বিশেষ নিবন্ধ

মোদি মোকাবিলায় মমতা একাই কাফি
তন্ময় মল্লিক

‘ভাগ্যিস বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হয়নি। জোট হলে জয়ের সব কৃতিত্ব কংগ্রেসই দাবি করে বসত।’ কথাগুলো তৃণমূল কংগ্রেসের এক নেতার। তখনও লোকসভা নির্বাচনের সব আসনের ফল ঘোষণা হয়নি। তবে, ছবিটা মোটামুটি পরিষ্কার। তৃণমূল বাংলায় গতবারের চেয়ে কয়েকটি আসন বেশি পেতে চলেছে। এক্সিট পোলের গুমোটভাব কেটে গিয়ে ঘাসফুল শিবিরে বইছে দক্ষিণা বাতাস। টিভিতে এক্সিট পোলের রেজাল্ট দেখে তার একদিন আগে ওই নেতা বলেছিলেন, ‘কংগ্রেসের সঙ্গে জোটটা হলে বোধহয় ভালোই হতো।’ ৪জুন বিকেলে নেতার ওই ফোনটা ছিল আসলে ‘ভ্রম সংশোধনে’র। বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষের মতো তিনিও বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। গণনা কিছুটা এগতেই তিনিও বুঝে যান, প্রচার থেকে এক্সিট পোল সবটাই ছিল প্যাকেজের অন্তর্গত। তাই সচেতনভাবেই বাস্তবকে অস্বীকার করা হয়েছিল।
চব্বিশের নির্বাচন আমাদের কিছু শিক্ষা দিয়ে গেল। সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা বোধহয় পেলেন একদা বঙ্গ কংগ্রেসের জিওন কাঠি অধীর চৌধুরী। অধীরবাবু এবার জিতলে সাংসদ হিসেবে ডাবল হ্যাটট্রিকের কৃতিত্ব অর্জন করতেন। কিন্তু মমতা বিরোধিতা জারি রাখতে গিয়ে তিনি সেই সুযোগ হাতছাড়া করেছেন। 
দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সূত্র ধরে বাংলাতেও শুরু হয়েছিল জোট চর্চা। জোটের নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমেই আসন ভাগাভাগি সেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। কারণ আসন ঘিরেই পাকে জোটের জট। একুশের ভোটের নিরিখে কংগ্রেসের একটি আসনও পাওয়ার কথা ছিল না। তাও কংগ্রেসকে দু’টি আসন ছাড়তে চেয়েছিল তৃণমূল। উদ্দেশ্য বিজেপি বিরোধী ভোট এককাট্টা করা। কিন্তু অধীরবাবুরা রাজি হননি। 
বাংলায় অবশ্য আসন সংখ্যার চেয়েও জোটের অন্তরায় ছিল মানসিকতায়। কংগ্রেস হাইকমান্ডের অনেক আগেই অধীরবাবু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন, তৃণমূলের সঙ্গে কোনও জোট নয়। তাই দিল্লিতে যখন চলছিল জোটের কথা তখন অধীরবাবু এবং তাঁর পার্ষদরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লাগাতার আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছেন।
অধীরবাবু পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ। তিনি জানেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করেই বঙ্গের রাজনীতিতে টিকে আছেন। সেখান থেকে সরলেই চিড় ধরবে তাঁর বহু কষ্টে তৈরি ‘বিপ্লবী’ ইমেজে। বিজেপিকে হটানোর জন্য জোট করলে নিন্দুকেরা বলত, হাইকমান্ডের নির্দেশে অধীর চৌধুরী মমতার সঙ্গে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছেন। আবার একা লড়াই করে জেতার জায়গাতেও কংগ্রেস নেই। তাই একটা ‘ঠেকনা’র দরকার। তারজন্য তৃণমূলের চেয়ে সিপিএমকেই অধীরবাবু নির্ভরযোগ্য মনে করেছিলেন। অধীরবাবুর ভুলটা এখানেই।
একটা সময় মুর্শিদাবাদ জেলায় অধীরবাবুর মূল লড়াইটা ছিল বামেদের বিরুদ্ধে। সিপিএমের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াইয়ের জন্যই তাঁর রবিনহুড ইমেজ। তারই জোরে বাম আমলে কংগ্রেস দখল করেছিল মুর্শিদাবাদ জেলাপরিষদ, এমনকী জেলার সব লোকসভা আসনও। তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়, বাম আমলেও মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষ সিপিএমকে পছন্দ করত না। অধীরবাবু সিপিএমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয় মুর্শিদাবাদ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল। সেই সিপিএমকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই মুর্শিদাবাদের মানুষ অধীরবাবুর দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছে।
ক্ষয় শুধু মানব জীবনে বা প্রাণীজগতেই হয় না, ইমেজেরও হয়। এবারের নির্বাচন সেই শিক্ষাও দিল। এর আগে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও অধীরবাবু মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন। ডুবতে ডুবতে শেষমুহূর্তে ভেসে উঠেছেন। বহরমপুর পাশে থাকায় তিনি পেয়েছেন টানা সাফল্য। সাফল্য আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। আত্মবিশ্বাস ভালো। কিন্তু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস মানুষকে করে তোলে অহঙ্কারী। সেই কারণেই কি তৃণমূল সুপ্রিমোর জোট মানসিকতাকে অধীরবাবু তাঁর ‘দুর্বলতা’ ভেবে ভুল করেছিলেন? 
টানা পাঁচবারের সাংসদ অধীরবাবু হয়তো ভেবেছিলেন, তিনি যে সিদ্ধান্তই নিন না কেন, পাশে থাকবে বহরমপুর। সেই আশাতেই বহরমপুর আর মুর্শিদাবাদে দাঁড়িয়ে ছিলেন বঙ্গ রাজনীতির দুই হেভিওয়েট। মহম্মদ সেলিমকে সামনে রেখে কিস্তিমাত করে ছাব্বিশের আগে সাগরদিঘির মতো ‘বহরমপুর-মুর্শিদাবাদ’ মডেলের জন্ম দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গেমপ্ল্যান ফেল করেছে। দুই হেভিওয়েটের পরাজয় শুধু তাঁদের রাজনৈতিক জীবনকেই নয়, দু’টি দলকেই প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তবে তাঁরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ, এমনটাও বলা যাবে না। সংখ্যালঘু ভোট কেটে বিজেপিকে জেতানোর যে পরিকল্পনা তাঁরা নিয়েছিলেন, সেটা রায়গঞ্জ ও মালদহ উত্তর কেন্দ্রে ভীষণভাবে সফল হয়েছে। পুরুলিয়াতেও ঘটেছে একই ঘটনা।
রায়গঞ্জে তৃণমূল হেরেছে প্রায় ৬৮ হাজার ভোটে। সেখানে কংগ্রেস পেয়েছে ২ লক্ষ ৬৩ হাজার ভোট। পাশের কেন্দ্র মালদহ উত্তরে তৃণমূল হেরেছে প্রায় ৭৮ হাজার ভোটে। কংগ্রেস পেয়েছে ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ভোট। বঙ্গে জোট হলে বিজেপি এক অঙ্কের ঘরেই আটকে যেত। কিন্তু সেটা অধীরবাবু বা সেলিম সাহেব, কেউই  চাননি।
চব্বিশের নির্বাচন কি সিপিএমকে সত্যিই কিছু শিক্ষা দিতে পারল? সিপিএম নেতৃত্ব দাবি করে, ৩৪ বছরের রাজত্বে বাংলায় গণতন্ত্র ছিল, কোনও দুর্নীতি হয়নি, এমনকী অত্যাচারও হয়নি। মানুষই ভুল বুঝে তাদের সরিয়ে দিয়েছে। তারপর একের পর এক নির্বাচন হচ্ছে, কিন্তু মানুষ ভুল শুধরে নিচ্ছে না। একুশের ভোটে শূন্য, এবারেও সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। ৩২ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩০ জনেরই জামানত জব্দ। অনেকেই বলছেন, সিপিএমের এমন পরিণতির জন্য দায়ী তাদের দ্বিচারিতা। ভুল স্বীকার না করে তাকে সঠিক বলে চালাতে চাইছে। তাতে মানুষ মনে করছে, এরা ক্ষমতায় ফিরলে ফের একই কাণ্ড ঘটাবে। 
তবে সিপিএমের এই হাল শুধু বাংলায় নয়, গোটা দেশেই তাদের অবস্থা খুব করুণ। কেরলে ক্ষমতায় আছে বামেরা। তা সত্ত্বেও সেখানে মাত্র একটি আসন পেয়েছে তারা। দিল্লিতে কংগ্রেসের সঙ্গে দোস্তি আর কেরলে কুস্তি, সিপিএমের এই নীতি মানুষ মেনে নেয়নি। তাই এক সময় যারা ভারতবর্ষে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাত এখান গোটা দেশে তাদের আসন সংখ্যা মাত্র চার। 
প্রশ্ন হচ্ছে, অধীর চৌধুরী এখন কী করবেন? নির্বাচনে হেরে গেলে রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন, এমন ঘোষণা ভোটের আগে অধীরবাবু করেছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল নিছকই কথার কথা। মাছ জল ছাড়া বেশিক্ষণ বাঁচতে পারে না। তাই তিনি রাজনীতিতেই থাকবেন। কিন্তু প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেতে গেলে তাঁর স্টাইলটা বদলাতে হবে। কারণ জাতীয় এবং রাজ্য রাজনীতির পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ভোটে হেরে যাওয়ায় অধীরবাবু হাইকমান্ডের কাছে আরও গুরুত্বহীন হয়েছেন। তারউপর প্রায় তিরিশে পৌঁছে গিয়েছে তৃণমূল। তাই দিল্লি কংগ্রেস কিছুতেই মমতাকে চটাতে চাইবে না। এরপরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা চালিয়ে গেলে হাইকমান্ড যে অধীরবাবুকে রেয়াত করবে না, সেটা আগেই খাড়্গে সাহেব জানিয়ে দিয়েছেন।
যাঁরা অধীরবাবুকে জানেন তাঁরা বলছেন, সহজে হাল ছাড়ার পাত্র তিনি নন। কোনও চাপের কাছে তিনি মাথা নোয়াবেন না। প্রয়োজনে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদে ইস্তফা দিয়ে হাইকমান্ডের উপর পাল্টা চাপ সৃষ্টির কৌশল নিতে পারেন। তবে, সেটা করলে তাঁর রাজনৈতিক জীবন আরও অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।
অধীরবাবুর বিজেপিতে যোগদান নিয়ে মাঝেমধ্যেই গুজব ছড়ায়। বহরমপুরে হেরে যাওয়ার পর সেই গুজব আরও জোরদার হয়েছে। তিনি দল বদলাতে চাইলে বিজেপি যে তাঁকে লুফে নেবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাঁর মতো কট্টর মমতা বিরোধীকে বিজেপি যোগ্য সম্মানই দেবে। কিন্তু অধীরবাবুর সেই রাস্তায় যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ বাংলায় বিজেপির যা ফলাফল তাতে আগামী দিনে গেরুয়া শিবিরে অশান্তি আরও বাড়বে। আদি-নব্যের লড়াই  উঠবে চরমে। ছাব্বিশে বিজেপির অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তাই ‘ফুটো নৌকা’য় তিনি চাপতে চাইবেন না। ফলে অধীরবাবু এখন আক্ষরিক অর্থেই শাঁখের করাতের মুখে পড়েছেন। 
এই নির্বাচন আরও একটা বিষয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারেকাছে কেউ নেই। চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও রাজ্যে তাঁর জোট না করার সিদ্ধান্তই ছিল ঠিক। কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করলে হয়তো কয়েকটা আসন ‘ইন্ডিয়া’ জোট বেশি পেত। কিন্তু উঠতে বসতে শুনতে হতো, কংগ্রেসের দয়াতেই তৃণমূল এত আসন পেয়েছে। যেমনটা শুনতে হয়েছিল ২০১১ সালে। কিন্তু একলা লড়াই করে তৃণমূল দেখিয়ে দিল, মোদি মোকাবিলায় মমতা একাই কাফি।
19d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কর্মে কিছুটা শুভ। খেলাধূলায় বিশেষ নৈপুণ্য প্রদর্শন। মানসিক দিকটি বিক্ষিপ্ত থাকবে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার ৮২.৬৩ টাকা৮৪.৩৭ টাকা
পাউন্ড১০৪.২২ টাকা১০৭.৬৮ টাকা
ইউরো৮৭.৮৯ টাকা৯১.০১ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা