দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের সুফল আশা করতে পারেন। শেয়ার বা ফাটকায় চিন্তা করে বিনিয়োগ করুন। ব্যবসায় ... বিশদ
কাট টু ২০১৬। নভেম্বরের শেষ থেকেই চেন্নাইয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। তখনও মন্দিরে মন্দিরে চলছে বিশেষ প্রার্থনা। ‘ইরাইভিল নাল্লাম পেট্রু তিরম্ভি ভাঙ্গা’। আম্মার আরোগ্য কামনায় শুধু প্রার্থনা করেই ক্ষান্ত হয়নি তাঁর ভক্তরা। জ্বলন্ত কয়লার উপর হেঁটে, সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত করে মানত করে বসেছে তারা। না, কাজে আসেনি তাঁদের এই প্রাণপণ প্রার্থনা। ৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে হাসপাতাল থেকে চেন্নাইয়ের পোয়েস গার্ডেনের বাড়িতে ফিরেছিল তাঁর মরদেহ।
জয়রাম জয়ললিতা। দক্ষিণের লৌহমানবী। জাতীয় রাজনীতিতে এই নামে পরিচিত হলেও, জয়ললিতাকে সবাই চিনত আম্মা বলেই। না, একটু ভুল হল। বাস্তবটা হল, এখনও চেনে। কারণ, আম্মা নামের মধ্যেই তামিলনাড়ু খুঁজে পায় আশ্রয়। তাই তাঁর মৃত্যুতে দক্ষিণের এই রাজ্য আক্ষরিক অর্থেই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। মানসিকভাবে যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিকভাবে।
অবশ্য এই হারানোর কষ্টটা জয়ললিতা টের পেয়েছিলেন জন্মের পরপরই। মাত্র দু’বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে নানা প্রতিকূলতায় জড়িয়ে পড়েছিল তাঁর ছেলেবেলা। জয়ললিতার দাদু ছিলেন তদানীন্তন মহীশূরের মহারাজা জয়চামারাজেন্দ্র উদিয়ারের শল্যচিকিৎসক। এই রাজপরিবারের সঙ্গে যুক্ত থাকার পরিচিত হিসেবে তাঁদের পরিবারের বহু সদস্যের নামের প্রথমে ‘জয়’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়। মা অবশ্য তাঁকে জয়ললিতাকে ডাকতেন ‘কমলাভাল্লি’ বলে। মা সন্ধ্যা তামিল সিনেমায় অভিনয় করতেন। সেই সূত্রেই মহীশূর থেকে চলে আসতে হয়েছিল চেন্নাইয়ে। ছাত্রী হিসেবে খুব মেধাবী ছিলেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় রাজ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেও, বেশিদূর পড়াশোনা করা হয়নি। সংসারের আর্থিক অবস্থা ধরতে স্কুল জীবনেই নেমে পড়তে হয়েছিল রুপোলি পর্দায়। তা নিয়ে মায়ের সঙ্গে বাগবিতণ্ডাও কম হয়নি জয়ার। ১৯৭৮ সালে তামিল সাপ্তাহিক ‘কুমুদম’-এ প্রকাশিত হয়েছিল জয়ললিতার আত্মজীবনী। তাতে তিনি বলেছেন, ‘আমি খুব অবাক হয়েছিলাম গোটা বিষয়টায়। মুখে মেকআপ করার জন্য যে মা আমাকে শাস্তি দিয়েছিলেন, সিনেমা থেকে দূরে থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই তিনিই আমাকে অভিনয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন!’ তাই মাত্র ১৬ বছরে বয়সে স্টেলা মেরিস কলেজের পরিবর্তে তাঁর ঠিকানা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ডিরেক্টর সি ভি শ্রীধরের ‘ভেন্নিরা আদাই’-এর সেট।
১৯৬৪ থেকে ১৯৮০— হিন্দি, তামিল, তেলুগু, কন্নড় ভাষায় ১৩০টিরও বেশি ছবিতে অভিনেত্রী হিসেবে আকাশছোঁয়া সাফল্যের পর রাজনীতির ময়দানেও তিনি দক্ষিণের মহানায়িকা। সফল অভিনেত্রী থেকে তুখোড় রাজনীতিবিদ। একাধিক বিতকর্কে পিছনে ফেলেই তিনি পৌঁছে গিয়েছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর আসনে। দক্ষিণী রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা থেকেছে নির্ণায়কের।
তবে কাউকে বিশ্বাস না করার ‘রোগ’ বরাবরই বেগ দিয়েছে জয়ললিতাকে। রাজনীতিতে শিক্ষিতরা এগিয়ে আসুক, মনেপ্রাণে এটাই চাইতেন আম্মা। পছন্দ করতেন তাঁদের। এমনভাবেই তিরচাঙ্গরু শহরের তরুণ আইনজীবী সেলভা গণপতির বক্তৃতা খুব মনে ধরেছিল তাঁর। কথাবার্তা, আচার-আচরণে মুগ্ধ হয়ে দলে টেনে নিয়েছিলেন তাঁকে। একসময় আম্মার সরকারের মন্ত্রীও হন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করেই স্নেহধন্য গণপতির প্রতি অবিশ্বাস করতে শুরু করেন জয়ললিতা। ক্রমশ তা এমন পর্যায়ে পৌঁছয়, যে দল ছাড়তে বাধ্য হন গণপতি। কিন্তু সেই প্রতিভা বিনষ্ট হয়নি। ডিএমকে’তে যোগ দিয়ে রাজ্যসভার সদস্য হয়েছিলেন গণপতি। শুধু গণপতি নন, জয়ললিতার এমন অনেক সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে এই অবিশ্বাসের শিকার হয়ে।
হবে নাই বা কেন! বারংবার খুব কাছের কারও থেকে ধাক্কা খেতে খেতে এই অবিশ্বাসের জন্ম হয় তাঁর মধ্যে। এই তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। বাবা, এম জি আর, একসময়ের লিভ-ইন বন্ধু শোভন বাবু, স্কুলের এক বন্ধু, এমনকী হালফিলের শশিকলা। প্রত্যেককে তিনি নিজের মতো করে প্রচণ্ড বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই ঠকেছেন। শশিকলা তো খাবারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে মারার যড়যন্ত্র করেছিলেন বলেও অভিযোগ। স্কুলের বন্ধুর হয়ে তার প্রেমিকাকে চিঠি পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন জয়ললিতা। কিন্তু সেই বান্ধবীর মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার পর স্কুলের সেই বন্ধু গোটা ঘটনার দায় চাপিয়ে দিয়েছিল জয়ললিতার উপর। বাবার সম্বন্ধে জয়ললিতার ধারণা ছিল, ‘উনি এমন একটা মানুষ যিনি কোনও কাজই ঠিকঠাকভাবে করতে পারেন না।’ এতকিছুর মাঝেও তিনি মাঠে ক্রিকেট খেলা দেখতে যেতেন। সঙ্গে থাকত বাইনোকুলার। নরি কন্ট্রাক্টর এবং মনসুর আলি খান পতৌদির প্রতি টান থাকলেও, মাঠে বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে বসে থাকতেন শুধুমাত্র পতৌদিকে দেখবেন বলে। জয়ললিতা বিশ্বাস করতেন, ‘হয় দু’টো মানুষের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক থাকবে নয়তো গভীর বন্ধুত্ব। এর বাইরে আর কিছু হতে পারে না।’
***
মূলত, তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এম জি রামচন্দ্রনের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণাতে ১৯৮২ সালে তাঁর এআইএডিএমকে (অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাবিড় মুনেত্রা কালাগাম)-তে যোগ দেন জয়ললিতা। সেই বছরই দলের সম্মেলনে মহিলাদের অধিকারের (পেন্নিন পেরুমাই) উপর চমকপ্রদ ভাষণ দিয়ে সবাইকে অবাক করে দেন তিনি। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে দলের প্রচারসচিব হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিরুচেন্দুর বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে তাঁকে প্রার্থী করা হয়। ১৯৮৪-তে রাজ্যসভার সদস্য। ১৯৮৯ পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। কিন্তু পার্টির প্রচারসচিব হিসেবে তাঁর দক্ষতা ও সাফল্য দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কাছে চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা দলের সুপ্রিমো এম জি আরের সঙ্গে জয়ললিতার সম্পর্কে ভাঙন ধরানোর জন্য উঠেপড়ে লাগেন। আর তাতে সফলও হন। এম জি আরের নির্দেশে ‘কুমুদম’-এ আত্মজীবনী লেখা বন্ধ করতে হয় জয়ললিতাকে।
১৯৮৪ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অথর্ব হয়ে পড়েন রামচন্দ্রন। তামিল রাজনীতিতে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। জয়ললিতার নেতৃত্বে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেধে সাধারণ নির্বাচনের প্রচারে ঝড় তুলে সাফল্যের মুখ দেখে এআইএডিএমকে। ১৯৮৭ সালে রামচন্দ্রনের মৃত্যুর পর ক্ষমতা দখলের জন্য দলে অসন্তোষ দানা বাধে। তার দরুণ এআইএডিএমকে দু’ভাগ হয়ে যায়। এক দলের নেতৃত্বে ছিলেন এমজিআরের স্ত্রী জানকী রামচন্দ্রন। আর অন্য গ্রুপের নেতৃত্বে জয়ললিতা। ৯৬ জন সদস্যের সমর্থনে বিধানসভায় আস্থাভোটে জিতে তামিলনাড়ুর প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন জানকী রামচন্দ্রন। কিন্তু, তিনি বেশিদিন ক্ষমতা ভোগ করতে পারেননি। কারণ, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উদ্যোগে তামিলনাড়ুতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়।
১৯৮৯ সালে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ললিতার নেতৃত্বাধীন এআইএডিএমকে ২৭টি আসনে জয়ী হয়। তামিলনাড়ু বিধানসভায় প্রথম মহিলা বিরোধী নেত্রী নির্বাচিত হন জয়ললিতা। ১৯৮৯-এর ফেব্রুয়ারিতে তাঁর নেতৃত্বেই এআইএডিএমকের দুই বিরোধী গোষ্ঠী এক ছাতার তলায় আসে। দল আবার তাঁর পুরনো প্রতীক ‘জোড়া পাতা’ ফিরে পায়।
১৯৯১ থেকে শুরু করে তিন-তিনবার তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসেছিলেন জয়ললিতা। যদিও সেই পথচলাটা ছিল বেশ কণ্টকাকীর্ণ। এর মধ্যে অন্যতম বিতর্কিত ইস্যু ছিল তাঁর পালিতপুত্র সুধাকরণের বিয়ে। তামিল অভিনেতা শিবাজী গণেশনের নাতনির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সুধাকরণের। খরচ হয়েছিল প্রায় ছ’কোটি টাকা। এই ঘটনা প্রভাব ফেলেছিল তাঁর ভোটব্যাঙ্কে। ১৯৯৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তিনি এবং তাঁর দল পরাজিত হয়। দুর্নীতি মামলায় সেই বছরই একমাসের জন্য জেলও খাটতে হয়েছিল তাঁকে। তারপরও প্রবলভাবে ফিরে এসেছিলেন জয়ললিতা। আদালতের নির্দেশে ২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারলেও, তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না হয়েও জয়ললিতা দ্বিতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু, সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত জয়ললিতার পক্ষে এই পদে থাকা সম্ভব নয়। মাদ্রাজ হাইকোর্ট তাঁকে কয়েকটি অভিযোগ থেকে ছাড় দেওয়ায় ফের ২০০২ সালের মার্চে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। আন্দিপাত্তি বিধানসভা আসন থেকে উপনির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে আসেন। ২০১১-র এপ্রিলে ১৩ দলের জোটশরিক হিসেবে রাজ্যে ফের ক্ষমতায় আসে এআইএডিএমকে। তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হন জয়ললিতা। কিন্তু হিসাববহির্ভূত সম্পত্তি মামলায় ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আম্মাকে চার বছর কারাবাসের সাজা শোনায় বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালত। সঙ্গে ১০০ কোটি টাকা জরিমানাও। দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে যেতে হয়েছিল আম্মাকে। ওই রায় আম্মার কাছ থেকে রাজ্যপাট থেকে শুরু করে প্রায় সব কিছু কেড়ে নিয়েছিল। ঢলে পড়েছিল আম্মার প্রবলপ্রতাপ। কিন্তু ২০১৫ সালের ১১ মে কর্ণাটক হাইকোর্ট বেকসুর ঘোষণা করে জয়ললিতাকে। আসন সংখ্যা কমলওে, পরের বছর বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরে ইতিহাস সৃষ্টি করে জোড়া পাতা। কারণ, ১৯৮৪ সালের পর তারাই প্রথম শাসক দল, যারা পরপর দু’বার বিধানসভায় নির্বাচনে জয়লাভ করে। মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেন জয়ললিতাই। তাঁর এইভাবে বারবার ফিরে আসার জন্যই ‘লৌহমানবী’ তকমা।
কিন্তু এই লৌহমানবীরও দুর্বলতা ছিল। প্রিয়সখী শশিকলা। আর পাঁচজনের মতো তিনিও জানতেন, এআইএডিএমকে-তে থাকতে হলে ‘আম্মা’র শর্তই শেষ কথা। কিন্তু বন্ধুত্বকে ব্যবহার করে দলে জয়ললিতার সমার্থক হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন তিনি। প্রকাশ্যে সফলও হয়েছিলেন খানিকটা। কিন্তু ভিতরে ভিতরে দলকে দু’ভাগ করে দিয়েছিলেন তিনি। যতদিন আম্মা বেঁচে ছিলেন, তার কানাকড়িও টের পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরই ফের আড়াআড়িভাবে দু’ভাগ হয়ে যায় জোড়া পাতা। ২০১৪ সালে জেলে যাওয়ার আগে ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও পনিরসেলভামকে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসিয়েছিলেন আম্মা। সেসময় কিছু না বললেও, জয়ললিতার মৃত্যুর পর হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি শশিকলা। কে পালানিস্বামীকে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে দল পরিচালনার দায়িত্ব নিতে তৎপর হন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর বস্তুত পনিরসেলভাম এবং পালানিস্বামী গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায় জোড়া পাতা শিবির। নেপথ্যে আম্মার প্রিয়সখী শশিকলা। আম্মার মৃত্যুর পরই দলের সাধারণ সম্পাদক পদে নিজেকে বসান শশিকলা। এই পদে থেকেই দীর্ঘদিন ধরে দল পরিচালনা করেছেন জয়ললিতা। কিন্তু ২০ বছরের পুরনো হিসাববহির্ভূত সম্পত্তি মামলায় বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালতের রায় বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্ট শশিকলাকে চার বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দিতেই আশার আলো দেখে জোড়া পাতা শিবিরের শুভাকাঙ্খীরা। ভাইপো দিনাকরণকে দলের শীর্ষপদে বসিয়ে শশিকলা দুই শিবিরের মধ্যে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখতে চাইলেও, তা কাজে আসেনি। দীর্ঘ আলোচনার পর সন্ধি হয় পনিরসেলভাম এবং পালানিস্বামীর। এক হয় জোড়া পাতা শিবির।
কিন্তু তাতে তেজ ফেরেনি দলের। ২০০৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত তামিলনাড়ুতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। নেপথ্যে জয়ললিতা বা করুণানিধি। এই দু’জনের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে চেন্নাইতে কোনও মিছিল, সমাবেশ করার অনুমতি পায়নি বিজেপির মতাদর্শগত অভিভাবক আরএসএস। অস্তিত্ব জাহির করার চেষ্টা করলেই পুলিসি ব্যবস্থায় তা দমিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু জয়ললিতার মৃত্যুর পর গোটা দলটাই যেন মোদি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার বা বকলমে বিজেপির শরণাপন্ন হয়ে পড়ে। জয়ললিতার মৃত্যুর মাত্র একমাসের মাথায় চেন্নাইতে সমাবেশ করার অনুমতি পায় আরএসএস। আর সবচেয়ে বড় চমকটা আসে ২০১৯ সালে, যখন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ঘোষণা করে এআইএডিএমকে। ১৫ বছর পর দলের এই সিদ্ধান্ত বিশেষত আম্মার মৃত্যুর পর, খানিকটা অবাক করার মতোই।
***
আসলে জয়ললিতা ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। দ্রাবিড় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস বা নিজেকে গোঁড়া ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচয় দিতে কখনও পিছপা হননি তিনি। তাই গভীর ধার্মিক অনুভূতি থাকলেও, উত্তরভারতের হিন্দুত্ববাদী দলকে দিয়ে জয়ললিতাকে সরানোর কথা কখনও ভাবেননি তামিলবাসী। সঙ্গে এটাও ঠিক, কট্টরবাদী হিন্দুত্বের লাইন কখনই গ্রহণ করেননি জয়ললিতা। তাই ধর্মান্তরবিরোধী আইন এনেও, সমালোচনা শুরু হতেই তা প্রত্যাহার করে নেন তিনি। তবে এর অন্য একটা কারণও ছিল। ২০০৪ সালে বিজেপির সঙ্গে জোট বেধে লোকসভা নির্বাচনে লড়াই করেছিল জয়ললিতার দল। কিন্তু ফল হয়েছিল শোচনীয়। তখনই কট্টর হিন্দুত্ববাদী লাইন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন আম্মা। ধর্মান্তরবিরোধী আইন প্রত্যাহারের পাশাপাশি পশুবলি প্রথা বন্ধ করার নির্দেশিকাও ঠান্ডা ঘরে চলে যায়। ওই ভোটের পরই জয়ললিতা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে আর কখনও বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধবেন না। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি এনডিএতে বারবার যোগ দেওয়ার আহ্বান জানালেও, জয়ললিতা তা প্রত্যাখান করে গিয়েছেন।
তাই জয়ললিতার মৃত্যুর পর এআইএডিএমকে কেন বিজেপির হাত ধরল, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। আর এর উত্তর একটাই। সরকারটাকে বাঁচানো। আম্মার মৃত্যুর পর দলকে নেতৃত্ব দেওয়া নিয়ে অনেকগুলো মুখে সামনে আসতে চাইছিল। এমতাবস্থায় দল ও সরকারকে বাঁচাতে তাই প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হতে হয়েছিল পালানিস্বামী ও পনিরসেলভামকে। নইলে এআইএডিএমকের এই অচলাবস্থার সুযোগ নিয়ে সরকার উল্টে দিতে বেশি সময় লাগত না। তাই জয়ললিতাকে শেষশ্রদ্ধা জানাতে এসেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পালানিস্বামী ও পনিরসেলভামকে আশ্বাস দিয়েছিলেন সবরকম সাহায্য করার। তার বিনিময়েই হয়তো এইসব অলিখিত প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছিলেন আম্মার দলের এই দুই শীর্ষনেতা। প্রবীণ সাংবাদিক আর ইলানগোভান সেসময় এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ‘বিজেপির প্রতি কে কতটা বিশ্বস্ত, তা দেখানোর প্রতিযোগিতা চলছে এআইএডিএমকের মধ্যে। সাধে কি আর রাজ্যের মন্ত্রী রাজেন্দ্র বালাজি মোদিকে পিতৃসম বলে সম্বোধন করেছিলেন!’ নাথুরাম গডসেকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলায় দক্ষিণী সুপারস্টার কমল হাসানকে এই বালাজিরই কড়া আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। কমল হাসানের জিভ কেটে নেব বলে হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন তিনি।
অর্থাৎ, যে নরমপন্থী হিন্দুত্ব মনোভাব পোষণ করে তামিলনাড়ুতে বিজেপি বা আরএসএসে শাখাপ্রশাখা বিস্তার হতে দেননি জয়ললিতা, তাঁর মৃত্যুর পর সেই নরম হিন্দুত্বকেই আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে এআইএডিএমকে। বদলে তাদের অস্ত্র বিজেপি বা আরএসএসের কট্টর হিন্দুত্ব। কিন্তু কেন? শুধু কি সরকার বাঁচানোর জন্য এই নীতি নিয়েছে এআইএডিএমকে? উত্তর হয়তো না। এর পিছনে রয়েছে নিজেদেরও বাঁচানোর চেষ্টা। দুর্নীতি মামলায় জয়ললিতা জেলে গিয়েছেন, শশিকলার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাই হয়তো ভয়ে কেউ আর নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের বিরুদ্ধাচারণ করতে চাইছেন না। কারণ, সবাই যে লৌহমানবী নন।
আসলে এই ‘লৌহমানবী’ হওয়ার পিছনে অনেকগুলো কারণ আছে। খুব কাছের মানুষগুলোর কাছে ঠকতে ঠকতে জয়ললিতা একসময় বিশ্বাস করতে শুরু করেন, ‘জীবনে একমাত্র একজনকেই ১০০ শতাংশ বিশ্বাস করা যায়। নিজেকে। আমার জীবনে যা যা হয়েছে এবং তার জন্য আমি যতটা কষ্ট পেয়েছি, তার থেকেই এই শিক্ষা।’
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস