উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
আর সেইজন্যই হয়তো পরলোকতত্ত্বে ষোড়শীকান্তের ছিল অসম্ভব বিশ্বাস। আর জামাতা বিভূতিভূষণের ছিল দেহ ও দেহান্তরিত আত্মা সম্পর্কে প্রবল জিজ্ঞাসা। শেষপর্যন্ত এই একটি কারণেই দুই অসমবয়সি মানুষ একজায়গায় এসে একত্রিত হলেন। গড়ে উঠল সুন্দর এক পারিবারিক সম্পর্ক। এরপর আর কোনও ‘কিন্তু’ বা ‘বাধা’ রইল না।
কিন্তু বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তো তান্ত্রিক ছিলেন না! তাহলে তিনি কেন আকৃষ্ট হলেন এই অলৌকিক জগতের প্রতি! দেহ ও দেহান্তরিত আত্মা সম্পর্কে তাঁর জিজ্ঞাসা কেন এত প্রবল হয়ে উঠেছিল! এইসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের একবার কিছুক্ষণের জন্য ফিরতে হবে আরও একটু অতীতে— রিপন কলেজের (অধুনা যে কলেজটি সুরেন্দ্রনাথ কলেজ নামে পরিচিত) সেইসব দিনগুলিতে। বিভূতিভূষণ তখন কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তাঁর সঙ্গে হঠাৎই বিয়ে হল বসিরহাট মহকুমার পানিতর গ্রামের জমিদার ও মোক্তার কালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যা গৌরীদেবীর। দিনটি ছিল বত্রিশে শ্রাবণ, তেরশো চব্বিশ সন, ইংরেজি উনিশশো সতেরো সাল।
এই দাম্পত্য জীবন কিন্তু মোটেই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ঠিক ষোলো মাসের মাথায় পুজোর পর পরই একই দিনে আগে মা কামিনী দেবী এবং তার কিছুক্ষণ পরেই চলে গেলেন মেয়ে গৌরী দেবী। মহামারীর আকারে সেবার বাংলায় প্রবেশ করেছিল ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো এক জ্বর। সেই জ্বরে কিছুক্ষণের তফাতে একই পরিবার থেকে অকালে ঝরে গেল দুটি প্রাণ।
শ্বশুরবাড়ি পানিতর থেকে শ্বশুরমশাই কালীভূষণ মেয়ের অসুস্থতার খবর দিয়ে লোক পাঠিয়েছিলেন জামাইয়ের কাছে। খবর পেয়ে বিভূতিভূষণও রওনা হয়েছিলেন পানিতরের পথে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখলেন মৃতা মায়ের কোলের কাছে চিরঘুমে ঘুমিয়ে আছেন তাঁর কিশোরী বধূ গৌরীও, পরণে রয়েছে পুজোর আগে তাঁরই দেওয়া আটপৌরে শাড়িটি। বিভূতিভূষণের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি ক্রমশ ডুবতে শুরু করলেন শোকের অতল গহ্বরে। পড়াশোনা মাথায় উঠল। দিন-রাত তিনি ঘুরে বেড়ান পথে পথে। এমনই এক দিনে তিনি খবর পেলেন তাঁর ছোট বোন মণিও সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা গিয়েছেন। আঘাতের পর আঘাত। শোকে বিদীর্ণ হয়ে গেলেন বিভূতিভূষণ।
এমনই কঠোর কঠিন সময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হল এক সাধকের। বিভূতিভূষণ সেদিন উদভ্রান্তের মতো টালিগঞ্জের খালটা পার হয়ে হেঁটে চলেছেন পুঁটিয়ারির দিকে। হঠাৎই তিনি দেখতে পেলেন সেই জটাজুটধারী সৌম্য সন্ন্যাসীকে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। মন হয়তো বলেছিল, যাও ওই সন্ন্যাসীকে প্রণাম করে তাঁর চরণে নিজেকে সমর্পণ কর, ওখানেই পেতে পার একটু শান্তি।
বিভূতিভূষণ মনের কথা শুনে সন্ন্যাসীকে প্রণাম করে তাঁর পায়ের সামনে বসে পড়লেন। সৌম্য সন্ন্যাসী তাঁকে আশীর্বাদ করে বললেন, বেটা, মনে বড় কষ্ট তাই না!
বিভূতিভূষণ মাথা নাড়লেন।
সন্ন্যাসী বললেন, তোর বউ ক’দিন আগেই তো মারা গিয়েছে। তাকে তোর খুব দেখতে ইচ্ছা করে! তাকে দেখবি?
বিভূতিভূষণ বললেন, বাবা, আমি কী তাকে সত্যি দেখতে পাব?
সন্ন্যাসী বললেন, গীতা পড়িসনি! স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ সেখানে বলেছেন আত্মা অবিনশ্বর।
বিভূতিভূষণ যেন হাতে চাঁদ পেলেন। তিনি বললেন, বাবা, আমার বউকে আমি দেখতে চাই। কিন্তু কীভাবে দেখব!
সন্ন্যাসী বললেন, কেন প্ল্যানচেটে।
পরপর কয়েকদিন সন্ন্যাসীর কাছে গিয়ে বিভূতিভূষণ শিখে নিলেন প্ল্যানচেটের গূঢ়তত্ত্ব।
তারপর শুরু হল তাঁর চক্রাধিবেশন। অনেকগুলো দিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে তিনি মেতে রইলেন পরলোকে হারিয়ে যাওয়া তাঁর প্রিয়জনদের নিয়ে।
মানসিক দিক থেকে তখন অনেকটাই শান্ত বিভূতিভূষণ। একদিন তিনি সেই সন্ন্যাসীর খোঁজে আবার গেলেন পুঁটিয়ারি। কিন্তু কোথায় সেই সন্ন্যাসী। তাঁর শূন্য আস্তানায় খালি পড়ে আছে সন্ন্যাসীর অব্যবহৃত কিছু সামগ্রী। বিভূতিভূষণ আশেপাশে অনেকের কাছেই সেই সন্ন্যাসীর সন্ধান করলেন। অনেকেই বললেন, তিনি তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়েছেন। নিজ আস্তানায় ফিরে এলেন হতাশ বিভূতিভূষণ। তারপর তাঁর আর বোধহয় সেই সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হয়নি । তিনি অশান্ত বিভূতিভূষণকে শান্ত করে বেরিয়ে পড়েছিলেন আরও কোনও অশান্ত মানুষের সন্ধানে। কারণ তাঁর হাতেই তো রয়েছে শান্তির বারিধারা।
কেন দেহ ও দেহান্তরিত আত্মা সম্পর্কে তাঁর জিজ্ঞাসা এত প্রবল হয়ে উঠেছিল সেই কারণটা আমরা জানতে পারলাম। তাহলে আবার আমরা ফিরে যাই অসমবয়সি দুই মানুষ ষোড়শীকান্ত ও বিভূতিভূষণের সেই আসরে।
মাননীয় কিশলয় ঠাকুর ‘পথের কবি’ গ্রন্থের একজায়গায় লিখছেন, ‘প্রেততত্ত্ব নিয়ে এক–একদিন গভীর রাত্রি পর্যন্ত আলোচনা। মাঝে মাঝে চক্রাধিবেশন। দুজনেই মেতে উঠলেন নতুন উৎসাহে। গড়গড়ার নল সমানে চাটুজ্যে-বাঁড়ুজ্যের হাতে হাতে ঘুরে আসর জমাটি।’
তখনও চাটুজ্যে-বাঁড়ুজ্যে কেউই কাউকে চিনতেন না। কিন্তু ললাটের লিখন বড়ই রহস্যময় । একসময় যাঁর অধীনে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় চাকরি করেছেন, সেই খেলাত ঘোষ এস্টেটের ভাগলপুর কাছারির সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন ষোড়শীকান্তের শ্বশুরমশাই সারদাকান্ত চক্রবর্তী, আরণ্যকের সারদাকান্ত। অবসর সময়ে সারদাকান্ত বিভূতিভূষণকে শোনাতেন তাঁর কর্মজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। এই গল্প করতে করতে সারদাবাবু বিভূতিভূষণকে শুনিয়েছিলেন তাঁর তন্ত্রসাধক জামাতার জীবন ও তন্ত্রসাধনার কথা। গল্পশুনে খুব খুশি হয়েছিলেন বিভূতিতভূষণ। অচেনা, অদেখা সেই তন্ত্রসাধক মানুষটি সম্পর্কে তিনি আরও অনেক কথা জানতে চাইতেন চক্রবর্তীমশাইয়ের কাছে। সারদাকান্তও তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। তাই অধীনস্থ হলেও তিনি মেনে নিতেন বিভূতিভূষণের সমস্ত আবদার। প্রায়ই শোনাতেন তাঁর জামাতার কাহিনী।
লেখক বিভূতিভূষণ বড় হয়েছেন প্রকৃতির কোলে, লিখতেন প্রকৃতির গন্ধ মাখা মিষ্টি লেখা। সেই অসামান্য কথাসাহিত্যিক একদিন হবু দাদা শ্বশুরের মুখে ভাবী শ্বশুরের কাহিনী শুনে ‘তারানাথ তান্ত্রিক’-কে নিয়ে লিখে ফেললেন দুটি গল্প। কিন্তু তারপর তাঁর কলম আর কখনও এই তান্ত্রিককে চরিত্র করে কোনও গল্প লেখেনি। আসলে তাঁর জীবনটাও ছিল বড়ই সংক্ষিপ্ত। তিনিও আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো নিজের মৃতদেহ দর্শন করেছিলেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিজের মৃতদেহ দেখেছিলেন নিদ্রিত অবস্থায়, আর বিভূতিভূষণ সজ্ঞানে, এঁদেলবেড়া হ্রদের কাছে।
অলংকরণ: চন্দন পাল