উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
ঝাড়খণ্ডের সিদ্ধপীঠ হল রাজরপ্পা। ছোটনাগপুরের গভীর বনপ্রদেশে এক মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে এই মহাতীর্থের অবস্থান। দেবী এখানে ছিন্নমস্তা।
রাঁচি থেকে ৫০ কিমি দূরে রাষ্ট্রীয় রাজমার্গ। সেখান থেকে ৩০ কিমি দূরে রাজরপ্পা। রাঁচি, হাজারিবাগ, ধানবাদ ও বোকারো থেকে রামগড় পর্যন্ত সারাদিনে অনেক বাস ও ট্যাক্সির যাতায়াত। রামগড় থেকেও রাজরপ্পা যাওয়ার জন্য ঘন ঘন ট্রেকার ও ট্যাক্সি মেলে।
সৌন্দর্যের এই রম্যস্থান দেবী ছিন্নমস্তার কারণে দারুণ মহিমান্বিত। দেবনদ দামোদর ও ভৈরবী দেবনদী এখানে বিপরীত রতিতে এসে মিলেছে দেবী ছিন্নমস্তার চরণবন্দনা করতে। এই রমণীয় সঙ্গমস্থলের নাম ভাণ্ডারদহ।
এবার ছিন্নমস্তা দেবীর কথা বলি। দশমহাবিদ্যার ভয়ঙ্করী রূপের প্রকাশ ছিন্নমস্তায়। এটি হল মহাদেবীর অন্তর্মুখী রূপ। এঁর স্বরূপ অনুধাবন করার শক্তি একমাত্র সাধকের পক্ষেই সম্ভব। ছিন্নশির হয়েও ইনি জীবিত থাকেন। চতুর্দিকে এঁর বসন। অর্থাৎ ইনি দিগবসনা। ইনি বিশ্বপ্রপঞ্চের প্রতীক শ্বেতপদ্মের উপর দণ্ডায়মানা। এঁর নাভিদেশে যোনিচক্রের অধিষ্ঠান। রজো এবং তমোগুণের দুই দেবী তাঁর সখী। অর্ধরাত্রে দেবীর স্বরূপ কল্পনা করে নিষ্ঠার সঙ্গে ছিন্নমস্তার ধ্যান করলে সাধক বা সাধিকা সরস্বতী সিদ্ধ হয়। শত্রুবিজয়, রোগমুক্তি, রাজ্যপ্রাপ্তি এবং দুর্লভ মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য ছিন্নমস্তার ধ্যান ও পূজা অত্যন্ত ফলদায়ক।
হিমালয়ের এক অতি উচ্চস্থানে সতী ছিন্নশির হয়ে চিন্তাপূর্ণিতে যে ছিন্নমস্তা রূপ মহাদেবকে দর্শন করিয়েছিলেন সে-কথা আমি অনেক আগের নিবন্ধে বলেছি। এবার এই স্থানে দেবীর আবির্ভাব কী করে হল তা বলি।
সুপ্রাচীনকালে এই স্থান মিথিলাক্ষেত্র নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু এই স্থান রাজরপ্পা হওয়ার নেপথ্যেও এক কাহিনী আছে।
বহুকাল পূর্বে ছোটনাগপুরে রজ নামে এক প্রতাপশালী রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর রানির নাম রূপমা। রাজা তাঁকে রপ্পা বলে ডাকতেন। এঁরা ছিলেন নিঃসন্তান। একবার এক পূর্ণিমা তিথিতে রাজা রজ তাঁর সেপাইদের নিয়ে শিকারে বেরিয়ে এখানকার এই রমণীয় স্থানে এসে পৌঁছলেন। এই নয়নাভিরাম দৃশ্যস্থলে দামোদর ও ভৈরবীর সঙ্গম দেখে মোহিত হলেন রাজা। তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়েছে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় এখানকার প্রকৃতি মায়াময় হলে ভাব-বিভোর হয়ে উঠলেন তিনি। সেপাইদের বললেন, এখানেই ছাউনি ফেলে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করতে।
মধ্যরাতে চন্দ্রমার প্রকাশ যখন আরও প্রকট হয়ে সমস্ত পাহাড় ও জঙ্গলকে ঝলমলিয়ে দিল রাজা তখন এক স্বপ্ন দেখলেন। লাল শাড়ি পরিহিতা তেজোদীপ্তা, মুখমণ্ডলে আশ্চর্য দ্যুতিসম্পন্না এক কন্যা তাঁকে বলছেন, ‘হে রাজন! এতখানি বয়স হয়ে গেল তবুও কোনও সন্তানাদি না হওয়ায় তোমার মনে শান্তি নেই। যদি আমার কথা শোনো তবে অচিরেই তোমার রানি সন্তানসম্ভবা হবে।’
স্বপ্নভঙ্গে শয্যা ত্যাগ করে তাঁবুর বাইরে এলেন রাজা। চারদিক ঘুরে দেখলেন কাউকে কোথাও দেখতে পান কি না। কিন্তু না। কেউ কোথাও নেই। তবুও রাজা সেই ভয়ঙ্কর নির্জনে একা একাই এদিক-সেদিক দেখতে দেখতে চলে এলেন দামোদর ও ভৈরবীর সঙ্গমস্থল ভাণ্ডারদহে। সেখানে আসতেই দেখতে পেলেন জলের ভেতর থেকে এক তেজস্বিনী কন্যা অলৌকিকভাবে প্রকট হলেন। সেই কন্যার পরনে লাল বস্ত্র, গলায় নরমুণ্ডের মালা, এক হাতে শঙ্খ অপর হাতে খড়্গ। কন্যার সারা শরীর থেকে চন্দনের সুবাস ভেসে আসছে। সেই দৃশ্য দেখে রাজা অত্যন্ত ভয় পেয়ে গেলেন। রাজার ভীতিদর্শনে কন্যা বললেন, ‘হে রাজন! আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমিই তোমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলাম। আমি প্রচণ্ডচণ্ডিকা দেবী ছিন্নমস্তা। এই রমণীয় তপোবনে প্রাচীনকাল থেকে আমি গুপ্তরূপে অবস্থান করছি। কলিযুগের মানুষ এখনও আমার অবস্থান সম্বন্ধে অবগত নয়। আমার এই রম্যবনে তোমার আগমন তোমারই মনস্কামনা পূর্ণ হবার জন্য হয়েছে। তোমার মনে সন্তান লালসা রয়েছে। আমার বরে আজ থেকে ঠিক এগারো মাস পরে তুমি একটি পুত্রসন্তান লাভ করবে।’
রাজা রজ দূর থেকে জোড় হাতে দেবীকে প্রণাম জানালেন।
দেবী বললেন, ‘হে রাজন! আজকের রাত্রি প্রভাত হলে এই সঙ্গমস্থলের পাশে বনমধ্যে বহু প্রাচীন এবং পরিত্যক্ত আমার একটি মন্দির তুমি দেখতে পাবে। সেই মন্দির মধ্যে একটি শিলাখণ্ডে আমার স্বরূপ আঁকা আছে। তুমি কাল সকালে এই সঙ্গমস্থলে স্নান করে শুদ্ধচিত্ত হয়ে আমার পূজা করবে এবং বলি চড়াবে। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন বিধিপূর্বক আমার পূজা-অর্চনার জন্য এক সৎ ব্রাহ্মণকে নিযুক্ত করবে।’ এই বলে দেবী অন্তর্ধান করলেন।
এরপর রাজা সেই বনময় স্থানে একাকী ভ্রমণ করে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেবীর পরিত্যক্ত ভগ্নমন্দির দেখতে পেলেন। মন্দিরের অভ্যন্তরে একটি শিলাখণ্ডে অঙ্কিত দেবীর দিব্যরূপও দর্শন করলেন। এরপর স্নান-পূজা অন্তে বলিদান ইত্যাদির দ্বারা দেবীর আদেশ পালন করলেন। এবং পরবর্তীকালে নতুন একটি রম্য মন্দিরও নির্মাণ করালেন।
কথিত আছে, নতুন মন্দিরে রাজা যখন পূজায় বসলেন তখন হঠাৎ কোথা থেকে এক ব্রাহ্মণ পূজারী মন্দিরে প্রবেশ করে বিধিপূর্বক পূজা করাতে লাগলেন রাজাকে। সেই পূজায় দেবী এমনই সন্তুষ্ট হলেন যে, ব্রাহ্মণ ও রাজার মস্তকে ফুল-বেলপাতা নিক্ষেপ করে বললেন, ‘আমি তোমাদের পূজা ও উপাসনায় অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি। তাই আমার ইচ্ছায় আজ থেকে রাজা রজ ও রানি রপ্পার নামানুসারে এই স্থানের নাম হবে রাজরপ্পা।’
দেবীর আদেশ মান্য করা হল। রাজ-আজ্ঞায় সেই ব্রাহ্মণই এরপর থেকে দেবীর সেবা-পূজা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
এর বহুকাল পরে রামগড়ের রাজাকে দেবী ছিন্নমস্তা স্বপ্নাদেশ দিয়ে বললেন, ‘আমার সেবাপূজার জন্য এখানকার বংশজ ব্রাহ্মণ নয়, কলকাতার কালীঘাট থেকে বাঙালি ব্রাহ্মণ নিয়ে এসে পূজা করাও। কেন না বাঙালি ব্রাহ্মণরা শক্তির উপাসক হয়।’
দেবীর আদেশ মতো কালীঘাট থেকে বাঙালি ব্রাহ্মণরা এসে ছিন্নমস্তার পূজা করতে লাগলেন। স্থানটি এখনও অতি মনোরম। আমি সময় পেলেই শনি ও মঙ্গলবার দেখে সেখানে যাই। নবাগত যাত্রীদের অনুরোধ, বর্ষার সময়টা বাদ দিয়ে গেলে শুধু দেবী দর্শন নয়, ভৈরবী ও দামোদরের বিপরীত রতিতে মিলনদৃশ্য দেখে মন মোহিত হয়ে যাবে। অন্যসময় জলপ্লাবনে তা সম্ভব নয়।
(ক্রমশ)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল