উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
পান্তু নাগের গোপন ডেরায় যাচ্ছে সে। কেন জানি, খুব জরুরি তলব দিয়েছে পান্তু।
এলাকার মুকুটহীন-সম্রাট রামতনু শিকদারের বাঁ হাত হল পান্তু নাগ। মানুষজন জলশৌচ জাতীয় যাবতীয় নোংরা-ঘাঁটা কাজগুলো তো বাঁ হাত দিয়েই করে। সেই হিসেবে পান্তু রামতনুর বাঁ হাতই।
সদর-বাজার বরাবর হাঁটতে হাঁটতে আচমকা পাশের ল্যাম্প-পোস্টের গায়ে সাঁটানো একটা পোস্টার দেখে বেশ অবাক হয়ে যায় শুখা। মজাও পায় খুব।
পোস্টারটায় একটা হাতে-আঁকা ছবি। ছবির মুখটার সঙ্গে শুখার মুখের বলতে গেলে বারোআনা মিল। প্রথম নজরে তো চমকেই উঠেছিল শুখা। তার ছবি এখানে টাঙালে কে! কিন্তু একটুখানি খুঁটিয়ে নজর করতেই বুঝতে পারে, প্রথম-দর্শনে বেশ মিল খুঁজে পেলেও, ছবিটা অন্য কারোর।
ছবিটা এখানে টাঙিয়েছে পুলিস। বলা হয়েছে, লোকটার সন্ধান দিতে পারলে পুরস্কৃত করা হবে।
তার মানে, ছোকরা হারিয়ে গিয়েছে, বাড়ির লোক পুলিসে ডায়েরি করেছে। পুলিসও রুটিন মাফিফ লোকটার ছবি ছাপিয়ে টাঙিয়ে দিয়েছে সর্বত্র। পুলিস তো এই ধরনের কাজ করেই থাকে। কিন্তু হাতে-আঁকা ছবি কেন? কে জানে! হয়তো ছোকরার কোনো ফোটো নেই ওদের বাড়িতে।
এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে শুখা একসময় পা চালিয়ে হাঁটা দেয় পান্তু নাগের গোপন ডেরার দিকে।
ডান চক্ষুটি ততক্ষণে নাচতে শুরু করেছে শুখার। কারণ, গোপন ডেরায় পান্তুদার জরুরি তলবের মানেটা তো সে বিলক্ষণ জানে। আবার একটা বায়না পেতে চলেছে নির্ঘাত।
মাত্র মাসটাক আগেই একটা কাজ নামিয়েছে সে। লোকটা এমন-কিছু কেউকেটা ছিল না বলেই মনে হয়েছিল শুখার। সাধারণ পোশাক-পরা কারখানার লেবার গোছের লোক। কিন্তু তাকে খালাস করবার বিনিময়ে যে-পরিমাণ মাল পেয়েছিল, অনেক ভিআইপি আদমিকে খালাস করেও অতখানি পায়নি সে। একটুখানি অবাক তো হয়েছিলই। কিন্তু ওই অবধি। ওদের লাইনে মুরগিকে নিয়ে মনের মধ্যে বেশি কৌতূহল থাকাটা বারণ। মুরগিটাকে পরিপাটি করে নিকেশ করে দাও, মালকড়ি বুঝে নাও, কিছুদিন গা-এড়িয়ে হাঁটাচলা করো, কিস্যাটা থিতিয়ে গেলে পুনরায় যথা পূর্বম তথা পরম।
একমাসের মধ্যে পরপর দুটো কেস পেয়ে মনটা খুশিতে নাচতে থাকে শুখার।
২
গোপন ডেরা হলেও সাধারণত পান্তুর সঙ্গে দু’একজন চেলা-চামুণ্ডা থাকেই। কিন্তু পান্তুর ডেরায় পৌঁছনো মাত্র শুখা টের পায়, ডেরাটা এক্কেবারে শুনশান। ডেরার এককোণে একলাটি গম্ভীর মুখে বসে রয়েছে পান্তু। তাতেই শুখা বুঝে ফেলে, তার এতক্ষণের আন্দাজটাই ঠিক। নির্ঘাত একটা বায়না পেতে চলেছে সে।
কাউকে বায়না দেবার বেলায় ডেরাটাকে এক্কেবারে ফাঁকা করে নেয় পান্তু। এটাই তার দস্তুর। কাকে কোন কাজের বায়নাটি দেওয়া হল, তা তৃতীয় কেউ জানতেই পারে না। এই যেমন, শুখাও জানে না, গেল তিন মাসে যতগুলো লাস পড়েছে এই তল্লাটে, পুরোটাই পান্তু নাগের টিমের লোকজনই করেছে, নাকি খোঁড়া-বাবুলের টিমও! এই যেমন গেল-মাসে বর্মণ-জুয়েলারিতে যে দুঃসাহসিক ডাকাতিটা দিনে-দুপুরে হয়ে গেল, সেটা পান্তু নাগের টিমের কাজ, নাকি অন্য কারোর, শুখা তাও নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না। পান্তু নাগদের এই লাইনে এটাই চিরকেলে দস্তুর। ডানহাতের কাজটি বামহাতও জানতে পারে না।
শুখা সুখবরটা শোনার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হয়।
বেশ থমথমে মুখে বসে ছিল পান্তু নাগ। শুখাকে দেখামাত্র চোখদুটো বুঝি ধক করে জ্বলে ওঠে। অল্প সময়ের জন্যে শুখার মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় সে। পরক্ষণে দ্বিগুণ জোরালো আলো ফেলে বলে ওঠে, কোন পথ ধরে এলি?
—কেন, সদর-বাজার দিয়ে।
—কিছু দেখিসনি?
—কী দেখব?
—তোর ছবির পোস্টারে যে ভরে গিয়েছে গোটা শহর। সদর-বাজারে তেমন কোনও পোস্টার পড়েনি?
—কী আশ্চর্য! বিস্ময়ে বুঝি ফেটে পড়তে চায় শুখা, ওটা আমার ছবি কেন হবে? তবে আমার মুখের সঙ্গে বেশ মিল রয়েছে।
অল্পক্ষণ গুম মেরে বসে থাকে পান্তু। একসময় হিসহিসে চাপা গলায় বলে, ওটা তোরই ছবি। পুলিসের আর্টিস্ট এঁকেছে তো। একটু উনিশ-বিশ হয়ই।
—যাহ , পুলিস আমার ছবি আঁকাতে যাবে কেন? বুকের ভেতরটায় গুরুগুরু কাঁপুনিটা শুরু হলেও বেশ জাঁক করে বলে শুখা, আমার খোঁজ ওরা পেতেই পারে না। ঠায়-দুপুরে ঘোড়াডাঙার জঙ্গলে, গাছের আড়াল থেকে যখন গুলি দুটো চালিয়েছিলাম, কাছেপিঠে মানুষজন তো দূরের কথা, ত্রিসীমানায় একটা পাখি-পাখালও ছিল না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটা ঢলে পড়েছিল মাটিতে। আমি তৎক্ষণাৎ স্পট ছেড়েছিলাম।
—সেসব ঠিকই আছ, কাজ তোর সব সময়ই বেশ নিখুঁত। তবে এক্ষেত্রে গজবটা হয়েছে অন্যত্র।
—গজব মানে? শুখা স্থির পলকে তাকিয়ে থাকে পান্তুর মুখের দিকে।
—গজব মানে, সেমসাইড হয়ে গিয়েছে। রুলিংপার্টিরই একটা গোষ্ঠী আমাদের লাগিয়ে নিজের দলেরই অন্য গোষ্ঠীর লোককে মার্ডার করিয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা হল, লোকটা ছিল রুলিং পার্টির বেশ পপুলার একজন ট্রেড-ইউনিয়ন লিডার। লেবারদের মধ্যে বেশ প্রভাব ছিল লোকটার। সেই কারণেই পার্টির ওপর মহলের নির্দেশে পুলিস উঠে পড়ে লেগেছে। নইলে...
বেশ কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে থাকে পান্তু। একসময় সরাসরি চোখ রাখে শুখার চোখে। ঝাঁ করে শুধিয়ে বসে, মার্ডারটা করবার পর তুই লোকটার ব্যাগ-ট্যাগ হাতড়েছিলি কেন? পান্তু নাগ এই মুহূর্তে শিকারের পানে তাকিয়ে থাকা পলকহীন বাঘ যেন। তাছাড়া, তুই লোকটার বাড়িতে অবধি গিয়েছিলি! কেন?
পান্তু নাগের মুখে কথাগুলো শোনামাত্র শুখার পায়ের তলায় মেঝেটা যেন নিঃশব্দে কেঁপে ওঠে। বুকের মধ্যে গুরগুরানিটা তীব্র হয়েছে। এই মুহূর্তে পান্তু নাগকে রীতিমতো ভয় করছে তার।
নিজের পায়ের দিকে মুখখানি নামিয়ে চোরের মতো বসে থাকে শুখা।
—বল, কেন গিয়েছিলি ওর বাড়িতে। শুখার মুখের ওপর থেকে জ্বলন্ত দৃষ্টিখানা তিলেকের তরে সরায় না পান্তু, তুই জানিসনে, আমাদের লাইনে ওটা ঘোরতর অন্যায়?
একসময় ভয়ে ভয়ে মুখ তোলে শুখা। তোতলাতে তোতলাতে কোনও গতিকে শুধোয়, তু-তুমি—এসব কথা জানলে কেমন করে?
ফের গুম মেরে বসে থাকে পান্তু নাগ।
একসময় গলায় পর্যাপ্ত বিরক্তি ফুটিয়ে বলে, তুই যখন লোকটার বাড়ি গিয়েছিলি, ওর বউয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলি, ও তোকে দেখেছিল তো। পুলিসকে সে-ই তোর মুখের বর্ণনা দিয়েছে। পুলিস তার থেকে তোর ছবি আঁকিয়েছে।
বলতে বলতে সহসা দ্বিগুণ খেপে ওঠে পান্তু নাগ, কেন গিয়েছিলি ওর বাড়িতে? তার চেয়েও বড় কথা, তুই লোকটাকে চিনলি কেমন করে? ওর বাড়ির ঠিকানাই বা পেলি কোত্থেকে?
জবাবের আশায় শুখার মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে পান্তু নাগ।
৩
পান্তু নাগের শেষ প্রশ্নগুলো, শুখার বিবেচনায়, অতি সঙ্গত।
লোকটাকে মার্ডার করবার পর যা-যা করেছে সে, সুপারি-কিলারদের ন্যূনতম দস্তুরও নয় ওটা। সে কেবল নির্দিষ্ট অর্থের চুক্তিতে পান্তু নাগের থেকে কেসটা নেবে এবং নিখুঁতভাবে কাজটা নামিয়ে, চুক্তিমতো টাকাটা পান্তুর থেকেই বুঝে নেবে। কাকে মারছে, কেন মারছে, কে মারাচ্ছে, এসব বিষয়ে সামান্যতম কৌতূহল প্রকাশ করাটাও এই লাইনের দস্তুরে নেই। আর, শুখা কিনা এই লাইনের শাহেনশাতুল্য আদমি হয়েও এমন ভুলটা করল! মার্ডার হওয়া লোকটার নাম-ধাম, বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে তার বাড়িতেই চলে গেল! ওকে কি পাগলা কুকুরে কামড়েছিল! ফাঁসির দড়ি কি ওকে টানছিল!
পরবর্তীকালে ব্যাপারটা নিয়ে পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে নিজেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছে খোদ শুখাও। নিজেকেই নিজে কষে গালি পেড়েছে।
বাস্তবিক, চিরাচরিত রীতি অনুসারে খুনের পর অকুস্থল থেকে তৎক্ষণাৎ তার পালিয়ে যাবার কথা। পালিয়েও হয়তো যেত শুখা। কিন্তু সেদিন পুরো ঘটনাটাই ঘটল এমন উল্টো-পালটা, সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল !
সেদিন ঘটনাটা ঘটেছিল এইরকম।
ঠায় দুপুরে ঘোড়াডাঙার জঙ্গলের কিনারে ওই নির্জন শুনশান জায়গাটায় মুরগিটাকে দূরে আসতে দেখে যথারীতি একটা মোটা গাছের আড়ালে পজিশন নিয়েছিল শুখা। লোকটা ওর মেসিনের রেঞ্জের মধ্যে আসামাত্র পরপর দুটো মোক্ষম গুলিও চালিয়েছিল। বুকের বাঁদিকে পরপর দু’-দুটো গুলি খেয়ে যথারীতি লোকটা লুটিয়েও পড়েছিল মাটিতে।
কিন্তু ওই মুহূর্তে কাল করল ওই রুনুঝুনু আওয়াজটা।
শুখার থেকে দু’-দুটো গুলি খেয়ে লোকটা যেই-মুহূর্তে ঢলে পড়ল মাটিতে, অমনি তার কাঁধের ঝোলাটার থেকে এমনই রুনুঝুনু শব্দে বেজে উঠল একটা-কিছু, গাছের আড়াল থেকেও তা স্পষ্ট শুনতে পেল শুখা। আর এমনই অবাক কাণ্ড, লোকটার সাইড-ব্যাগের মধ্যেকার ওই রুনুঝুনু আওয়াজটা এমনই সম্মোহিত করে ফেলল শুখাকে, পালিয়ে যেতে গিয়েও পা দুটো কেমন জানি আটকে গেল তার।
প্রবল কৌতূহল নিয়ে পায়ে পায়ে লোকটার দিকে এগিয়ে গেল সে। আরও অবাক কাণ্ড, লোকটার সাইড-ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে যে-বস্তুটি বের করে আনল, ওটা দেখে তো বিস্ময় আর কিছুতেই বাগ মানে না শুখার।
একটা শস্তা খেলনা। তবে সামান্য দোলা দিলেই ভারি মিষ্টি বাজনা বেরোয় ওর থেকে। শুখা ডানহাত দিয়ে শূন্যে মেলে ধরে খেলনাটাকে। বার-দুই দুলিয়ে দেয়। আর তাতেই, শুখার হাতেই ওটা দ্বিতীয়বারের জন্যে রুনুঝুনু শব্দে বেজে ওঠে।
ভারি অবাক লাগছিল শুখার। লোকটা কে? কী করে? এমন পরিণত বয়েসে নিজের ব্যাগের মধ্যে একটা খেলনা ভরে রেখেছিল কেন?
খেলনাটাকে হাতে নিয়ে একটুখানি ভাবতে বসে শুখা। খেলনা বেচত নাকি লোকটা? ওই দিয়ে সংসার চালাত?
ভাবতে ভাবতে শুখা পুনরায় হাত ঢোকায় লোকটার ব্যাগের মধ্যে। নাহ, ওই একটাই খেলনা ছিল। তার মানে লোকটা আর যাই হোক, খেলনার ফেরিওয়ালা নয়। একটামাত্র খেলনা থাকে না কোনও ফেরিওয়ালার ঝুলিতে। তবে কি— তবে কি— বাড়িতে একটা বাচ্চা আছে লোকটার ! ওই বাচ্চাটার জন্যই কি খেলনাটা কিনে বাড়ি ফিরছিল?
আশ্চর্য, এমন মুহূর্তেও ভাবনাটা ঘাই মেরেছিল শুখার মনে, কিনা, ইস, লোকটা কাজে বেরোনোর মুহূর্তে বাচ্চাটা নির্ঘাত একটা খেলনার জন্য খুব বায়না ধরেছিল। লোকটাও বাচ্চাটাকে এমনই ভালোবাসে যে, বাচ্চাটাকে কথা দিয়ে বেরিয়েছিল, ফিরতি পথে যেভাবেই হোক খেলনা একটা আনবেই। লোকটা তার কথা রেখেছিল। যে-কাজই করুক না কেন, যত ব্যস্তই থাক না কেন, তার থেকে সময় বের করে ঠিক কিনে ফেলেছিল একটা রুনুঝুনু সুরেলা খেলনা। এমন একটা খেলনা পেলে বাচ্চাটা যে খুশিতে পাগল হয়ে যাবেই, তাতে শুখার মনে তিলমাত্র সন্দেহ ছিল না। কারণ, শিশুকালে এমন একটা সুর-তোলা খেলনা হাতে পেলে সে নিজেই তো খুশিতে পাগল হয়ে যেত।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, খেলনাটা আজ পৌঁছবে না ওই বাচ্চাটার কাছে। ভাবতে ভাবতে শুখা নিশ্চিত হয়, বেরোবার সময় এই লোকটা হয়তো বাচ্চাটাকে এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে, যার ফলে বাচ্চাটা হয়তো-বা এই মুহূর্তে বাড়ির দাওয়ায় অধীর প্রতীক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করছে এই খেলনাটার জন্য।
ভাবতে ভাবতে লোকটার শার্টের বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা পাতলা পকেট-ডায়েরি বের করেছিল শুখা। ডায়েরির একেবারে প্রথম পাতাতেই লেখা ছিল লোকটার নাম, ধাম, পুরো ঠিকানা। আর, তারপরই তো খেলনাটাকে নিজের প্যান্টের পকেটে পুরে নিয়ে সটান ওই ঠিকানায় হাজির হয়েছিল সে।
যা ভেবেছিল, তাই। একটা বছর-সাতেকের ফুটফুটে মেয়ে বাড়ির দাওয়ায় চুপটি করে বসে ছিল। কিন্তু চোখ দুটি ছিল সামনের পথের দিকে তাক করা।
মেয়েটির হাতে খেলনাটি ধরিয়ে দিয়ে চলে আসতেই চেয়েছিল শুখা। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন একজন মহিলা। বাধ্য হয়ে, তাঁকেই বানিয়ে বানিয়ে কথাগুলো বলেছিল শুখা,কিনা, অনুকূলদার আসতে একটু দেরি হবে, তিনি আমার হাত দিয়ে এই খেলনাটা পাঠিয়ে দিলেন।
কথাগুলো বলেই আর দাঁড়ায়নি শুখা। সটান চলে গিয়েছিল নিরাপদ ডেরায়।
কিন্তু ওইদিন এমনটা করল কেন সে ? লোকটার কাঁধের ব্যাগ থেকে খেলনা বের করে, শার্টের পকেটে রাখা ডায়েরি থেকে ঠিকানা বের করে, সটান ওর বাড়িতে চলে গেল কীসের কারণে?
প্রশ্নটা ওকে বারংবার করে চলেছিল পান্তু নাগ। বল, বল শুখা, ওই মুহূর্তে কী দরকার পড়েছিল তোর অতসব করবার?
পান্তু নাগকে কেমন করে বোঝায় শুখা ! বোঝাতে গেলেও গোটা ব্যাপারটা বুঝবে কি পান্তু! বুঝবে কি যে, অতিশয় সাধারণ পরিবারে জন্মালেও সে ছিল তার অতি সাধারণ বাপ-মায়ের সর্বক্ষণের নয়নের মণি! তখন তার নাম শুখা ছিল না। বাবা-মা খুব সাধ করে তার নাম রেখেছিলেন, শুকদেব! শুকদেব চিরটাকাল ক্লাসে ফার্স্ট হতো! মাধ্যমিকে পাঁচটা বিষয়ে লেটার পেয়েছিল সে! সেই সুবাদে ওকে নিয়ে বাবা-মায়ের মনে অনেক অনেক স্বপ্ন ছিল। হাজার বোঝালেও পান্তু নাগ এটাও কি বুঝবে যে, সেও তার ওই সাত বছর বয়েসে এমনই একটা খেলনার জন্য অনেক রাত অবধি জেগে বসে ছিল বাবার ঘরে ফেরার পথ চেয়ে!
শুখা নিশ্চিত হয়, ওইদিন, ওই ঠা-ঠা দুপুরে, রহস্যময় ওই জঙ্গলের কিনারে, আচমকা সে পড়ে গিয়েছিল ওই সাত বছরের ফাঁদে। আর, তাতেই অঘটনটা ঘটে গেল।
ভাবতে ভাবতে একসময় কী এক দুঃসহ যন্ত্রণায় দু’হাত দিয়ে মুখখানা ঢেকে ফেলে শুখা। সহসা কোন-এক রহস্যময় টাইম-মেসিনে চড়ে সে সটান শুকদেব হয়ে পৌঁছে গেল তার সাত বছর বয়সে। অতদূর থেকে পান্তু নাগের গঞ্জনা-তিরস্কারগুলো একটু একটু করে ঝাপসা হয়ে আসে শুকদেবের কানে।
অলংকরণ : সুব্রত মাজী