উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। জমে উঠল বন্দ্যোপাধ্যায় দম্পতির সুখের সংসার। আর সেই দৃশ্য দেখে বিধাতা বোধহয় একটু মুচকি হেসেছিলেন, হয়তো মনে মনে বলেছিলেন, বিভূতিভূষণ, সুখ নয় , তোমাকে আমি পৃথিবীতে পাঠিয়েছি সৃষ্টি করার জন্য, সুখভোগের অধিকারী তুমি নও! তুমি আমৃত্যু দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত থেকে সৃষ্টি করবে কালজয়ী রচনা। তোমাকে পৃথিবী মনে রাখবে তোমার সৃষ্টির জন্য।
আবার এল আঘাত। সেই আঘাতে এবার স্বামী-স্ত্রী দুজনেই দীর্ণ হলেন। তবে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে স্বামী সেই অসম্ভব শোককে চেপে রাখলেন নিজের বিশাল হৃদয়ে। কিন্তু স্ত্রী! শোকে তিনি মগ্ন হলেন। কল্যাণীদেবী তখন সন্তান সম্ভবা। পরবর্তীকালে রমা (কল্যাণী) বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ভয়ঙ্কর দিনটির বর্ণনা লিখে রেখে গিয়েছেন তাঁর বিখ্যাত ‘কাছে থেকে দেখা’ গ্রন্থে। তিনি লিখছেন, ‘ধাত্রী মাসীমা প্রত্যহই এসে একবার দুবার আমাকে দেখে যেতেন কিন্তু পালে বাঘ পড়ার দিন হল অন্য ব্যাপার।
সেদিন সকালবেলা থেকে হঠাৎ আমার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেল। মাসীমা ধাত্রী মাসীমার কাছে লোক পাঠালেন। কিন্তু মাসীমা এলেন না আবার জোর তলব পাঠান হল। মাসীমা আমাকে ধরে ভগবানকে ডাকতে লাগলেন।...আমার কন্যাটি ভূমিষ্ঠ হল। ডাক্তারবাবু, মাসীমা আর ধাত্রীমাসীমার কথাবার্তায় বুঝলুম— যে সন্তান জন্ম নিল আমার বত্রিশ নাড়ী ছিঁড়ে— সে মৃত।
আমি অবুঝের মত কেঁদে উঠলাম — ডাক্তারবাবু, আপনারা তো কত কায়দা জানেন। আমার খুকীকে বাঁচান ডাক্তারবাবু! ঠান্ডা জল গরম জলে ডোবান ওকে। আমার মনকে বোঝাবার জন্য ওঁরা সবই করলেন। কিন্তু বাচ্চাটির মৃত্যু হয়েছিল আমার দেহের ভেতরেই। কয়েক ঘণ্টা আগেই।’
বাচ্চাটি মারা যাওয়ার পরের দিন রাত্রেই বিভূতিভূষণ স্ত্রীকে লাইব্রেরি থেকে দুখানি বই এনে দিয়েছিলেন। সেই দিনের কথা পরবর্তীকালে স্মরণ করেছেন রমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লিখছেন,‘ খুকীটি মারা যাবার পরের দিন রাত্রিতেই উনি দুখানা বই এনে দিয়েছিলেন লাইব্রেরি থেকে, আজও মনে আছে। তার মধ্যে একখানা ‘And Quiet Flows the Don’ এর অনুবাদ। খুব ভালো লেগেছিল বইখানা। আমার মনের গভীর বেদনার দিনের সঙ্গী হয়েছিল ওই বইখানি। আজও যখনি বইখানি হাতে পড়ে, তখনি মনে পড়ে সেই বেদনায় নীল দিনগুলির কথা। মাথাধরা নিয়েই ভুলে থাকবার জন্য বই পড়ে যেতাম। বহু চিকিৎসায় ছ-সাতদিন বাদে মাথার যন্ত্রণা কমে।’
দুই
মৃত্যুর পরের জগৎ সম্পর্কে বিভূতিভূষণের আগ্রহ ছিল প্রবল। তিনি মৃত্যুকে বলতেন মানবজীবনের একটা রূপান্তর। মানুষের মৃত্যুর পরের জগৎ আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। তাই বলে একথা ঠিক নয় যে, মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ হয়ে যায়।
বিভূতিভূষণ ও রমাদেবীর সন্তান বাবলু (তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়) তখন খুব ছোট। সেইসময় তিনি মারাত্মক টাইফয়েডে আক্রান্ত হন। তাঁর জ্বর কিছুতেই কমছে না। পালা করে স্বামী-স্ত্রী ছেলের পাশে বসে থাকতেন। একদিন কল্যাণী দেবী স্বামীকে ছেলের পাশে বসিয়ে স্নান করতে গিয়েছেন। স্নান সেরে ফিরে আসার পর তাঁর বাড়ির পরিবেশটা কেমন অস্বাভাবিক লেগেছিল। তাঁর মনে হয়েছিল বাবলুর কিছু হয়েছে। রমা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, ‘ঘরে ঢুকে আমি দেখলাম উনি দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছেন বাবলুর শিয়রের পাশে। তাকিয়ে আছেন শূন্যদৃষ্টিতে। কেমন যেন শক্তিহীন, বিবর্ণ মানুষ।... কোন সুদূর থেকে যেন উনি ক্ষীণ গলায় কথা বলছেন— জানো কল্যাণী, তুমি চলে যাওয়ার পরে আমি একটা কাণ্ড করেছি।
আমি অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকালাম। উনি বললেন— আমি নির্দেশ পেলাম, বাবলুর এ অসুখের মোড় ঘুরিয়ে দিতে হলে আমার আয়ু বাবলুকে দান করতে হবে। কে যেন আমাকে বলছে— তুমি পারবে তোমার আয়ু দান করতে? তাহলে বাবলু নীরোগ হয়ে দীর্ঘজীবী হবে—
অবাক হয়ে আমি বললাম— তুমি কী করলে?
উনি বললেন— আমি মনে মনে বললাম— ‘বাবলু আমার প্রাণ অপেক্ষা প্রিয়। বলুন কি করতে হবে? আমার আয়ু দিয়ে যদি আমার বাবলু ভালো হয়ে ওঠে তাহলে আমি তাই করব এখুনি।’
নির্দেশ পেলাম— তোমার দুই পা তোমার ছেলের মাথার ওপর রেখে একমনে প্রার্থনা কর যে, তোমার আয়ু সবটুকু ওকে তুমি দান করলে।
আমি তাই করলাম। দুই পা বাবলুর মাথায় ছুঁইয়ে বললাম— আমার সবটুকু আয়ু আমি ছেলেকে দিয়ে দিলাম। এই আয়ুর বদলে ওকে তুমি দীর্ঘজীবী কর ঈশ্বর।.... এরপরে উনি কিন্তু বেশিদিন বাঁচেননি। বড়জোর মাস আটেক কি বছর খানেক।’
এর কিছুদিন বাদেই ঘাটশিলার এঁদেলবেড়া হ্রদের কাছে কয়েকজন বন্ধু মিলে বিভূতিভূষণ বেড়াতে গিয়েছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে সকলে দেখেন বনের গভীরে একটা আলো জ্বলছে। সবাই মিলে ঠিক করলেন, ওখানে তো কোনও লোকবসতি নেই তাহলে কীসের আলো?
অন্যরা বারণ করা সত্ত্বেও বিভূতিভূষণ সেই আলোর সন্ধানে একাই চলে গিয়েছিলেন।
রমা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, ‘উনি এগিয়ে গিয়ে কি দেখে নাকি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন জোরে। আর্তরব উঠেছিল ওঁর মুখ থেকে।
সেই চিৎকার শুনে দু-চারজন এগিয়ে গিয়ে দেখেন ওখানে একটি পরিষ্কার জায়গায় একটি কলসী। পাশেই খাটিয়ায় একটি মৃতদেহ আর দাহকার্যের নানাবিধ উপাচার। প্রদীপ জ্বলছে। মৃতদেহের মুখের কাপড় সরে গিয়েছিল। তাই দেখে উনি চীৎকার করে উঠেছিলেন। কার মুখ দেখেছিলেন উনি সেই মৃতদেহের মুখের কাপড় সরে গেলে? নিজের? সেইরকমই আভাস দিয়েছিলেন বন্ধুদের। (নিজের প্রতিরূপ বা দ্বিতীয় সত্তা দেখতে পাওয়ার ঘটনা বিরল হলেও ইতিহাসে প্রাপ্তব্য। কবি গ্যোটে নিজের অশ্বারোহী প্রতিমূর্তি দেখেছিলেন। এর কিছুদিন বাদেই তাঁর মৃত্যু হয়। জর্মন ভাষায় একে বলে Doppelganger। কথিত আছে মহাপুরুষদেরই কেবল এমন হয় এবং এরূপ দর্শনের পর তাঁরা বেশিদিন জীবিত থাকেন না।)’
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তিনি যেদিন চিরতরে চলে গেলেন সেই দিনটি ছিল তেরশো সাতান্ন সালের পনেরোই কার্তিক, বুধবার। সময় রাত আটটা পনেরো মিনিট।
(ক্রমশ)
ছবি: মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে
অলংকরণ: চন্দন পাল