পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
প্যাশন না থাকলে দৌড়নো যায় না স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে। নিষ্ঠা, একাগ্রতা, ভালোবাসা ছাড়া সম্ভব নয় উৎকর্ষকে ধাওয়া করা। পড়াশোনা হোক বা খেলাধুলো, সাফল্যের প্রাথমিক শর্ত এগুলোই। আর দরকার নিজের স্কিলে সুতীব্র আস্থা। অনন্ত চাপের মুখেও সেরাটা বের করে আনার মানসিক কাঠিন্য। কপিল দেব, মহেন্দ্র সিং ধোনি ও রোহিত শর্মা— এদেশের তিন বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়কের কেরিয়ারেই তা প্রতিফলিত।
কপিলের গলায় একসময়ের তুমুল জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনী ট্যাগলাইন ছিল ‘পামোলিভ কা জবাব নেহি’। হৃদয়ের উথালপাথাল আবেগ আর অনুভূতি যদিও বলবে, তাঁরই জবাব হয় না। তুলনাহীন খোদ কপিলই! ১৯৮৩ সালের ২৫ জুন টেমসের পাড়ে ওয়ান ডে বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। লর্ডসের ফাইনালে মহাপরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে কপিল’স ডেভিলস। মুহূর্তে বদলে যায় ভারতীয় ক্রিকেটের গতিপথ। তার রূপকার অবশ্যই কপিল। এদেশে সত্যিকারের ‘দেব’ তিনি। ‘ক্যাপস’এর কাঁধে চড়েই ঝলমলে আলোয় উত্তরণ ঘটেছিল আন্ডারডগদের।
কপিলরা থাকতেন চণ্ডীগড়ে। জোরে বল করতে ভালোবাসা ছেলেবেলাতেই। কোচ দেশপ্রেম আজাদের কাছে সেটাই জল-হাওয়া পায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেটে ঘাম ঝরাতেন হাসিমুখে। প্রচণ্ড গরমেও ১০-১৫ ওভার হাত ঘোরানো। নিজেকে নিখুঁত করার অন্তহীন সাধনা। একবার আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় জায়গা মেলেনি দলে। অনুশীলনে স্কুল ক্যাপ্টেনের জন্য তাই বরাদ্দ হল বিষাক্ত বাউন্সার। ফাটল তাঁর মাথা। আর কখনও স্কুল দল থেকে বাদ পড়েননি। কোচের পরামর্শ ছিল, পেস বোলারের খাওয়া জরুরি। বাবা তাই কয়েকটা গোরুই কিনে ফেলেন। বললেন, ‘এবার যত খুশি দুধ খাও!’
কপিলের জীবনদর্শন ছিল সহজ-সরল। উপভোগ করা জরুরি। নইলে অধরাই থাকে সাফল্য। পড়তে ভালো না লাগলে তাই পড়াশোনায় সময় নষ্ট করা বেকার। একই কথা প্রযোজ্য ক্রীড়াক্ষেত্রেও। নিজস্ব ভালো-লাগার জগতেই সেজন্য ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। ‘হরিয়ানা হ্যারিকেন’ সেটাই করেছিলেন। বিশ্বাস করতেন, ভবিষ্যৎ লিখতে হয় নিজেকেই। কাউকে অনুকরণ করে এগনো যায় না। কারণ অনুকরণ করলে আসলকে ছাপিয়ে যাওয়া অসম্ভব। বড় হওয়ার দিনগুলোয় রেডিওতে ধারাভাষ্য শুনতেন কপিল। তখনই আইডল হয়ে ওঠেন গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। কিন্তু তাঁর মতো ব্যাটিংয়ের চেষ্টা করেননি। বরং পেস বোলিংয়েই সমর্পণ করেন মন-প্রাণ। সাধনা, জেদ আর পরিশ্রমের পতাকা উড়িয়েই পৌঁছন লক্ষ্যপূরণের স্টেশনে। হয়ে ওঠেন বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারদের অন্যতম।
ধোনির উত্থানও রূপকথার। ক্রিকেট মানচিত্রে একেবারেই পুঁচকে শহর রাঁচি থেকে উঠে আসা। একদা খড়্গপুর স্টেশনের টিকিট কালেক্টরের ভারতীয় ক্রিকেটের রাজপথে পা রাখার কাহিনি গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতোই। কপিলের হাতে কাপ ওঠার ঠিক ২৮ বছর পর ধোনি জেতেন ট্রফি। ২০১১ সালের ২ এপ্রিল আরব সাগরের তীর সাক্ষী থাকে মায়াবী রাতের। অথচ, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে রান তাড়ায় একসময় ধুঁকছিল ইনিংস। সেই পরিস্থিতি থেকে চাকা ঘোরায় একটা সিদ্ধান্ত। যুবরাজ সিংকে পিছিয়ে দিয়ে ব্যাটিং অর্ডারে এগিয়ে নামেন ধোনি। অথচ, সেবারের আসরে একেবারেই ব্যাটে ছন্দে ছিলেন না তিনি। কিন্তু ফর্ম