেলিয়ে দিয়ে। আর দার্শনিক আলিমুদ্দিন অস্ফুটে বলবে, শূন্য ছাড়া পুণ্য কই! তার উপর যদি কেন্দ্রে সরকার গড়তে হোঁচট খেতে হয় মোদি ব্রিগেডকে, তাহলে বলতেই হবে সোনায় সোহাগা। অন্তত বিরোধীদের টুঁটি চেপে ধরার ইডি, সিবিআই দৌরাত্ম্য থমকে যাবেই। প্রমাণ হয়ে যাবে সংগঠন না গড়ে শুধু গাঁয়ের নেতা কিনে তাঁকে সাজিয়ে গুছিয়ে বাঘের পিঠে চড়িয়ে দৌড় করালেই ভোটে জেতা যায় না।
সত্যটা এই, বোফর্সের পর ভারতীয় রাজনীতি আর কোনও দুর্নীতি ঘিরে উত্তাল হয়নি। সরকারও পড়েনি। হ্যাঁ, আলোচনা হয়েছে। হইচইও হয়েছে। কিছুদিন সংবাদপত্রের খোরাক হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনকে সেভাবে আর প্রভাবিত করেনি। চোদ্দো সালে মনমোহন সরকারের পতনের পিছনেও দুর্নীতি মূল কারণ ছিল না। প্রধান কারণ ছিল সরকারের শেষদিকে অতিমাত্রায় নীতি পঙ্গুতা। পলিসি প্যারালিসিস। এবং মূল্যবৃদ্ধি। বত্রিশভাজা ইউপিএ-র বারো ঘর এক উঠোনের শ্লথতার বিপক্ষে মোদিজির ধূমকেতুসম উত্থান। টু-জি, কয়লা ব্লক বণ্টন দুর্নীতি নিয়ে সংসদ তোলপাড় হলেও ভোটে নির্ণায়ক হতে পারেনি। বাংলায় এবারও মমতার হাজার যোজন এগিয়ে থাকার প্রধান কারণ তাঁর সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরিসীম ক্ষমতা, যার জুড়ি আজও বঙ্গ রাজনীতিতে নেই। জাতীয় স্তরের বিরোধী পরিসরেও চার দশক পেরিয়েও তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শহুরে প্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্তের একটা অংশ সামান্য রুষ্ট হলেও গ্রামে যে বাড়িতে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বিধবা ও বার্ধক্য ভাতা থেকে তিন-চার হাজার টাকা ঢোকে তাঁরা কিছুতেই মমতা সরকারের গ্যারান্টি ছেড়ে গুজরাতি মোদির আজগুবি ধাঁধার পিছনে ছুটবেন না। গ্রামের গরিব মানুষের কাছে মাসে মাসে নগদ টাকা পাওয়ার চেয়ে বড় গ্যারান্টি আর কিছু হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী গত কয়েক মাসে যে সব গ্যারান্টি দিয়েছেন, তার মধ্যে কতগুলি বিশ্বাসযোগ্য? একটিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী সূর্যঘর যোজনার সৌজন্যে আপনার বিদ্যুৎ বিল হবে শূন্য। কেউ এটা বিশ্বাস করবে, আমাদের জীবদ্দশায় হবে? যাদের প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল বাবদ কয়েক হাজার টাকা দিতে হয়, তাদের বিল কোন জাদুতে শূন্য হবে? বলেছেন, ভারতকে প্রধান উৎপাদক দেশ হিসেবে গড়ে তুলে যুবাদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা হবে। বলি, গত দশ বছরে কতজনকে কাজ দিয়েছেন? মেক ইন ইন্ডিয়া ক্যাম্পেন তো ডাহা ফ্লপ! বছরে দু’কোটি চাকরি ভুলে যান, কেন্দ্রীয় সরকারের ৩০ লক্ষ শূন্যপদে কি চাকরি দেওয়া যেত না? কেন দেশে সাড়ে চার দশকের মধ্যে রেকর্ড বেকারত্ব? এর সঙ্গে মিশেছে মূল্যবৃদ্ধির ছেঁকায় সারা শরীরে কালসিটে ফোস্কার সঙ্গে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ভাগাভাগির আকণ্ঠ বিষ। খুলে আম সভায় দাঁড়িয়ে সেই বিষ ছড়িয়েছেন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী। এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?
আমরা সবাই জানি, বাকি ৪৮ ঘণ্টা তীব্র উৎকণ্ঠার। বিরোধীদের কারা ‘মুজরো’ করবে আর ত্রিশঙ্কু হলে ঘোড়া কেনাবেচায় কাদের ‘নথভাঙা’ পর্ব শুরু হবে, সব জল্পনার অবসান মঙ্গলবার দুপুরেই হয়ে যাবে। না ভুল বললাম, নতুন নৌটঙ্কি শুরু হবে বিজেপির সৌজন্যে। এখন থেকেই যেন একটা অনিশ্চয়তা পেয়ে বসেছে গেরুয়া থিঙ্কট্যাঙ্কদের। বাণিজ্যনগরী মুম্বইও সেই পথের পথিক। একপেশে বাজারে হঠাৎ যেন এলোমেলো দমকা হাওয়া। ইন্ডিয়া জোটের পক্ষেও বাজি ধরতে শুরু করেছে সাট্টা বাজার। কেউ কেউ এতদিন তেমন আমল না দিলেও সবুরে মেওয়া ফলতে দেখছে বিরোধী জোটের। আর শাসকের অন্দরেরও ধুকধুকানি তো দু’দফার ভোটের পর থেকেই চলছে। সবাইকে চমকে দিয়ে ভোটের হার অত্যন্ত কম এবং মহিলা ভোট বেশি পড়ায় সিঁদুরে মেঘ দেখছে বিজেপি। ৪০০ নয়, গতবারের ৩০৩ আসনও নয়, ২৭২ থেকে কতটা দূরে মোদিজির ফিকে হয়ে যাওয়া উন্নয়নের রকেট বা হাউই এসে গোত্তা খেয়ে পড়বে, সেই হিসেব কষা শুরু হয়ে গিয়েছে। ২৪০ হলে একরকম, ২৬০ হলে অন্যরকম, আবার ২১০ হলে আর এক রকম। বালাই ষাট, যদি বিজেপির প্রাপ্ত আসন দু’শোর নীচে যায়? তবে যাই হোক, নির্বাচনী পণ্ডিত থেকে ভক্তকুল একবাক্যে স্বীকার করছেন, এবারের নির্বাচনে কোনও মোদি ওয়েভ, কোনও গেরুয়া হাওয়া কাজ করেনি। কাজ করেনি বালাকোট, পুলওয়ামার স্মৃতিও। গত ২২ জানুয়ারি ৫০০ বছর পর রামকে পাক্কা ঘর দেওয়ার ন্যারেটিভও ডিভিডেন্ড দেয়নি। ফানুসের মতো উড়ে গিয়েছে 
আব কি বার ৪০০ পারের গল্পও। দু’শো নয়, হাজার নয়, লক্ষ লক্ষ গ্যারান্টি মানুষের বড্ড গা-সওয়া, ক্লিশে। মানুষ জানে, এসবই আসলে ভোট কেনার টোপ। রুটি রুজির লড়াইয়ে মূল্যহীন অসার নিরর্থক। ঠিক মাসির গোঁফ হওয়ার মতো! তাই উন্নয়ন থেকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে কাঁচা হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের রাজনীতির শরণ নিয়েছেন মোদি থেকে নাড্ডা সবাই। মায় কংগ্রেস এলে মঙ্গলসূত্র হারানোর ভয় দেখানো পর্যন্ত, বাদ যায়নি কিছুই।
অথচ ২২ জানুয়ারির কথা ভাবুন। সেদিন বিকেলে মহল্লায় মহল্লায় রামভক্তদের ধুম দেখে মনে হচ্ছিল, ভোটের ফল বুঝি লেখা হয়ে গেল! কিন্তু সেই রাম ভাবাবেগ মোটেই স্থায়ী হয়নি। শুধু বাংলা কেন উত্তরপ্রদেশে বাছাই করা কিছু মন্দিরনগরী বাদ দিলে তার কোনও প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়নি ভূভারতে। সেই রেশ কত দ্রুত লঘু হতে হতে মিলিয়ে গিয়েছে মহাশূন্যে, তারই প্রমাণ দেবে আগামী মঙ্গলবারের নির্বাচনী ফল, বিশেষ করে হিন্দি বলয়। মোদির দু’শো গ্যারান্টিকে ম্লান করে দিয়েছে গ্যাস, পেট্রল, ডিজেলের দাম, খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, রেকর্ড বেকারত্ব এবং সংখ্যার জোরে সবাইকে দমিয়ে দেওয়ার স্বৈরতান্ত্রিক চক্রান্ত। মোদিজি যতই সাফাই দিন, একটা বড় অংশের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, এবার জিতে এলে সহজে আর ভোট করাবে না বিজেপি। এটাই হয়তো তাঁর এবং দেশেরও শেষ ভোট! আমূল বদলে যাবে সংবিধান। সব দলকে ভেঙে দিয়ে দেশে একটাই দল থাকবে। নোট বাতিলের মতো অপরিণত স্বেচ্ছাচার যে আবার হবে না তার গ্যারান্টি দেবে কে? আসলে জনগণ কষ্ট সহ্য করতে তৈরি। মোদিজি ফিরলেই যে জীবনযাত্রার বিরাট পরিবর্তন হয়ে যাবে, তা কেউ বিশ্বাসও করেন না। একইসঙ্গে ভারতবাসীর রক্তে গণতন্ত্র এবং মাথা উঁচু করে চলার অদম্য স্পৃহা আজন্ম প্রবাহিত। ব্যক্তিশাসন, স্বৈরতন্ত্র তাই গ্রামের আধপেটা খাওয়া কৃষক থেকে শহুরে পরিযায়ী শ্রমিক কেউ বেশিদিন সহ্য করে না। এরা ইন্দিরা গান্ধীকে সাতাত্তরে সবক শিখিয়েছে। মোদিজিকেও কড়ায় গণ্ডায় উচিত শিক্ষা দিতে প্রস্তুত। দেশের মানুষকে ‘টেকেন ফর গ্র্যান্টেড’ মনে করলে পরিণাম ভালো হতে পারে না। ইতিহাস বারবার সেই শিক্ষাই দিয়েছে। জনগণ আমার পোষ মেনেছে তাই যা খুশি করব, এই ভ্রান্ত ধারণা মনে জন্ম নিলে বুঝতে হবে, ষোলো আনা সর্বনাশের আর বেশি দেরি নেই। 
একনায়কতন্ত্রের তলায় চাপা পড়ে যাওয়া বিজেপি জিতলে নির্বাচন, সংবিধান, ব্যক্তি অধিকার সব হারিয়ে যাবে। কিন্তু মোদিজি সত্যিই যদি ইন্ডিয়া জোটের কাছে পরাজিত হন—তাহলে কি নিয়মমতোই দান ছেড়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে ইস্তফা দেবেন, 
নাকি যে সংসদ ভবন তিনি নিজের হাতে গড়েছেন সেটি অন্যের হাতে ছেড়ে না দিয়ে কোনও নতুন নাটক মঞ্চস্থ করবেন? বন্ধু ট্রাম্পের কায়দায় অনুষ্ঠিত অন্য কোনও পট পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করবে না তো দিল্লির রাজপথ! সামান্য ভোটের জন্য যে রাষ্ট্রনায়ক বলতে পারেন সিনেমাটা হয়েছিল বলে সারা বিশ্ব গান্ধীজিকে চিনেছে, তাঁর পক্ষে ক্ষমতায় থাকার জন্য কতটা নীচে নামা সম্ভব, তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রচার শেষেও তাঁর জুমলা শেষ হয় না, অগুনতি ক্যামেরার ঝলকানিকে সঙ্গী করে তিনি প্রচারসর্বস্ব ধ্যানে বসেন কন্যাকুমারীর ঐতিহাসিক বিবেকানন্দ রকে। ১৩২ বছর আগের উদার হিন্দুধর্মের উজ্জ্বল প্রতীক স্বামীজির ধ্যানের ঐতিহাসিক মুহূর্তটি এতে কলঙ্কিত হল নাকি তার গৌরব বাড়ল, তা বিচার করুন বিগলিত ভক্তকুলই। 
তবে দেশের এই কঠিন সময়ে খুব মনে পড়ছে উর্দু কবি রাহত ইন্দোরির লেখা কবিতাটি, ‘জো আজ সাহিবে মসনদ হ্যায়, কাল নেহি হোঙ্গে। কিরায়েদার হ্যায়, জাতি মকান থোড়ি হ্যায়...সভি কা খুন হ্যায় শামিল ইয়াহাঁ কি মিট্টি মেঁ, কিসি কে বাপ কা হিন্দুস্তান থোড়ি হ্যায়’।
26d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কর্মে কিছুটা শুভ। খেলাধূলায় বিশেষ নৈপুণ্য প্রদর্শন। মানসিক দিকটি বিক্ষিপ্ত থাকবে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮২.৭০ টাকা৮৪.৪৪ টাকা
পাউন্ড১০৩.৮৪ টাকা১০৭.৩০ টাকা
ইউরো৮৭.৮০ টাকা৯০.৯১ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা