উচ্চতর বিদ্যায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় আগ্রহ বাড়বে। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতে আনন্দলাভ হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ... বিশদ
১৯৭১-এ বারাসতে কান্তি সাহার দাদাদের হাত ধরে ২৫০ বর্গফুট জায়গায় গড়ে ওঠে সাহা ব্রাদার্স। দাদাদের কাছেই তাঁর ব্যবসার হাতেখড়ি। কান্তিবাবু নিজে কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করতেন। সেই সময়ে দাদারা তাঁকে পারিবারিক অংশের ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা দেন। সেটাই ছিল তাঁর তখন একমাত্র পুঁজি। সেই টাকার থেকে ৭৫ হাজার টাকা সেলামি দিয়ে বারাসত হরিতলায় ১৭৫ বর্গফুটের একটি দোকানঘর ভাড়া নেন।
সাহা টেক্সটাইল-এর পথ চলা
১৯৮৬-তে একজন কর্মীকে নিয়ে বারাসত হরিতলায় ভাড়া ঘরে সাহা টেক্সটাইল-এর যাত্রা শুরু। প্রথমে শাড়ি ও সুটিং শার্টিং নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ধারে মহাজনেরা কাপড় দিতেন, সেই টাকা শোধ করে তবেই আবার তিনি কাপড় নিতে পারতেন। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কান্তিবাবু বলেন, ‘সেই সময়ে অনেকে আমাকে ভরসা করে বাকিতে কাপড় দিতেন তখন সেটাই তো বড় ব্যাপার।’ আজ সেখানে ৩৫ হাজার বর্গফুটের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চোখ ধাঁধানো পাঁচতলার বস্ত্রবিপণী। যেখানে শাড়ি থেকে মেটিরিয়াল, প্রসাধনী, কসটিউম জুয়েলারি, বেডকভার, বেডশিট, সুগন্ধী, ঘড়ি, বেল্ট, পুরুষদের পোশাক ইত্যাদি একই ছাদের নীচে পাওয়া যায়। পুরুষদের জন্য রয়েছে ৪০টি দেশজ ও মালটিন্যাশনাল ব্র্যান্ড। সেখানে এখন কর্মীর সংখ্যা ১২০ জন। ২০১৭, ৩ জুলাই উত্তর পেরিয়ে দক্ষিণ কলকাতার ৫১/২ হিন্দুস্থান পার্কে খুলে যায় এই প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় শাখা। সাড়ে ৭ হাজার বর্গফুট জায়গা জুড়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঝাঁ চকচকে তিনতলা বাড়ির এই শোরুমের নামকরণ হয় সাহা টেক্সটাইল আমার বাড়ি। এখানে মোট কর্মীর সংখ্যা ৬০ জন। এছাড়াও শিলচর, ধুপগুড়িতে প্রতিষ্ঠানের ফ্র্যাঞ্চাইজি আছে। এখন এই প্রতিষ্ঠানের ফ্র্যাঞ্চাইজির সংখ্যা মোট ৮টি। এমনকী লন্ডনের হ্যারোতে সংস্থার ফ্র্যাঞ্চাইজি রয়েছে। কান্তি সাহা এখন শুধু একজন বস্ত্রবিপণীর প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নন। তিনি একজন মিনিস্ট্রি অফ টেক্সটাইলের মাস্টার উইভার, ডিজাইনার, প্রডিউসার। তাঁর এই সংস্থা মিনিস্ট্রি অফ সিল্ক ও হ্যান্ডলুম মার্ক সার্টিফায়েড দ্বারা অনুমোদিত। তিনি মনে করেন, রিটেল ট্রেডে যত বেশি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়বে তত বেশি ব্যবসার উন্নতি হবে। এখন তাঁর সংস্থা উৎপাদনও করে। কান্তিবাবু বলেন, ‘শুধু উৎপাদন করে তো লাভ নেই। সেই প্রোডাক্ট তো ন্যায্য মূল্যে বাজারে বিক্রি করতে হবে। সেটার জন্য চাই মার্কেটিং কৌশল। ফ্যাশন ডিজাইনার সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিও তাঁর খুবই পছন্দের।
সাফল্যের নেপথ্যে
কোনও মানুষকে স্থির লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে একশো শতাংশ শ্রম, নিষ্ঠা, সততা, নিয়মানুবর্তীতা, সাধনা এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন। কান্তিবাবুর কথায়, ‘আমি কোনওদিন অর্থের পেছনে ছুটিনি। আমি মন দিয়ে নিজের কাজটুকু শুধু করেছি। আজও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে চলেছি।’ ১৯৮৬-তে সাহা টেক্সটাইলের পথ চলা শুরু হলেও ১৯৯২-তে ধীরে ধীরে সাফল্যের মুখ দেখতে পায়। ১৯৯৬-১৯৯৭ মধ্যে তাঁর পায়ের তলার মাটি শক্ত হয়।
ভারতবর্ষের বাইরে বাজার তৈরি
কানাডা, লন্ডন, আমেরিকা ইত্যাদি বিভিন্ন শহরে অনলাইন পরিষেবার মাধ্যমে এই সংস্থা ব্যবসা করে। এটির দায়িত্বে আছেন কান্তিবাবুর পুত্র শিঞ্জন সাহা। তবে বাংলাদেশে তথা বিদেশের অন্যান্য শহরে বাঙালি ক্রেতার সংখ্যাই বেশি।
নিজস্ব ডিজাইন
২০০৭-এ নিজেই কান্তিবাবু থান কিনে প্রিন্ট করতে শুরু করলেন। এখন ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ১০০ থেকে ১৫০টি লুম আছে যেখানে শুধুমাত্র তাঁর ডিজাইন অনুযায়ী উইভাররা কাজ করেন। এই ধরনের লুমকে ‘লাগার’ বলে। নবদ্বীপে একটি জায়গা আছে যেখানে বাংলাদেশের নোয়াখালি সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন। সেখানে ৫০ থেকে ৫৫টি পরিবার কান্তিবাবুর ডিজাইন অনুযায়ী জামদানি শাড়ি তৈরি করেন।
সমাজের প্রতি
পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ক্রেতা-বন্ধুদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মাতৃদিবস, গণ উপনয়ন, সিঁদুর খেলার মতো সামাজিক অনুষ্ঠান করেন। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি পুরনো মন্দির সংস্কারে তিনি উদ্যোগী হয়েছেন। ইতিমধ্যে ৭-৮টি মন্দির তিনি সংস্কারও করেছেন। গ্রাম বাংলাকে সম্মান জানাতে হাতে বোনা অরণ্য, বুনন, দেশ, কুটিরশিল্প, নোয়াখালি জামদানি, শ্রদ্ধা সংস্কৃতি, অজানা বাংলার মতো শিরোনামে ইকো ফ্রেন্ডলি শাড়ির কালেকশন তাঁর আছে। এছাড়াও মিউজিয়ামে রাখা রাজ পরিবারের বহু পুরনো শাড়ির ডিজাইন নতুন করে ফিরিয়ে এনেছেন। নাম রাজঘরানা কালেকশন। এই কালেকশন সংস্থার বিভিন্ন শাখায় পাওয়া যায়। পুজোর আগে কলকাতায় রাজঘরানা কালেকশনের প্রদর্শনী হবে।
কর্মসংস্থান
কর্মসংস্থান সামাজিক কাজ বলে মনে করেন তিনি। তাঁর সংস্থায় হয়েছে দু’শো জন মানুষের কর্মসংস্থান। এছাড়াও আউট সোর্সিং-এর মাধ্যমে তিনি অনেক মানুষকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন। সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে এঁদের সংখ্যা ৬০০ জনেরও বেশি। দেশে বিদেশে প্রায় ৩০০ জনেরও বেশি মহিলা আছেন যাঁরা এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাপড় নিয়ে কেউ নিজের নামে আবার কেউ সংস্থার নামে ব্যবসা করছেন। গ্রামেও উৎপাদন হচ্ছে। এইভাবে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত গ্রামে জিনিসপত্র উৎপাদনের সঙ্গে কর্মসংস্থানও হচ্ছে। সম্প্রতি সুন্দরবনের সন্দেশখালিতে গিয়ে কান্তিবাবু সেলাইয়েরও প্রশিক্ষণ দিয়ে এসেছেন।
এই শিল্পকে বাঁচাতে উদ্যোগ
তাঁতিদের পরিবারের নতুন প্রজন্ম এই শিল্পে আসতে চাইলে তাঁদের জন্য রয়েছে ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা। এই শিল্পকে বাঁচাতে এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা যাঁরা টেক্সটাইল নিয়ে পড়াশুনা করছেন তাঁদের সবাইকে না পারলেও অন্তত দুজনকে স্কলারশিপ দেবেন বলে জানালেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আগামী এক-দু বছরের মধ্যে দিল্লিতে খুলে যাবে তাঁর নতুন শোরুম। ‘সাহা টেক্সটাইল কালারস অব বেঙ্গল অথবা ন্যাচারাল ফাইবার।’ ইতিমধ্যে তার ট্যাগলাইনও তৈরি হয়ে গেছে—‘বাংলার নামে সবাই রঙিন’। দক্ষিণ কলকাতায় এক বছরের মধ্যে খুলে যাবে আরেকটি শোরুম। যেখানে প্রিমিয়াম সেগমেন্টের ডিজাইনার কালেকশন থাকবে।