হাতড়ে বেরনো মাহি ভরসা রাখেন সহজাত ক্রিকেটবুদ্ধিতে। জানতেন, মুরলীধরনকে সামলাতে তিনিই সেরা বাজি। আর সেটাই তফাত গড়ে দেয়। ছক্কা মেরে ধোনির ব্যাট ঘোরানোর ফ্রেম হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসের জ্বলন্ত প্রতীক। নাটুকে গলায় রবি শাস্ত্রী বলে ওঠেন ‘ধোনি ফিনিশেস ইন স্টাইল’। চ্যাম্পিয়নরাই পারেন এভাবে ঝুঁকি নিতে। বিজয়ের বরমালা সেজন্যই ওঠে গলায়। ভাগ্যদেবীর আনুকূল্য তো সাহসীরাই পান। ধোনির নেতৃত্বেই ২০০৭ সালে শুরু হওয়া প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ফাইনাল ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে রুদ্ধশ্বাস জয় ছিনিয়ে নেয় ভারত।
সমালোচকরা যদিও বাঘনখ হাতে প্রস্তুতই থাকতেন। ব্যাট হাতে ব্যর্থ হলে অবধারিতভাবেই ‘ক্যাপ্টেন কুল’ হতেন রক্তাক্ত। আসলে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের ক্ষমতা কারও কারও ঈশ্বরপ্রদত্ত। ছোটবেলা থেকেই তো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই মজ্জায় মজ্জায়। অনেকবারই হতে হয়েছে বঞ্চনার শিকার। ধোনির ক্রিকেটার হওয়ার গল্পটাও অদ্ভুত। স্কুলে তিনি ছিলেন ফুটবল টিমের গোলকিপার। একদিন উইকেটকিপার আসেনি ক্রিকেট দলের। ধরে বেঁধে ধোনিকেই নামিয়ে দেওয়া হল কিপিং গ্লাভস হাতে। সেটাই পাল্টাল জীবনের গতিপথ। লম্বা চুলের মাহি মারতেন জোরে জোরে শট। ‘মাহি মার রহা হ্যায়’ স্লোগানের
উৎস সেটাই।
রোহিত আবার শুধু সাহসী নয়। দুঃসাহসী। কেরিয়ারের শেষদিকে এসে ভাঙচুর করেছেন ব্যাটিংয়ের টেমপ্লেট। শুরুতে সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে বড় ইনিংস গড়াই ছিল তাঁর স্টাইল। কিন্তু দলের স্বার্থে বিসর্জন দিয়েছেন ব্যক্তিগত উচ্চাশা। নিজের রানটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। এমন স্বার্থশূন্য ক্রিকেটারের হাতেই বিশ্বকাপ মানায়। অথচ, তাঁর ভারী চেহারা নিয়ে কম ট্রোলড হননি। সেঁটে দেওয়া হয়েছিল আনফিট তকমা। ২৯ জুনের বার্বাডোজে টি-২০ বিশ্বকাপের ফাইনাল জেতার মুহূর্তে রোহিতের মাঠে সজোরে ঘুসি মারার ছবি তাই মর্মস্পর্শী। পিচের মাটি চেখে দেখা, মেয়েকে কাঁধে বসিয়ে ভিকট্রি ল্যাপে মেতে ওঠা, ঘাসে তেরঙা ঝান্ডা গেঁথে দেওয়ার মতো সোনালি ফ্রেমগুলো জাগায় শিহরন। অথচ, কোচ দীনেশ লাড জহুরির মতো হীরে না চিনলে ক্রিকেটার হওয়াই হতো না। স্বামী বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তির জন্য উদ্যোগ নেন তিনি। তখন মুম্বইয়ে কাকার বাড়িতে থাকতেন রোহিত। কিন্তু মাসে ২৭৫ টাকা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না কাকার। যে স্কুলে পড়াশোনা করতেন সেখানে লাগত মাসিক ৩০ টাকা। অগত্যা, দীনেশ গিয়ে বলেন প্রিন্সিপালকে। তাঁর হস্তক্ষেপেই কাটে জটিলতা। প্রথমে যদিও বোলার হিসেবেই নজর কাড়েন রোহিত। কোচ জানতেনই না, অফস্পিনের পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও আগ্রহ রয়েছে নয়া ক্রিকেট শিক্ষার্থীর!
সেই সময় থেকেই নিজের উপর বিশ্বাস মারাত্মক। মার্সিডিজ দেখে কোচকে বলেছিলেন, ‘স্যার, এই গাড়িটা একদিন কিনব।’ উত্তর আসে, ‘পাগল হয়েছিস নাকি? এই গাড়ির দাম জানিস?’ রোহিতের গলা কাঁপেনি, ‘এটাই কিনব স্যার।’ কিনেওছেন তা। নেপথ্যে অবশ্য রয়েছে ঘাম-রক্ত ঝরানোর কাহিনি। প্রতিভা যতই থাক, ঘষে-মেজে শান না দিলে মরচে পড়াই যে নিয়ম!
কপিল, ধোনি, রোহিতরা নিছক নাম নন, অনুপ্রেরণা। হার-না-মানা জেদ, লড়াকু মানসিকতা, হাড়ভাঙা পরিশ্রম, ত্যাগে মিল ত্রয়ীর। সর্বোচ্চ আসরে অদম্য জেদ আর অনন্ত খিদে প্রয়োজন। তীব্রভাবে না চাইলে কোনওকিছুই যে ধরা দেয় না!