পড়াশোনার চাপে কেবল শিশুরা নয়, অভিভাবকরাও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সন্তানের কাজ পড়াশোনা করা। মা-বাবার কাজ সন্তান পড়াশোনাটা ঠিকমতো করছে কি না, তা নজরে রাখা। কিন্তু মা-বাবা যখন সন্তানের পড়াশোনাকে নিজের পড়াশোনা ভাবতে শুরু করেন, তখনই সমস্যা শুরু হয়। সন্তানের পড়াশোনা থেকেও যখন রেজাল্ট, পরীক্ষা নিয়ে বাবা-মা উদ্বিগ্ন হন, তখন থেকেই শুরু হয় গণ্ডগোল। মা-বাবা’র অতিরিক্ত চিন্তার ফলে সন্তানের ওপর পড়ে অত্যধিক চাপ। অসুস্থ প্রতিযোগিতার দৌড় থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসবেন অভিভাবকরা, সেই পরামর্শই রইল আজ।
পরীক্ষা চলাকালীন
সন্তানকে সাহায্য করুন
অভিভাবকদের এই সময় সন্তানদের পাশে দাঁড়ানো উচিত, কারণ সন্তানরা পরীক্ষার চাপ অধিকাংশ সময় সামলাতে পারে না। তাই সন্তানকে একটা সময়তালিকা তৈরি করে দিন। পুরানো পড়া মনে রাখতে সাহায্য করুন। পুষ্টিকর খাবার খেতে দিন। ঠিকমতো ঘুমচ্ছে কি না সেদিকে নজর রাখুন। তাকে বুঝতে দিন যে আপনি তার পাশে আছেন।
নিজের সন্তানকে
বোঝার চেষ্টা করুন
অভিভাবক হিসেবে বোঝা উচিত, যে সন্তানরা কখন চিন্তিত এবং ভীত। অনেকসময় ছেলেমেয়েরা মা-বাবাকে নিজের সমস্যা সম্পর্কে জানায়। বিভিন্নরকম দুশ্চিন্তা, যেমন, যথেষ্ট প্রস্তুতি না থাকা, ভবিষ্যৎ নিয়ে ধোঁয়াশা, মনঃসংযোগ না করতে পারা, পড়া মনে রাখতে না পারা ইত্যাদি। কেউ কেউ খুব বেশি ঘুমোয় আর কেউ কেউ খুবই কম। আবার কারও হয়তো পরীক্ষার ঠিক আগেই পেট খারাপ হয়। কেউ কেউ এই অতিরিক্ত চাপ না নিতে পেরে আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। এইগুলি সবই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। তাই এই সময় অভিভাবকদের উচিত সারাক্ষণ সন্তানের পাশে থেকে তার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করা। সবসময় বাচ্চার শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া উচিত, শুধু নম্বরের উপর কখনই নয়।
অযথা তুলনা করবেন না
প্রতিটা শিশু আলাদা। একই মায়ের পেটেরও একেক সন্তান একেক রকম হয়। তাই অন্য বাচ্চা কে কী করতে পারে আর আপনার সন্তান কী করতে পারল না, তা নিয়ে তুলনা করা যুক্তিহীন। সবার সব কাজ করার ক্ষমতা বা যোগ্যতা থাকে না। তাই অন্যদের সঙ্গে তুলনা না করে নিজের সন্তানকে বোঝার চেষ্টা করুন ও তার যোগ্যতা অনুযায়ী তাকে কাজ করতে দিন।
নিজে ডিসিশন নেওয়ার
সুযোগ দিন সন্তানকে
বাচ্চারা ছোট হলেও ওদের নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ তৈরি হয়ে যায় ৩ বছর থেকেই। সব ব্যাপারে বাচ্চাদের ডিসিশন নিজে নেবেন না বা বাচ্চাদের প্রতিটা কাজ নিজে করে দেবেন না। ওদেরও ডিসিশন নেওয়ার সুযোগ করে দিন। যেমন কী পড়বে, কখন পড়বে, নিজেকেই ঠিক করতে দিন। ওদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিলে আত্মবিশ্বাস বাড়বে। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহও বাড়বে। বাচ্চার সব কাজ নিজে করে, সব ব্যাপারে নিজে ডিসিশন নিয়ে তাকে মেশিনে রূপান্তর করবেন না। তাকে চিন্তা করার, ডিসিশন নেওয়ার সুযোগ করে দিন।
কী কী বিষয় নিয়ে মাথা
ঘামানো উচিত নয়
অনেকেই উচ্চ শ্রেণীতে উঠে পড়াশোনা সম্পর্কে দায়িত্বশীল হয়ে যায়। তাদেরকে নিজের মতো করে পড়তে দিন। তাদেরকে পরীক্ষার গুরুত্ব নিজে থেকে উপলব্ধি করতে দিন। সারাক্ষণ তাদের পেছনে ঘুর ঘুর করলে তারা কিছু বেশি শিখে যায় না। অনেক সময় আমি দেখেছি বাবা-মায়েরা সারাক্ষণ ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসে থাকেন। এইসব না করে বাবা-মায়ের উচিত তাকে বলা যে, যে কোনও দুশ্চিন্তার সমাধানের জন্য সে তাঁদের কাছে আসতে পারে।
পড়াশোনার সময় নির্ধারণে
স্বাধীনতা দিন
প্রতিটা শিশু আলাদা। কাজেই তার পড়ার সময়টা তাকেই নির্ধারণ করতে দিন। মনে রাখবেন যে সারাদিন ‘পড় পড়’ বললেই আপনার সন্তান সব শিখে যাবে না। তাকে তার পছন্দমতো সময়ে পড়তে দিন। পড়ার সময়টা স্বাধীনভাবে বেছে নিতে দিন।
সন্তানকে উৎসাহ দিন
অভিভাবকদের প্রথমে বুঝতে হবে যে সামান্য কিছু নম্বরের চেয়ে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন কাটানো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। লেখাপড়া জীবনের সামান্য একটা অংশ মাত্র। তাই সে যা করতে ভালোবাসে বা যাতে তার প্রতিভা আছে সেই বিষয়ে উৎসাহ দিন। এতে তার জীবন অনেক বেশি আনন্দময় হয়ে উঠবে।
সাফল্যের মাপকাঠি
বেঁধে দেবেন না
সাফল্য বা ব্যর্থতা নিয়ে নিজে কী মনে করেন তা বুঝিয়ে দিন। কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট মাপকাঠি বেঁধে দেবেন না। যদি আপনার মনে হয় যে ৯০ শতাংশ আপনার কাছে খুব ভালো নম্বর তাহলে সে সেটাই বিশ্বাস করবে। তাই যদি সে ৮৫ শতাংশ পায়, তাদের মনে হবে সে তার মা-বাবাকে খুশি করতে পারেনি। অভিভাবক হিসেবে আপনার সব সময় চেষ্টা হওয়া উচিত যাতে আপনার সন্তান একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠে। তাদেরকে নিজের প্রতি সততা বজায় রেখে চলতে, নিজের ওপর ভরসা করতে বেশি করে শেখানো উচিত। আর এগুলো নিয়েই আলোচনা করা উচিত। আপনার খেয়াল রাখা উচিত যে, আপনার কথায় যেন সব সময় সাফল্যই প্রাধান্য না পায়।
পড়ার মাঝে বিরতি দিন
কিছুক্ষণের জন্য একটু ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করলে বা খেলা করলে কোনও ক্ষতি হবে না। কিন্তু সে যদি সারাক্ষণই সেই সব নিয়ে বসে থাকে, সেই ক্ষেত্রে আপনি বলতেই পারেন। তার চেয়ে ভালো আপনি তাকে একটু হেঁটে আসতে বা গান শুনতে বলতে পারেন। এর ফলে সে তরতাজা বোধ করবে। তাকে নিজের দায়িত্ব বুঝতে দিন।
পড়াশোনা সহজ নয়। এর অনেক ভার। আর ভার মানেই চাপ কিছুটা লাগবেই। সেই চাপ মোকাবিলা করতে না জানলে পড়তে হবে ঘোর বিপদে। নিউটন সাহেবও বলে গিয়েছেন, ‘প্রতিটা ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া আছে।’ তাই ভালো ফল করতে হলে একটু চাপ নিতেই হবে। কিন্তু পড়াশোনার চাপে চ্যাপ্টা হলে চলবে না। 
সমিত রায়
(চ্যান্সেলর, অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটি)