পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। ইতালি পরাজিত। যুদ্ধবন্দি হয়ে নির্বাসনে যেতে হল তাঁকেও। মুক্তি পাওয়ার পর দেশে ফিরে শুরু করলেন নিজের ব্যবসা। একটা ছোট্ট গ্যারেজ, সেখানে মেরামত করতেন মোটরসাইকেল, গাড়ি। কিন্তু অত ছোট গ্যারেজে কী তাঁকে আটকে রাখা যায়! কাজে লাগালেন পুরনো পরিচিতি। সামরিক বাহিনীর অতিরিক্ত যন্ত্রপাতি কিনে তৈরি করলেন ট্রাক্টর ‘ক্যারিওকা’। ১৯৪৭ সালে ইতালির সেন্টো শহরে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি ট্রাক্টর কোম্পানি। ‘ক্যারিওকা’ ছিল ফেরুচো ল্যাম্বরগিনির প্রথম সাফল্য। ফেরুচো বুঝতে পেরেছিলেন, ইতালির মতো কৃষিপ্রধান জায়গায় ট্রাক্টরের চাহিদা রয়েছে। ক্রমশ ক্যারিওকার সুনাম বাড়ল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পেট্রলের দাম আগুন। ফেরুচো তৈরি করলেন ডিজেল চালিত ট্রাক্টর। সাফল্য ফেরুচোর আত্মবিশ্বাসকে আরও বাড়ায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইতালির ক্রমশ চাঙ্গা হয়ে ওঠা অর্থনীতির কারণে অল্প সময়েই বিশাল লাভের মুখ দেখে ফেরুচো ল্যাম্বরগিনির ট্রাক্টর কোম্পানি।
একটি নেশা মাথায় ঢোকে তাঁর। বিভিন্ন কোম্পানির বিলাসবহুল সব গাড়ি সংগ্রহ করা। গাড়িপ্রেমী ফেরুচোর গ্যারেজে তখন জাগুয়ার, মার্সেডিজ বেঞ্জ... একাধিক নামী কোম্পানির গাড়ি। এক এক সপ্তাহে এক একটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। ফেরুচোর স্পোর্টস কারের প্রতি দুর্বলতা ছিল বেশি। স্পোর্টস কারগুলির মধ্যে ছিল দু’টি ফেরারি ২৫০ জিটি। কিন্তু তিনি ফেরারি স্পোর্টস কার চালাতে গিয়ে খুঁজে পেলেন ত্রুটি। তাও আবার ক্লাচে। তাছাড়া গাড়িটি অনেক বেশি শব্দ তৈরি করে এবং সাধারণ রাস্তায় চালানোর জন্য খুব একটা উপযোগীও নয়।
এনজো ফেরারি তখন ইউরোপের বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা, তাঁর নামেই কোম্পানির নাম। এনজোর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে ১৯৬২ সালে ফেরুচো মারান্যালোতে ছুটে যান। দেখা করার সুযোগও মিলে যায়। ফেরুচো যখন ক্লাচ নিয়ে কথা বলা শুরু করেন, তখন এনজো তাচ্ছিল্যের সুরে তাঁকে থামিয়ে বলেন, ‘ক্লাচের কোনও সমস্যা নেই। হয়তো আপনি ফেরারি চালাতে পারেন না এবং ক্লাচ ভেঙে ফেলেছেন। সমস্যাটা গাড়ির নয়, সমস্যা ড্রাইভারের। আপনি বরং ট্রাক্টর নিয়েই থাকুন।’ প্রচণ্ড অপমানিত হয়েছিলেন ফেরুচো।
অপমানের জবাব দিতে ইতালির ছোট্ট শহর সান্ত’আগাতায় নিজের নামেই তৈরি করে ফেললেন একটি গাড়ির কারখানা। ছোটবেলা থেকেই ষাঁড়ের লড়াইয়ের প্রতি প্রবল আকর্ষণ থাকায় কোম্পানির লোগো হিসেবে একটি তেড়ে আসা ষাঁড়কেই বেছে নেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর কোম্পানি যতগুলি গাড়ি তৈরি করেছে, তার বেশির ভাগেই নাম রাখা হয়েছিল কোনও না কোনও বুল বা বুল ফাইটিং কেন্দ্রিক। নতুন কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন জিয়োত্তো বিৎজারিনি, ফ্রাঙ্কো শ্যাগলিয়ন ও জান পাওলো দালে। এঁরা তিনজনই ফেরারির প্রাক্তন কর্মচারী। মাত্র চার মাস! তৈরি হয়ে গেল দ্রুতগতির ভি১২ ইঞ্জিনের প্রথম গাড়ি, ‘ল্যাম্বরগিনি ৩৫০ জিটিভি’ (পরে হয় জিটি)। ১৯৬৩ সালে আত্মপ্রকাশ করল ‘তুরিন মোটর শো’-এ। প্রশংসা পেল সংবাদমাধ্যমের।
ফেরুচো ছিলেন একজন পাক্কা জহুরি। তিনি ল্যাম্বরগিনি গাড়ির ডিজাইন করার জন্য নিয়োগ করেন বহু আইকনিক গাড়ির ডিজাইন করা কোম্পানি ‘কারোজেরিয়া তুরিং’কে। যে গাড়ির জন্য ল্যাম্বরগিনির নাম গোটা দুনিয়া জানতে পারে, তা হল ‘মিউরা’। ১৯৬৬ সালে প্রথম এমন এক গাড়ি হাজির করে, যাকে আক্ষরিক অর্থেই ‘সুপারকার’ বলা হয়। এই প্রথম গাড়ির ইঞ্জিন সামনে না রেখে গাড়ির পিছনের দিকে রাখা হয়।
কিন্তু বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং তেলের সঙ্কটের কারণে ট্রাক্টর ব্যবসা মন্দায় ডুবে যাচ্ছিল এবং সেই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ফেরুচো তাঁর সাধের ‘ল্যাম্বরগিনি কোম্পানি’ একটি সুইস গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেন। সালটা ১৯৭২। ১৯৯৩ সালে ৭৬ বছর বয়সে ফেরুচো মারা যান। ফেরুচোর জমানা শেষ হলেও, একটা অপমানের প্রতিশোধ কী রকম কাজের মাধ্যমে নেওয়া যেতে পারে, গোটা দুনিয়া তার সাক্ষী রইল।