বিশেষ নিবন্ধ

আজ হাসছে গণতন্ত্র
সমৃদ্ধ দত্ত

আজ হাসছেন মণিপুরের কাংপোকপি গ্রামের নারীরা। 
চরম অরাজকতায় তিন নারী প্রাণ বাঁচাতে সন্তান নিয়ে পালিয়েছিলেন হাওকচংচিং জঙ্গলে। সেখান থেকে টেনে বের করে তাঁদের নগ্ন করে হাঁটানো এবং গণধর্ষণ করা হয়। জ্বলছে মণিপুর মাসের পর মাস। আপনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভ্রমণ করে বেরিয়েছেন। একবারও মণিপুরের সেই মায়েদের পাশে গিয়ে দাঁড়াননি। কোনও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেননি। উল্টে ধর্মীয় বিভাজনকে উস্কে দিয়েছেন লাগাতার দিল্লিতে বসে। কুকি আর মেই঩তেইদের মধ্যে বিদ্বেষ জিইয়ে রাখতে হবে তো! 
আজ হাসছেন শশীতা নিগার।
দিল্লির জয়পুর গোল্ডেন হাসপাতালের নার্স। ২০২১ সালের এপ্রিলে রাত সাড়ে সাতটা থেকে তিনি এবং হাসপাতালের পরিচালকরা কাঁদতে কাঁদতে সরকারি হাসপাতাল আর সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরের কাছে কিছু অন্তত অক্সিজেন সিলিন্ডার পাঠাতে বলেছিলেন। চোখের সামনে তখন ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিটে ১৩ জন রোগীর নাক থেকে অক্সিজেন টিউব খুলে নিতে হয়েছে। কারণ অক্সিজেন ফুরিয়ে গিয়েছে হাসপাতালে। একে একে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন সেই হাই প্রোফাইল রোগীরা। যাঁরা বিপুল অঙ্কের ইনকাম ট্যাক্স দিতেন। যাঁরা ভোট দিতেন। যাঁরা আপনার কথায় বিশ্বাস করতেন। আপনি কী করছিলেন এরকম এক মাসে? বাংলায় ভোটপ্রচার করছিলেন। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব থ্যাকারে অক্সিজেনের সাপ্লাইয়ের জন্য আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চেয়েছিলেন। তাঁকে বলা হয়, উনি বেঙ্গলে ভোটে ব্যস্ত। আপনি সেই ভোটে কী বলেছিলেন বেঙ্গলে গিয়ে? ‘দিদি ও দিদি...’। 
আজ হাসছে পাঁচটি অতৃপ্ত আত্মা। 
২০২০ সালের মার্চ মাসে পাঁচজনের পরিবার হাঁটছিল হরিয়ানার কুণ্ডলি-মানেসর-পলবল এক্সপ্রেসওয়েতে। গুরুগ্রাম থেকে বিলাসপুর বাড়ি ফিরছিল তারা। আচমকা লকডাউনের কারণে কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। থাকার জায়গা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। খাবারও প্রায় শেষ। তাই তারা হাঁটার পথে নেমেছে। মধ্যরাতে একটি ট্রাক এসে তাদের পিছন থেকে ধাক্কা মারে। শিশু, মহিলা ও পুরুষ। গোটা পরিবার ধ্বংস। কেন অতৃপ্ত? কারণ তাদের কাছে আইডেন্টিটি কার্ড পাওয়া যায়নি। জানা যায়নি তাদের পরিচয়। তারা মধ্যরাতে নিজেদের অজান্তেই বিনা দোষে মুছে গেল অস্তিত্ব থেকে। পৃথিবী তাদের নামপরিচয়ই জানল না। তাহলে তারা কারা ছিল? তারা ছিল উপেক্ষিত ভারত। সেই সময় হাই প্রোফাইল ভারতকে আপনি কী বিনোদন দিয়েছিলেন? নির্দেশ দিয়েছিলেন, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থালা বাসন কাঁসর ঘণ্টা বাজাতে! 
আজ হাসছে পুনম মণ্ডল। 
তার স্বামী ৩৫ বছরের ছাবু মণ্ডল গুরুগ্রামের ফ্ল্যাট নির্মাণের সাইটে  টাইলস বসানোর কাজ করত। কোভিডের কারণে লকডাউন হয়ে যাওয়ায় কাজ বন্ধ। প্রথম যে কাজটি ছাবু করেছিল তা হল মোবাইল বিক্রি করে দেওয়া। তা না হলে খাবার কিনবে কীভাবে? আড়াই হাজার টাকায়। বউ পুনমকে কিছু বাজার করে এনে দিয়েছিল। আর ওই টাকা হাতে দিয়ে বলেছিল চালিয়ে নাও কিছুদিন। কিছু কাজ তো পাবই। ছাবু মণ্ডল কাজ পায়নি। বরং পুলিসের লাঠি খেয়েছিল। তারপর প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া ঘরে ফিরে সে আত্মহত্যা করে। তার কথা রাষ্ট্র ভাবেনি। তখন আপনি কী করেছিলেন? আপনি ধনী ভারতকে একটি খেলা দিয়েছিলেন। লাইট নেভানোর খেলা। ২০২০ সালে ৫ এপ্রিল রাত ৯টার সময় ৯ মিনিটের জন্য সবাই যেন ঘরের লাইট নিভিয়ে দেয়। প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকে। এলিট ইন্ডিয়া তাই করেছিল। ছাবু মণ্ডলদের ঘরের আলো আগেই নিভে গিয়েছিল! 
আজ হাসছে হাতরাসের দলিত তরুণীর সেই পরিবার। 
বুলগড়ি গ্রামের সেই তরুণীর পরিবার ঠাকুর সম্প্রদায়ের খেতে কাজ করত মজুরের। সেই মেয়ে গোরুর জন্য ঘাস পাতা আনতে খেতে গিয়েছিল। চারজন যুবক তার দোপাট্টা ধরে টেনে নিয়ে যায়। ধর্ষণ করে। দোপাট্টা নৃশংসভাবে জড়িয়ে টানাটানি করায় তার স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জিভ কেটে নেওয়া হয়। পুলিস অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে। এ হাসপাতাল ও হাসপাতালে তাকে নিয়ে পাগলের মতো ছোটাছুটি করে পরিবার। দিল্লির হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। পরিবারকে না জানিয়ে, অনুমতি না নিয়ে উত্তরপ্রদেশ পুলিস মধ্যরাতে তার দেহ সৎকার করে দেয়। খোলা মাঠে। আপনার সামান্যতম সহানুভূতি পেল না কেন তারা? উল্টে আপনার দল সেই ধর্ষণকারীদের পক্ষেই ছিল। 
আজ হাসছে নিয়াবন, জনোরা, রামনগরের বাসিন্দারা।
হঠাৎ করে সন্ধ্যার পর এসে যাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল নোটিস। বাড়ি ফাঁকা করে দিতে হবে। বাড়ি ভাঙা হবে। কেন? রাম পথ তৈরি হবে। আমাদের নিজের জমি। নিজের বাড়ি। আমরা কোথায় যাব? প্রশাসন আর পার্টির লোকেদের কিছু যায় আসে না। তারা যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, জয় শ্রীরাম। অযোধ্যার পাড়ায় পাড়ায় হাহাকার শুরু হয়। রাকেশকুমার গুপ্তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল অযোধ্যায়। ৬৪ বছরের রাকেশকুমার বলেছিলেন, আমার নাতি নাতনিরা স্কুলে যেতে পারে না। আমাদের থাকার জায়গা নেই। অনেক দূরে ছেলে ঘর ভাড়া নিয়েছে। সেখানে সবাই মিলে থাকতে হয়। অথচ আমার তিনতলা বাড়ি ছিল। এখন রিকশ চালাই। রাকেশকুমার গুপ্তার মতো অসংখ্য অযোধ্যাবাসীর চোখের জল সরযু নদী দেখেছে এবং তারপর ৪ জুন এসেছে। আপনি আর অযোধ্যায় যাবেন কোন মুখে? মনে আছে ২২ জানুয়ারি আপনি দম্ভভরে বলেছিলেন আপনি একাই নাকি ভারতের এক হাজার বছরের ভবিষ্যৎ সেদিন নির্ধারণ করে গেলেন! এই কোটি কোটি বছরে প্রাচীন মহাবিশ্বে আপনি নিজের উচ্চতাকে এত দীর্ঘ ভাবলেন কীভাবে? 
আজ হাসছে বাসুদেব বিশ্বাস, নগেন দাসের পরিজনেরা। 
মুখের ভাষা বাংলা হওয়ার অপরাধে যাদের ডিটেনশনে ক্যাম্পে স্থান হয়েছিল। এবং মৃত্যু হয়েছিল। ১২ লক্ষ হিন্দুর নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল এনআরসি তালিকায়। তাদের অনেকেই বাংলাদেশ থেকে আসা। কিন্তু বহুসংখ্যক ভারতবাসী। দেশের যে কোনও প্রান্তে নিম্নবর্গের মুখে বাংলা ভাষা শুন঩লেই আপনার অনুগামী ভক্তবৃন্দ সন্দেহ করে তারা নাকি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী। 
আজ বাঙালি হাসছে। 
আপনারা কে? বাঙালির কালচার বাঁচানোর দায়িত্ব নেওয়ার? আপনারা কে? বাঙালিকে ধর্মাচারণ শিক্ষা দেওয়ার! আপনারা কে? বাঙালি কী খাবে এবং কী খাবে না সেটা ঠিক করে দেওয়ার? সেলুলার জেলের বন্দি ও মৃত্যু তালিকায় একবার চোখ বোলান তো কোন রাজ্যবাসীর নাম বেশি আর কাদের প্রায় খুঁ঩জেই পাওয়া যাবে না! দেশভাগে আপনাদের রাজ্যের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয়েছে? ১৯৪৭ সাল বা তার পরেও পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা লক্ষ লক্ষ জনস্রোত তো হিন্দু ছিল? আপনাদের ওখানে কতজনকে স্থান দেওয়া হয়েছে? বিগত ১০ বছরে বাংলার জন্য ঠিক কী কী উন্নয়ন দিয়েছেন? কতগুলো নতুন শিল্প পেল বাংলা? কত লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প ঘোষণা করলেন? উল্টে রামনবমী আর হনুমনজয়ন্তীর দিন  অস্ত্রমিছিলের কালচার আমদানি করা হয়েছে বেশি বেশি। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গৃহদেবতা ছিলেন রঘুপতি। ফুলিয়ার কৃত্তিবাস ওঝা রামায়ণের সুললিত অনুবাদ দিয়ে গিয়েছেন। কাশীরাম দাসের মহাভারত আমাদের শিক্ষিত করেছে। বৈশাখ মাসব্যাপী অশ্বত্থ গাছের শিকড়ে জল ঢালা ব্রতের অঙ্গ। রাঢ়বঙ্গে শিব ও মনসার পর সবথেকে জনপ্রিয় ঈশ্বর ধর্মঠাকুর। এসব জানতে হবে তো আপনাদের! বাঁকুড়ায় স্বরূপ নারায়ণ, বর্ধমানে অনাদিনাথ, মেদিনীপুরে ক্ষেত্রপাল...এরকম সব বৈচিত্র্যময় ঈশ্বর আরাধনার সন্ধান না করে, শুধুই হিন্দু বনাম মুসলিম করলে হবে কীভাবে! হিন্দু খতরে মে হ্যায়? তা ১০ বছরে হিন্দুর নিরাপত্তাই আপনি নিশ্চিত করতে পারলেন না? হিন্দু জাগরণের এপিসেন্টার যা হওয়া উচিত ছিল, সেই অযোধ্যাই আপনাদের হারিয়ে দিল? এই স্লোগানটাই তো আপনার ব্যর্থতা! বাংলায় এসে বাঙালিকে এত রকম বাণী দেওয়ার অধিকার যোগ্যতা এবং হোমওয়ার্ক আপনাদের আছে কি না আগে তো সেই আত্মসমীক্ষা করা উচিত ছিল। মানুষকে অপমান করবেন না। লক্ষ্মীর  ভাণ্ডারকে ভিক্ষা বলবেন না। মানুষের সবথেকে আনন্দ হয় কারও অহংকার ভাঙতে পারলে! ঔদ্ধত্য, দম্ভ, অহংকার, বঙ্গবাসী অনেক দেখেছে এবং বিগত ৭৬ বছরে প্রত্যেককে শিক্ষাও দিয়েছে! যদি এখনও কারও অহংকার জন্মায়, তাদেরও পতন হবে। আপনি এই সিম্পল থিওরি বুঝলেন না! 
আজ হাসছেন পরমাত্মা। 
আজ পর্যন্ত কোনও প্রকৃত সাধক যে কথা উচ্চারণ করতে সাহস করেননি যে, তাঁকে স্বয়ং পরমাত্মা সরাসরি পাঠিয়েছেন মানুষের সেবা করার জন্য, সেকথাও আপনি অনায়াসে বলেছেন। এই যে অতি আত্মবিশ্বাস যা কার্যত চরম এক আত্ম অহংকারের প্রকাশ, এটা প্রায় ৫০ বছর রাজনৈতিক জীবনের পরও কেন একজন মানুষের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়? এটা সমাজতত্ত্বের গবেষণার বিষয়! আপনাকে কেউ কখনও ভাবেনি দুর্বল দেখবে। এককভাবে সরকার গড়তে না পেরে আপনাকে সারাক্ষণ জোটশরিকদের দয়াদাক্ষিণ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে, এটা কল্পনাই করেননি আপনি নিজেও। শরিক নির্ভর একটি সরকারের সবথেকে বড় সঙ্কট কী হয়? আপনিই ১০ বছর ধরে একজন মানুষ সম্পর্কে সেই কথা বলে এসেছেন এবং হাসাহাসি ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছেন। আপনারা বলেছেন, পলিসি প্যারালিসিস হয়। নীতি পঙ্গুত্ব! তাই একক গরিষ্ঠ সরকারই আপনার মাধ্যমে ভারতের কাম্য, এই দাবি করেছিলেন। এই শ্লেষ, অপমান আর ঠাট্টায় রক্তাক্ত হয়েও নিজের স্বভাবসিদ্ধ ডিসেন্সি ও শিক্ষার দীপ্তিতে তিনি নীরব থেকেছেন। 
আজ হাসছেন ডক্টর মনমোহন সিং! 
পুরনো সংসদ ভবনকে অতীত করে দিয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করে আপনি নিজেই নিজের ছাপ ইতিহাসে রেখে যেতে চেয়েছেন। স্বপ্ন দেখেছেন চারশো পার করে দৃপ্ত ভঙ্গিতে নবনির্মিত সংসদে প্রবেশ করবেন! পাল্টে দেবেন সংবিধান। পাল্টে দেবেন আইন। পাল্টে দেবেন ইতিহাস। পাল্টে দেবেন রাজনীতিকে। অথচ সেই ভবনে আপনাকে দুর্বল হয়ে ঢুকতে হবে এবার। 
 হাসছে গণতন্ত্র! 
20d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কর্মে কিছুটা শুভ। খেলাধূলায় বিশেষ নৈপুণ্য প্রদর্শন। মানসিক দিকটি বিক্ষিপ্ত থাকবে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার ৮২.৬৩ টাকা৮৪.৩৭ টাকা
পাউন্ড১০৪.২২ টাকা১০৭.৬৮ টাকা
ইউরো৮৭.৮৯ টাকা৯১.০১ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা