উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। উচ্চতর বিদ্যার ক্ষেত্রে শুভ ফল পাবে। কর্মপ্রার্থীদের ... বিশদ
রাজাভাতখাওয়ার অরণ্যে জয়ন্তী মহাকাল দর্শনের অভিজ্ঞতার কথাও এই প্রসঙ্গে সেরে নেওয়া ভালো। জয়ন্তী হল একান্নপীঠের অন্তর্গত এক মহাপীঠ। সতীর বামজঙ্ঘা পড়েছিল এখানে। মতান্তরে শ্রীহট্টের জয়ন্তীয়া পরগনার খাসি পাহাড়ে বউরভোগ গ্রামের কালাজোরে। ভৈরব ক্রমদীশ্বর। তবে এদেশে মহাকাল জয়ন্তীরই মান্যতা বেশি। স্থানটি এখনও অতি দুর্গম।
দুর্গমতার কারণে এই পুণ্যতীর্থে শিবরাত্রির সময়ই যাওয়া উচিত। বাড়িতে শিবরাত্রির পূজা থাকার কারণে আমি পরদিন শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে আলিপুরদুয়ার জংশনের দিকে রওনা হলাম।
সে রাতটা তো ট্রেনেই কাটল। পরদিন গেল জয়ন্তী মহাকাল দর্শনের প্রস্তুতি নিতে। তারও পরের দিন ওখানকারই কয়েকজন সঙ্গীকে বেছে নিয়ে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে রওনা দিলাম জয়ন্তী মহাকাল দর্শনে। এ পথের দূরত্ব ৩০ কিমি।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে জয়ন্তীর উচ্চতা ৪০০ ফিট। এর ১১৭ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে জয়ন্তী রেঞ্জ। বনময় জয়ন্তীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়।
তবে আশ্চর্যের ব্যাপার এই, এমন শিবরাত্রির মরশুমেও আমরা এই ক’জন ছাড়া জনমানবের চিহ্ন নেই এখানে। এখানে এক জায়গায় একটিই মাত্র হোটেল চোখে পড়ল। সেখানে চা পর্ব সেরে নিলাম। তখনই মনে হল ভাগ্যে সঙ্গী হিসাবে এখানকারই কয়েকজনকে পেয়ে গিয়েছিলাম, নাহলে একা এলে হালে পানি পেতাম না। যেতেই পারতাম না হয়তো।
বক্সা অরণ্যের প্রান্ত ছুঁয়ে সুদূর বিস্তৃত জয়ন্তী নদী। নদীর ওপারে সিঞ্চুলারেঞ্জ। যার বিস্তৃতি শঙ্কোনা থেকে ফুন্টশিলিং পর্যন্ত। যাই হোক, আমরা মহাকাল জয়ন্তী দর্শনের জন্য উঁচু বাঁধের ওপর থেকে জয়ন্তীর গর্ভে নেমে এলাম। শুনলাম মহাকাল পর্বত এখান থেকে পাঁচ কিমি দূরে।
নদীর বালুচরে পথ চলতে চলতে হঠাৎই একটি বালি সংগ্রহকারী লরি এসে পড়ায় আমরা তারই সাহায্যে এগিয়ে গেলাম অনেকটা পথ। এইভাবে বিশেষ একটি জায়গায় যাওয়ার পর যেখানে লরি থেকে নামলাম সেখান থেকে একই নদী-কাঠের গুঁড়ির সাঁকোয় কতবার যে পার হলাম তার ঠিক নেই। এইভাবে একসময় মহাকাল পর্বতের পাদদেশে এলাম। সেখানে জয়ন্তীর একটি বিপজ্জনক সাঁকো পেরিয়ে অনেকটা উচ্চস্থানে উঠতেই একটি বেগবতী ঝরনাধারার কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। এখান থেকেই চার হাজার ফুট উঁচু মহাকাল পর্বতে আরোহণ করতে হবে। মোচাকৃতি এই দুরূহ পর্বতে মরচে ধরা কুড়ি বাইশ ফুট উঁচু একটি একটি লোহার সরু মই ধরে ওপরে উঠলাম। তারপর পার হতে হল ঘন অরণ্যে ভরা বিপদসংকুল দুরন্ত চড়াই ভেঙে কণ্টকাকীর্ণ পথ। তারপর আরও কিছুটা পথ হেঁটে আবার মই বেয়ে ওপরে ওঠা।
অবশেষে একসময় মহাকাল পর্বতের ভয়ঙ্কর গুহা চোখে পড়ল। সেই গুহায় পৌঁছনোর জন্য আবারও মই ব্যবহার করতে হল। এতক্ষণে পৌঁছলাম গুহার জঠরে। পরপর তিনটি চুনাপাথরের গুহা আছে এখানে। স্টালাগমাইট গুহা, অনবরত গুহার মাথা থেকে চুনমিশ্রিত জল ঝরে পড়ছে গায়ের ওপর। এই তিনটি গুহার প্রথমটিতে আছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর। দ্বিতীয়টিতে ভোলানাথ শিব এবং তৃতীয় গুহায় মহাকাল।
কোনওরকমে হামাগুড়ি দিয়ে গুহার গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করলাম। এক তান্ত্রিক এখানকার পূজারী। তাঁর মাধ্যমে পূজা দেওয়া হলে তাঁকেই জিজ্ঞেস করলাম, এখানে তো মহাকালেরই মান্যতা দেখছি। কিন্তু জয়ন্তীপীঠ কোথায়?’
তান্ত্রিক বললেন, ‘আপনি যে গুহায় অবস্থান করছেন এই সেই জয়ন্তীপীঠ। এই হচ্ছে মহাকাল। মহাকালের নীচে দেবী জয়ন্তী। এঁর পূজা হয় মহাকালীর মন্ত্রে। দেবীর বাম নিতম্ব যখন এখানে পড়েছিল তখন সেই ভার রাখতে না পেরে এই বিশাল পর্বত ক্রমশ নীচে নেমে যাচ্ছিল। মহাদেব তখন মহাকাল মূর্তি ধরে সেই চাপ আজও ধরে রেখেছেন। তাই এখানে মহাকালেরই মান্যতা বেশি। পাহাড়ের অর্ধেক ভূগর্ভে। গুহাসমেত শিখরদেশটাই এখানে প্রকট হয়ে আছে। দেবী এখানে জয়ন্তী। ভৈরব ক্রমদীশ্বর। নিন, দেবীকে স্পর্শ করুন।’
আমি শুধু স্পর্শ নয়, মাথাটাও ঠেকিয়ে নিলাম প্রাকৃতিক নিয়মে তৈরি হওয়া একটি পিণ্ডাকৃতি শিলাতে। মহাকাল, জয়ন্তী সবই এখানে গুহার সঙ্গে সুসংবদ্ধ। কোনওটি অন্যত্র তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করা নয়।
দেবী দর্শন করে অনাবিল আনন্দ পেলাম। আমার অনেক দিনের আশা পূর্ণ হল আজ। তান্ত্রিককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এদেশে জয়ন্তীপীঠের তেমন মান্যতা নেই। কিন্তু শুনেছি শ্রীহট্টের খাসি এবং জয়ন্তীয়ায় আর এক দেবীপীঠ আছে। অনেকের মতে সেটিই মুখ্যপীঠ। সেখানেও দেবী হলেন জয়ন্তী এবং ভৈরব ক্রমদীশ্বর। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?’
তান্ত্রিক বললেন, ‘আমি কী বলব বলুন? পীঠাধীশ্বরী নিজেই এখানে নিজেকে প্রকট করে মহিমা বিস্তার করেছেন। এখানকার প্রাকৃতিক অবস্থানই এর পৌরাণিক বৃত্তান্তকে পুরোপুরি মিলিয়ে দেয়। তাছাড়া মহাকাল এবং জয়ন্তীদেবী দু’জনেই ভীষণ জাগ্রত এখানে। ওঁরা খুবই নিরিবিলি এবং শান্তির পরিবেশে অবস্থান করছেন। দেখছেন তো, কী ভীষণ জঙ্গল চারদিকে। ভাল্লুক ও চিতাবাঘের উপদ্রবের কারণে খুব বেশি যাত্রী সমাগম এখানে হয় না। তাও যারা আসে তারা সবাই দলবদ্ধ হয়ে আসে। শিবরাত্রি উপলক্ষে এখানে মাত্র তিন দিনের লোক সমাগম। আজ চতুর্থ দিন। সব ফাঁকা। দর্শন শেষ। তাই আর একবার মহাপীঠের দেবী শিলায় মাথা ছুঁইয়ে এ জীবনের প্রথম এবং শেষবারের মতো গুহা ত্যাগ করলাম। তারপর নীচে নেমে সেই সুবৃহৎ ঝরনা যেখানে দহের সৃষ্টি করে জয়ন্তীর দিকে বয়ে চলেছে সেখানেই স্নান পর্ব চুকিয়ে আবার যেভাবে এসেছিলাম সে ভাবেই প্রত্যাবর্তন করলাম। জয়ন্তী মহাকাল দর্শন আমার জীবনে এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। তারই আনন্দধারায় মন ভরিয়ে আলিপুরদুয়ারে যখন ফিরলাম তখন সন্ধে হয়ে এসেছে।
(ক্রমশ)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল