পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
আজ করি, কাল করি করে টিকিট রিজার্ভেশন করানো হয়নি। শেষমেশ গুঁতোগুঁতি করে জেনারেল কম্পার্টমেন্টেই উঠতে হয়েছে। বরাত জোরে একটা জায়গা পেয়েছেন। সেই জায়গা বেদখল হলে আরও দু’ঘণ্টার পথ বাকি। সেই দু’ঘণ্টা মণিশংকরবাবুকে ঠায় দাঁড়িয়ে যেতে হবে।
মণিশংকরবাবুর বাল্যবন্ধু অরুণের মেয়ে রাকার বিয়ে আজ। সপরিবারেই নেমন্তন্ন ছিল। কিন্তু মণিশংকরবাবুর স্ত্রী সুমনা দেবী বলেছেন, ‘তুমি একাই যাও। আমিও যাব না। মেয়েও যাবে না।’ মণিশংকরবাবুর মেয়ে রিমঝিম যাব যাব বলে নেচে উঠেছিল। কিন্তু সুমনা দেবী বললেন, ‘খবরদার। সামনের বছরই মাধ্যমিক। মাস্টারমশাই এসে ফিরে যাবেন। তাছাড়া তিনদিনের ধাক্কা। পড়ার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। অন্যায় আবদার কোরো না।’
তো শেষতক মণিশংকরবাবু একাই রওনা হয়েছেন। আজগুবিতলায় ট্রেনটার অ্যারাইভাল টাইম ছিল বিকেল চারটে। এখন রাত আটটা। ট্রেনে পাশে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বেশ আলাপ হয়ে গিয়েছিল। ওই ভদ্রলোক বারবারই বলেছেন, ‘প্রাণের মায়া থাকলে এই রাতে আর আজগুবিতলা স্টেশনে নামবেন না মশাই।’
‘কেন? আজগুবিতলাতেই তো যাচ্ছি। তা নামব কি ভণ্ডুলপুরে গিয়ে?’
‘এই তো আপনি রাগ করছেন। আমাকে ভুল বুঝছেন আপনি। আমি বলতে চেয়েছি, রাতের বেলা জায়গাটা মোটেই নিরাপদ নয়।’
‘কেন? ডাকাত, ছিনতাইকারীদের আড্ডা বুঝি?’
‘আজ্ঞে না। তা হলেও তো একটা কথা ছিল। আসলে এই রাতের বেলা এই আজগুবিতলায় তেনারা দাপিয়ে বেড়ান।’
‘তেনারা মানে? কেনারা?’
‘এই দেখ, এই এত ভেঙে বলতে হবে, তবে বুঝবেন? বুঝলেন না?’
‘বুঝেছি। আপনি ভূতপ্রেতের কথা বলছেন তো?
‘ঠিক তাই।’
‘ওসব ভূত, প্রেত, প্রেতাত্মা আমি মানি না। বুঝলেন কিছু?’
‘আপনি না মানলেও তেনারা আছেন।’
‘আপনি দেখেছেন?’
‘আমি আজগুবিতলায় নামলে তো দেখব। আমাকে কি পাগলা কুকুর কামড়েছে মশাই। আপনি নামছেন। আপনি দেখতে পাবেন।’
মণিশংকরবাবু ভাবেন, মানুষের কি অন্ধবিশ্বাস! লোকটা দরজা খুলতে দিচ্ছিল না। নাকি তেনারা ট্রেনে উঠে পড়বে। মানে ভূতও ট্রেন জার্নি করবে। ট্রেনে উঠে সবার ঘাড় মটকে, পিণ্ডি চটকে খাবে।
আজগুবিতলা স্টেশনে নামার পরে মণিশংকরবাবুর মনে হচ্ছে, ওই ভদ্রলোকের কথাই কি তাহলে সত্যি? জায়গাটা ভূতের ডেরা বলেই কি রাত আটটা সোয়া আটটায় এতটা নিঃঝুম হয়ে গেল? স্টেশন চত্বরে তো একটা দুটো দোকান খোলা থাকবে। প্যাসেঞ্জারের জন্য দু’-একটা রিকশ থাকবে অন্তত। কিন্তু, এ তো দেখছি চারদিকে শুধুই ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।
এই অন্ধকারে মণিশংকরবাবু দিক ঠিক করে উঠতে পারছেন না। ডানদিকে যাবেন না বাঁদিকে যাবেন। নিজেই অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন খানিক। ঠিক তখনই তিনি দেখলেন, তাঁর দিকে একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। দেখে মণিশংকরবাবুর কলজে হিম হয়ে গেল। এ তো তাঁর দিকে ভূত এগিয়ে আসছে। তিনি রীতিমতো ঘামতে লাগলেন। ছায়ামূর্তিটা একেবারে কাছে এসে কথা বলে উঠল। ‘বাবু, আপনি কোথায় ছিলেন? আমি আপনেরে সারা পেলাটফম্মে খুঁজে আলাম। আর আপনে একেনে দাঁড়ায়ে।’ মণিশংকরবাবুর ঘাম দিয়ে জ্বর সারল। বললেন, ‘তুমি গুপি না?’
‘হ্যাঁ তো। আমি গুপে। বাবু আমারে সেই বিকেলে টিশানে পাঠালেন। বললেন, গুপে তুই তো আমার বন্ধু মণিবাবুকে ভালোই চিনিস। আমি বললাম, সে আর বলতে? সে মুখ কি ভোলা যায়? তা সেই তখন তে টিশানে একঘুম দে উঠলাম। টেরেন তো লেট। আমি ওই বেঞ্চিতে টানটান হলাম। টেরেনের শব্দে ঘুম ভাঙল। কিন্তু, আপনে এখানে, আমি সেই কোন মুলুক খুঁজে আলাম। দ্যান সুটকেস আমারে দ্যান। রিকশ তো পাবা যাবে না। হেঁটি যেতে হবে।’ মণিশংকরবাবু বললেন, ‘কী আর করা যাবে? হেঁটেই চল।’
গুপির সঙ্গে হাঁটতে লাগলেন মণিশংকরবাবু। অন্ধকারে গুপির গায়ের সাদাজামা ফলো করে হাঁটছেন। খানিক যাওয়ার পরে মণিশংকরবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ রে গুপে, এখানে নাকি খুব ভূতের উৎপাত?’
‘টেরেনে সব বলাবলি কচ্ছিল নাকি?’
‘হ্যাঁ, আমাকে তো ভয় ধরিয়ে দিচ্ছিল।’
‘সব বাজে কথা। ওসব বলে বলে জায়গাটার বদনাম করে দিয়েছে। এই তো আপনি অন্ধকারেই হাঁটছেন। ভূত কি আপনের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ছে? তবে কি না অনেকের মুখে শুনিছি, তারা নাকি ভূতের খপ্পরে পড়েছে। সে আমি বিশ্বেস যাইনে। ভূত ধরল, তা কি আদর করে ছেড়ে দ্যালো?’
দূর থেকে বিয়েবাড়ির সানাই শোনা যাচ্ছে। গুপি বলল, ‘খাসির মাংসের যা ঘেরান দেচ্ছেল তখন। জিভে জল এসে যাচ্ছেলো। আর ব্যানপাটি যা তাল তুলেছে কী বলব।’
দূর থেকেই বিয়েবাড়ির আলো দেখা গেল। মণিশংকরবাবু বললেন, ‘যাক এসেই তো গেলাম। ভাগ্যিস তুই ছিলি।’ গুপি এবার আমতা আমতা করে বলল, ‘বাবু, আপনি ভয় পাবেন, তাই বলিনি। টিশানে কিন্তু ভূতের আড্ডা আছে।’
‘আমি তো আগেও এসেছি। কই ভূতের কেত্তন তো এই প্রথম শুনছি।’ গুপি বলল, ‘আগে তো দিনমানে এসেছেন, দিনমানে চলে গেছেন। রাত্তিরে টিশানে ভূতেরা গুলজার করে।’
দূর থেকে বিয়েবাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। বাড়ির কাছকাছি এসে গুপি বলল, ‘এবার আপনের সুটকেসটা নেন বাবু। আমি আলোর কাছে যেতে পারব না।’
‘কেন? আলোর কাছে যেতে পারবি না কেন?’
‘আপনি চেনা লোক তাই আমি আপনেরে গাড দে নে আলাম। আমরা আলোয় যাই না বাবু,’ বলেই গুপি মিলিয়ে গেল।