বিশেষ নিবন্ধ

সোনাপাচার ঘিরে হত্যাকাণ্ড! উঠছে বহু প্রশ্ন
মৃণালকান্তি দাস

বছর পাঁচের আগে বাংলাদেশের কোটচাঁদপুরে বাগানবাড়ি বানিয়েছিল আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহিন। ৩০ বিঘা জমির উপর সেই বাগানবাড়ি উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ওই বাগানবাড়ির ভিতরে কী হতো, তা আশপাশের কেউ জানতেই পারত না। তবে প্রায়ই বিলাসবহুল গাড়ি ঢুকতে ও বের হতে দেখা যেত। ওই বাগানবাড়িতে নাকি বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের অনেকের যাতায়াত ছিল। সাংসদ আনোয়ারুল আজিমকেও মাঝেমাঝে দেখা যেত। তবে বাগানবাড়ির মালিক আক্তারুজ্জামান নাকি বছরের বেশিরভাগ সময় আমেরিকায় থাকে। দেশে ফিরলে সেই বিলাসবহুল বাগানবাড়ি হয়ে উঠত আমোদ-ফুর্তির লীলাক্ষেত্র!
আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে আনোয়ারুল আজিমের সম্পর্ক কী? জানা গিয়েছে, দু’জনই ছোটবেলায় দারুণ ফুটবল খেলত। সেই সূত্রেই একসময় বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। পরে আনোয়ারুলের মাধ্যমে সোনা চোরাচালানে যুক্ত হয় আক্তারুজ্জামান। সোনা পাচারে দু’জনের গুরু ছিল পরিতোষ চক্রবর্তী। ঝিনাইদহ শহরের সোনার ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত পরিতোষ মারা যায় ২০১৩ সালে। এরপর আনোয়ারুল ও আক্তারুজ্জামান ঝিনাইদহ সীমান্তকেন্দ্রিক চোরাচালানের বড় নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। আনোয়ারুল রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে ভিসিআর-ভিসিডির ব্যবসা করত। জাপান থেকে ভিসিআর ও ভিসিডি আমদানি করে ভারতে পাচার করত। ভারতের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে। পাচারে হাত পাকানো সেই শুরু...।
ঝিনাইদহ–৪ আসনের সাংসদ আনোয়ারুল আজিমের রাজনৈতিক উত্থানও দলবদল ও ক্ষমতার বলয়ের মাধ্যমে। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন বিএনপি নেতা ও পরে আওয়ামি লিগের সাংসদ আবদুল মান্নানের হাত ধরে রাজনীতিতে আসে। ১৯৯২ সালে কালীগঞ্জ পুরসভার কাউন্সিলার নির্বাচিত হয় বিএনপি নেতা হিসেবে। ১৯৯৫ সালে আবদুল মান্নান বিএনপি ছেড়ে আওয়ামি লিগে যোগ দেন। তখন আনোয়ারুলও তাঁকে অনুসরণ করে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় এলে আনোয়ারুল ভারতে চলে আসে। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, তোলাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ৯টির বেশি মামলা ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে ইন্টারপোল তার নামে রেড অ্যালার্টও জারি করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় এলে আনোয়ারুল ‘নির্বাসন’ থেকে বাংলাদেশে ফিরে যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়ে পায়নি। মনোনয়ন পেয়েছিলেন আবদুল মান্নান। কিন্তু ২০১৪ সালে আবদুল মান্নানকে কোণঠাসা করে আনোয়ারুল মনোনয়ন পায়। তখন থেকেই গুরু-শিষ্যের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আবদুল মান্নান মারা যাওয়ার পর কালীগঞ্জ ও ঝিনাইদহ সদরের একাংশে আওয়ামি লিগের রাজনীতিতে আনোয়ারুলই হয়ে ওঠে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। তবে চোরাচালানের দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেনি। তার সোনাপাচারের কারবার দিনের পর দিন ফুলে ফেঁপে ওঠে। আনোয়ারুলকে নাকি বাংলাদেশের অনেকে ‘সোনার আনার’ বলে ব্যঙ্গ করতেন। আর সেই সোনাপাচারের চক্রে জড়িয়েই নৃশংসভাবে খুন হতে হয়েছে সাংসদ আনোয়ারুলকে। শুধু এই একটি খুনের তদন্তেই প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে চোরাচালানের ভয়ঙ্কর দুনিয়ার কাহিনি! জানা গিয়েছে একাধিক রুটের কথাও।
গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আখতারুজ্জামান আমেরিকাপ্রবাসী হলেও তারও প্রধান ব্যবসা সোনা চোরাচালান। আবুধাবি থেকে সোনা নিয়ে এসে ভারতে বিক্রি করাই ছিল তার ব্যবসা। এই কাজে তাকে সাহায্য করত আনোয়ারুল আজিম। গোয়েন্দাদের একাংশ মনে করছেন, সম্প্রতি কয়েকটি চালান নাকি আনোয়ারুল গায়েব করে দিয়েছে, যার দাম হবে অন্তত ২০০ কোটি টাকা। এই টাকার জন্যই আখতারুজ্জামান পরিকল্পিতভাবে আনোয়ারুলকে খুন করেছে। জানা গিয়েছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে সোনা চোরাচালান ওপেন সিক্রেট। জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সবাই ভাগ পায়। শুধু যশোর অঞ্চল নয়। বখরা যায় খুলনা পর্যন্ত। আনোয়ারুল আজিম টোকেন সিস্টেম চালু করেছিল। টোকেন দেখালে পুলিস–বিজিবি ধরবে না। কিন্তু সম্প্রতি সীমান্তে একের পর এক আক্তারুজ্জামানের সোনার চালান ধরা পড়ছিল। তাতে আক্তারুজ্জামানের গ্যাং ক্ষিপ্ত হয়ে গত ১৭ জানুয়ারি মহেশপুরে সাড়ে চার কেজি সোনার একটি চালান ধরিয়ে দেয়। ওই চালান ছিল আনোয়ারুলের। এর জেরে আনোয়ারুলের সহযোগী তরিকুল ইসলাম (আকেলে) ওই দিনই মহেশপুরের বাঘাডাঙ্গা গ্রামে দু’জনকে গুলি করে 
খুন করে ভারতে পালিয়ে আসে। আক্তারুজ্জামান এরপর আনোয়ারুলের উপর আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। শুরু করে আনোয়ারুলকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার ঘাতক প্ল্যান...।
অভিযোগ, সোনার চোরাচালান, মাদক পাচার ও হুন্ডি মাফিয়াদের কাছ থেকে সাংসদ আনোয়ারুল প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা পেত। এই টাকার ভাগ নিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বিরোধ বাধে। এর মধ্যে একজন প্রভাবশালী নেতা আনোয়ারুলের মাধ্যমে প্রতি মাসে দুই কোটি টাকা করে পেত। কিন্তু ২০১৪ সালে সাংসদ হওয়ার পর থেকে আনোয়ারুল এই টাকার ভাগ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। এই অঞ্চলে সোনা চোরাচালান, মাদক ও হুন্ডি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শতাধিক ব্যক্তি খুন হয়েছে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচার হয়নি। যারা এই হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য দেবেন বলে ধরা হয় তাদেরও একই পরিণতি ঘটে। ফলে এসব মামলায় কেউ সাক্ষী হতে চায় না। গোয়েন্দাদের দাবি, চিকিৎসার কারণ দেখিয়েও গত কয়েক বছর ধরে কয়েকজন বাংলাদেশি বিপুল টাকা ভারতে এনে তা বিনিয়োগ করেছেন সোনা পাচারের মতো বেআইনি কারবারে। এমনকী সেই টাকার একাংশ অপরাধ জগতেও লগ্নি করা হয়েছে। এই ‘মেডিকেল ট্যুরিজম’-কে সামনে রেখে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের পিছনেও কাজ করত আনোয়ারুলের মাথা।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন জেলা ঝিনাইদহ, যশোর ও চুয়াডাঙ্গার ভারতীয় সীমান্ত এলাকা দীর্ঘদিন ধরে সোনা চোরাচালানের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারতে পাচারের সময় এই রুটগুলিতে প্রায়ই সোনার বড় বড় চালান ধরা পড়ে। ঝিনাইদহ, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ। জানা গিয়েছে, এক বছরে ওই তিন জেলার সীমান্তে অন্তত ১৩০ কেজি সোনা বাজেয়াপ্ত হয়েছে, যার বাজারমূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১২৮ কোটি টাকা। মামলা হয়েছে ৫৩টি। তবে গ্রেপ্তার হয় শুধু সোনা পাচারকারী বেকার তরুণ, ভ্যান-রিকশাচালক ও গ্রামের সাধারণ মানুষ। মামলার রায় হলে সাজাও হয় শুধু তাদেরই। 
যারা সোনা ক্যারিয়ার, তারা উপর বা নিচু স্তরের কাউকে তেমন চেনে না। যে কারণে তাদের 
কাছ থেকেও সেভাবে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। ফলে চোরাচালানের মূল হোতারা থেকে যায় 
নাগালের বাইরেই।
২০২৩ সালের ২৩ এপ্রিল ইকোনমিক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতের ডিপার্টমেন্ট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স (ডিআরআই) মোট ৮৩৩ কেজি সোনা বাজেয়াপ্ত করেছে। কিন্তু এত সোনা ভারতে পাচার হচ্ছে কেন? ইকোনমিক টাইমস বলছে, ভারতে সোনার উপর শুল্ক-কর মোট সাড়ে ১৮ শতাংশ। এতে চোরাচালানকারীরা উৎসাহিত হয়। চোরাচালানের মাধ্যমে ঢোকা প্রতি কেজি সোনার দাম ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১১-১৩ লাখ) কম পড়ে। মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশের বিমানবন্দর দিয়ে অবৈধভাবে সেই সোনা আনা হয়। তারপর তা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠানো হয়। সোনা চোরাকারবারির পাশাপাশি পাচার হয় ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবা। সোনা ও মাদক পাচারের অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন হয়। স্বভাবতই এই মাফিয়াদের হাতে সোনা চোরাচালানের রুটের নিয়ন্ত্রক ছাড়াও হুন্ডির লেনদেনের একটি হিসেব রয়েছে। এই হিসেব অনুযায়ী এই মাফিয়াদের হাতে বছরে ৩ হাজার কোটি টাকা হুন্ডিতে লেনদেন হয়।
সোনা চোরাকারবারির রুটও আন্তর্জাতিকভাবে কাটআউট পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। দুবাই থেকে ঢাকা অথবা দুবাই থেকে কাঠমান্ডু হয়ে ঢাকায় আকাশপথে সোনা বাংলাদেশে আসার পর এই চালান ভারতের বিভিন্ন শহরে নিরাপদে পৌঁছানোর দায়িত্ব থাকে এক একজন মাফিয়ার উপর। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা দু’টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিয়ন্ত্রণ করেন। এদের মধ্যে ঢাকা থেকে সড়কপথে ঝিনাইদহ দিয়ে যশোর প্রবেশের রুটটি স্থানীয় এক প্রাক্তন এমপি নিয়ন্ত্রণ করে। ঢাকা থেকে বরিশাল অথবা পিরোজপুর হয়ে সাগরপথে ফিশিং বোট দিয়ে সোনা চোরাকারবারির রুটটি নিয়ন্ত্রণ করে প্রথম নির্বাচিত একজন সাংসদ। মাত্র পাঁচ-ছয় বছরে সেই সাংসদ এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। তার বিরুদ্ধে সমুদ্রপথে সোনা ও মাদক চোরাচালানের অভিযোগ রয়েছে।
পিরোজপুর থেকে বরগুনা হয়ে বাগেরহাট দিয়ে ওই চালান আবার ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার হয়। ভারতে সোনা চোরাচালান ও হুন্ডির নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশে একটি গ্রুপ অব কোম্পানিজ। বছর বিশেক আগেও ঝিনাইদহ এলাকা থেকে আলোচিত হুন্ডি কাজলের মাধ্যমে ওই গ্রুপটি ৩ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছিল। হুন্ডি কাজল ভারতে আত্মগোপন করার পর ওই রুটটির নিয়ন্ত্রণ নেয় সাংসদ আনোয়ারুল। ঢাকা থেকে রুটটি নিয়ন্ত্রণ করে বাগেরহাটের আরেক রাজনৈতিক নেতা। এই রুটটির মাধ্যমে দুবাই থেকে আকাশপথে ঢাকা অথবা চট্টগ্রামে সোনার চালান পৌঁছায়। এইসব রুট বিজিবি-বিএসএফের অজানা থাকার কথা নয়।
প্রশ্ন হল, দিনের পর দিন এই রুট টিকে থাকে কীভাবে? বিজিবি-বিএসএফের ভূমিকা কী? কোথায় যায় পাচার হওয়া সোনা? সীমান্তে এত নিরাপত্তাব্যূহ, এত কড়াকড়ি, সেটা কি শুধু সাধারণ মানুষের জন্য? ভারতের ভিসার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মেডিকেল ভিসার জন্যও সাধারণ মানুষকে দিনের পর দিন ধরনা দিতে হয়। অথচ, খুনি, মাফিয়ারা অনায়াসে ভিসা পেয়ে যায় কী করে? অনেক তদন্ত সত্যের কাছাকাছি এসেও থমকে যায়। সাংসদ আনোয়ারুল হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে সেটাই হবে না তো?
3d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

হস্তশিল্পীরা বিশেষ স্বীকৃতি ও সুনাম পেতে পারেন। পারিবারিক ক্ষেত্রে চাপ। ব্যয় কিঞ্চিৎ বাড়তে পারে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮২.৫৮ টাকা৮৪.৩২ টাকা
পাউন্ড১০৩.৮৩ টাকা১০৭.৩০ টাকা
ইউরো৮৭.৯০ টাকা৯১.০৪ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা