উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
কিন্তু ওই দিন ওদের দলটা ওর মা-বাবাকে যেভাবে অপমান করল তাতে বাবলুর চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল। ইচ্ছে করছিল ওই পেলুর মুখটা এক ঘুষিতে ফাটিয়ে দিতে। ওর মা-বাবা কেমন অসহায়ভাবে তাকিয়ে ছিল। আসার সময় মা একদৃষ্টিতে ওকে দেখছিল। তাহলে মা কি ওকে চিনতে পেরেছে— কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে মা ভেতরে ঢুকে গেল।
মিনিট আর সেকেন্ডের কাঁটা বারোর কাছে এসে পৌঁছেছে। চারপাশে শোঁ শোঁ বাতাসের শব্দ। বাবলু চোখ বুজল। মায়ের মুখটা মনে করে উপর থেকে নিজেকে ভাসিয়ে দিল। তলিয়ে যেতে থাকল গভীর অতলে। নীচে তখন ছোট্ট পৃথিবী। মা-বাবাকে ছেড়ে যাওয়া মুক্তির সেই রং পৃথিবীতে লেগে রইল। নীচে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে পেলুর কথাগুলো মাথায় আসছে—
—বিলে যেটা লেখা আছে সেটাই দিতে হবে।
প্রিয়ব্রত চুপ করে দরজার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। খানিক ভেবে জড়ানো গলায় বলে— এত টাকা আমি দিতে পারব না।
—না দিতে পারলে লাফড়া হবে। আর লাফড়া কখন হয় জানেন তো? যেখানে যতটা দেওয়ার আপনি দিচ্ছেন না— বাওয়ালি তখন হবেই—
—আমরা পুলিসে জানাব। জোর-জুলুম করে তোমরা চাঁদা নেবে? কয়েকমাস আগে আমাদের পরিবারে একটা এত বড় ঘটনা ঘটে গেল— তখন তো কাউকে দেখিনি— প্রিয়ব্রতর বউ উমা ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
—পুলিস ঢুকলে উল্টে আপনাদেরই বাজেট বাড়বে। তখন—
—একদম ভয় দেখাবে না— এই তুমি ভেতরে যাও তো— তখন কী হবে অ্যাঁ?
—মারধোর খেয়ে হাসপাতালে যাবেন। খচ্চা-ফচ্চা বেড়ে যাবে— আস্ত বাঁশঝাড় কেউ কি আর সেধে বাড়িতে ডাকে? আর এই এলাকায় পুলিস-টুলিসের কোনও ব্যাপার নেই— পুরো এলাকাটাই ডেমোক্রেটিক—
—মাসিমা, একটু এদিক-ওদিক করে টাকাটা দিলেই তো মিটে যায়। শুধু শুধু আর অশান্তি বাড়াবেন না। আর পুজোটা তো আমার আপনার সকলের— ষন্ডামার্কা, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলের ছেলেটা চুলগুলো বাঁধতে বাঁধতে বলল।
—অত টাকা আমরা দিতে পারব না। তোমার মেসোমশাই খুব অসুস্থ। তারপর প্রায় বছরখানেক কারখানা বন্ধ। রোজই শুনি একটার পর একটা কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার ওপর এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল— আমাদের কি আর পুজো আছে?
—কারখানাই তো বন্ধ হয়েছে— পায়খানা তো হয়নি— কারখানা খোলা হতেই হবে কে বলল— ছোটখাট চায়ের দোকান, পান, বিড়ি, গুটখা, তেলেভাজা এসব তো ভালোই চলে। কিছু লোক আছে— কিছু করবে না— শুধু এটা বন্ধ, ও মন্দ, সে গন্ধ— যান, যান টাকাটা আনুন তো—
এই তুই চুপ কর তো— ফালতু ঝামেলা করছিস—
—তোমাদের পরিষ্কার বলে দিই— অত টাকা আমি দিতে পারব না। তোমরা এখন এসো। সামনের রবিবার এসে চাঁদাটা নিয়ে যেও।
—শালা, জং ধরা চিমনি হয়ে পড়ে রয়েছে— আবার পুলিসের ভয় দেখায়— এরপর বাইকবাহিনী এসে ডলা দিলেই সুরসুর করে টাকা বের করে দেবে।
পুরো দলটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। পিছনের ছেলেটা যেতে যেতে বারবার উমার দিকে তাকাচ্ছিল। মাথায় টুপি, চোখে সানগ্লাস, নাক-মুখ রুমাল দিয়ে বাঁধা। এতক্ষণ উমার ছেলেটার দিকে নজর পড়েনি। কিন্তু এখন ছেলেটাকে দেখেই ওর বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে এল।
দশাশই চেহারাটা ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে রাস্তায় আছাড় খেয়ে পড়তেই চারদিকে অন্ধকারের নিস্তব্ধতা নেমে এল। কুকুরগুলো কোনও এক অজানা ভয়ে বা আক্রোশে তারস্বরে চিৎকার শুরু করল। আশপাশের উঁচু ফ্ল্যাটগুলোর জানলা খোলার শব্দ চাপা পড়ল নিস্তব্ধ শরীরের শেষ স্পন্দন। নিঝুম রাতের কালো রাস্তায় পড়ে রইল ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত দেহ।
ভেতরে এসে উমা দেখে প্রিয়ব্রত চোখ বুজে চেয়ারে বসে হাঁপাচ্ছে। অন্য একটা চেয়ার টেনে উমা ওর মুখোমুখি বসল। এখন প্রিয়ব্রতর মনের বেড়া টপকাতে হবে। উমা জানে ওর ভেতরটা এখন প্রবল আক্রোশে ফেটে পড়তে চাইছে। কথা বেশি বলতে পারে না। কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে ভীষণ অসহায় বোধ করে। ওর মতো দাপুটে নেতার এই পরিণতি উমা ঠিক মেনে নিতে পারে না। পাশে বসে ওর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বোলায়।
প্রিয়ব্রত বসাক গোয়ালবাথানের স্পাইস কারখানার কর্মচারী ছিল। প্রত্যেক শিফটে প্রায় দুশো লোক কাজ করত। হঠাৎ করে একদিন কারখানার গেটে লক-আউট নোটিস পড়ল। তারপর থেকেই জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল। প্রিয়ব্রত কারখানাটা খোলানোর অনেক চেষ্টা করেছিল। ও ছিল ইউনিয়ন লিডার। নতুন একটা দল তখন ক্ষমতায় এসেছে। নেতারাও প্রায় নতুন। তারই মধ্যে বিভিন্ন ক্ষমতাবান মানুষকে ধরে প্রিয়ব্রত ঠিক মন্ত্রীর কাছে পৌঁছে গেল। সব শুনে মন্ত্রী বলল— এতদিন ধরে যে দল করেছেন সেই দলের ভাব-ভাবনা থেকে বিচ্যুত হয়ে আমার কাছে আসলেন?
—দলীয় ভাবনা নয়। —আমি এসেছি কারখানাটাকে— মানে এতগুলো মানুষের রুটি-রুজি—
—ওদের রুটি-রুজি নিয়ে আপনাকে আর ভাবতে হবে না। এতদিন অনেক ভেবেছেন, এবার আমাদের ভাবতে দিন।
প্রিয়ব্রত বুঝতে পারে— নাঃ, আর হবে না। ওই কারখানা আর খোলানো যাবে না। কিন্তু তাকেও তো এখন কিছু একটা করতে হবে। বাড়ি ফেরার পথে প্রিয়ব্রতর হাত-পা কাঁপতে থাকে। ভরা সংসার। মা শয্যাশায়ী। তার চেয়েও বড় ব্যাপার এখন থেকে প্রতিপদে রাজনৈতিক নাগরদোলায় চাপিয়ে তার সব কিছুর বিচার হবে— তা সে যতই দক্ষ কর্মী হোক।
—কী প্রিয়দা কিছু কি হল? নেপালদা দূরেই দাঁড়িয়েছিল। গালে পাঁচদিনের না কাটা দাড়ি— মেশিনের হাতল ঘুরিয়ে ছেলেকে মানুষ করার স্বপ্নে বিভোর চোখ দুটোয় গভীর আকুলতা—
নাঃ, কিছু হল না। ভরসাযোগ্য মানুষ আর পেলাম কোথায়?
—মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হল না? কী বললেন?
—সেরকম কিছুই বললেন না। ও কারখানা আর খুলবে না। অন্য কিছু চেষ্টা করো।
মাথা নিচু করে ধীর পায়ে প্রিয়ব্রত ঢুকল। নিজের ঘরে এসে রেডিওটা চালিয়ে দিল। এখন প্রায় গোটা দিন রেডিও শুনেই কাটে। ছেলে ছোট থাকতে এ বাড়িতে নিয়মিত রেডিও চলত। বহু পুরনো দিনের রেডিও সেট। কালের নিয়মে তা খারাপও হল। বাড়ির সকলে তখন ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত। প্রিয়ব্রত কখনও রেডিও সেটটাকে হাতছাড়া করেনি। প্রথম দিকে উমাও রেডিও শুনত। পরের দিকে বলত— এ গান শোনা আমার পোষাবে না— এ তো গানের চেয়ে কথা বলে বেশি। পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে প্রিয়ব্রত’র ক্লান্ত মুখে ম্লান হাসি খেলে যায়। রেডিও রেডিওর মতো চলতে থাকে। প্রিয়ব্রত ভাবে এতকিছু পরিবর্তনের মধ্যেই ধীরে ধীরে বাসা বাঁধতে চলেছে অপরিবর্তন।
—কী ব্যাপার— তুমি কখন এলে— রেডিওটা একটু বন্ধ কর তো— কাল সারা রাত ছেলে ফেরেনি—
—সে কী? কোথায় গেল? কিছু বলেনি তোমাকে?
—না, যাও একটু খোঁজ-খবর কর— আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। যা সব বন্ধু-বান্ধব জুটিয়েছে—
ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে-হিঁছড়ে প্রিয়ব্রত উঠে পড়ল। সারাদিন-সারারাত খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেল না। নিখোঁজ ছেলের চিন্তায় উদ্বেগ বেড়ে চলল। পাড়া, ক্লাব, স্টেশন, হাসপাতাল, অলি-গলি সব হল— কিন্তু ছেলে বাড়ি ফিরল না। ছেলের চিন্তায় প্রিয়ব্রত তখন দিশেহারা। ছেলেটা একটু বখাটে হয়ে গিয়েছিল। সারাদিন শুধু টাকা-টাকা করত। দু-একবার ফেল করে কোনওরকমে ক্লাস নাইনে উঠল। তারপর ক্লাসেও অনিয়মিত হয়ে পড়ল। একসময় স্কুল থেকে ওকে বের করেও দেওয়া হল। প্রিয়ব্রত ভেবেছিল ওদেরই কারখানায় ওকে ঢুকিয়ে দেবে।
যা হোক, ঘটনার দুদিন পর প্রিয়ব্রত থানায় ডায়েরি করল। ফেরার পথে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি খোঁজ নিয়ে আসার পথে রাস্তায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হল। কিন্তু অভাব-অনটন আর একরাশ চিন্তায় চিকিৎসাটাও ঠিকঠাক হল না। আস্তে আস্তে প্রিয়ব্রত’র কথা জড়িয়ে আসতে লাগল— ডান দিকটা অবশ হয়ে অসাড় হয়ে পড়ল। স্বাভাবিক কথা বলা আর সাবলীল চলাফেরা এখন তার পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য।
আজ শনিবার। কাল সেই ছেলেগুলো আবার আসবে। এদের প্রত্যেককে প্রিয়ব্রত চেনে। সবাই এলাকার বখে যাওয়া ছেলে। উমা বলে—কাল তো ওরা আবার আসবে— কী করবে?
—কী আর করব? প্রিয়ব্রত’র জড়ানো গলায় একরাশ হতাশা— যা তার ভেতরে ভয়ানক অন্ধকার ঢেলে দিয়েছে। নিষ্পলক চোখ দুটো যেন কোথাও আশ্রয় না পেয়ে দৃষ্টিহীন। ঠিক সেই সময় দরজার কলিং বেলের শব্দ। উমা এসে দরজা খুলে দিল।
—কাকে খুঁজছেন?
—আমরা থানা থেকে আসছি। বাবন কে হয় আপনার?
—কোনও খোঁজ পেলেন তার? উমা উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। এতদিনের অন্ধকার পেরিয়ে যেন এক চিলতে আলোকধারী আগন্তুক হাজির।
—সে আপনাদের কে হয়— বলুন—
—ও আমাদের ছেলে— আসুন না, ভেতরে এসে বসুন— ছেলের খোঁজে উমার যেন আর তর সয় না।
—শুনলাম আপনার ছেলে চাঁদার নামে এলাকায় জুলুমবাজি চালাচ্ছে। ইমিডিয়েট ওকে থানায় দেখা করতে বলবেন। নইলে কিন্তু আপনাদের তুলে নিয়ে যাব।
—কিন্তু আমাদের ছেলে তো নিখোঁজ। প্রায় আট মাস হতে চলল। থানায় আমরা ডায়েরিও করেছি। তার নম্বর আমাদের কাছে আছে। একটু দেখুন না স্যার— ওকে যদি আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারেন— আমাদের ছেলে ওরকম নয়। উমার হাত-পা কাঁপতে থাকে, বোবা ধড়ফড়ানি বুকে তুফান তোলে।
—সাজিয়ে-গুছিয়ে ভালোই তো আটঘাট বেঁধে নেমেছেন। পুলিসকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন না। যেটা বললাম মাথায় রাখবেন।
ওরা চলে গেল। উমার গলা এমনভাবে বুজে এল, শত চেষ্টাতেও আর কথা বলতে পারল না। অর্ধমূর্ছিতের মতো নির্বাক হয়ে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
আজ রবিবার। ওরা আসবে। সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝেই একটা উন্মত্ত হাওয়া এসে দরজা-জানলাগুলোয় ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সকাল থেকেই উমা ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছে। এই তারা এল বলে— এক্ষুনি বোধহয় কলিং বেল বেজে উঠবে। প্রিয়ব্রত অদ্ভুত নির্লিপ্ত। একমনে বাঁ হাতে চায়ের কাপ নিয়ে জানলার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে— যেন ওদের আসার অপেক্ষায়। এদিকে যত সময় যাচ্ছে উমার উদ্বেগ-অস্থিরতা আর উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে।
—বাড়িতে কেউ আছেন?
উমা চমকে ওঠে। কলিং বেল না বাজিয়ে কে আবার ডাকাডাকি করছে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে উমা দরজা খুলে দিল।
—আমি থানা থেকে আসছি। বড়বাবু এক্ষুনি আপনাকে আমার সঙ্গে থানায় যেতে বললেন। আপনি রেডি হয়ে নিন— আমি নীচে অপেক্ষা করছি।
উমা কোনওরকম তৈরি হয়ে নীচে নেমে এল। লোকটা ওকে নিয়ে থানার দিকে চলল। থানায় পৌঁছে বড়বাবু বলল— পেছন দিকে যান। বডিটা দেখে আসুন। যে দৃশ্য দেখে সন্তানের মায়ের বুক ফেটে যাওয়ার কথা— চোখের জল বাধহীন হয়ে নেমে আসার কথা— তার কোনওটাই উমার হচ্ছে না। নির্বোধের মতো জড় শরীর-মনে কোনও অনুভূতি আর কাজ করছে না। লণ্ডভণ্ড বাবলুর শরীরটা ঘিরে রক্ত-মাংস মেদ মজ্জার গন্ধে বড় বড় মাছিগুলো ওড়াউড়ি করছে। উমা ডান হাত নাড়িয়ে মাছিগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করল। তারপর মাথাটা আস্তে আস্তে বাবলুর বুকের উপর রাখল।