উচ্চতর বিদ্যায় সাফল্য আসবে। প্রেম-ভালোবাসায় আগ্রহ বাড়বে। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতে আনন্দলাভ হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ... বিশদ
এই গানের ধারায় শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসাবে আমরা পাই দাশরথী রায়কে। তাঁর গানই দাশরথী রায়ের পাঁচালি বা দাশু রায়ের পাঁচালি নামে খ্যাত। দাশরথীর আগে আমরা এই গানের ধারায় পেয়েছিলাম গঙ্গানারায়ণ নস্কর এবং লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাসকে। গঙ্গানারায়ণের বাড়ি ছিল শোভাবাজারে। একবার শোভাবাজার রাজবাড়িতে তিনি পাঁচালিগান গেয়েছিলেন। সেবার বাগবাজারের পক্ষীর দলের সঙ্গে তাঁর গানের লড়াই হয়েছিল এবং সেই আসরে গঙ্গানারায়ণ জয়ী হয়েছিলেন। তবে জানা গিয়েছে গঙ্গানারায়ণ গান বাঁধতেন না। তিনি ছিলেন গাওনদার। বরং লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস নিজে গান রচনা করতেন। তাঁর গানে বেশ মজা ছিল। ছিল নানা ধরনের হাস্যকৌতুকের উপকরণ। আবার এই ধারায় পাওয়া যায় ঠাকুরদাস দত্তের নামও। । ইনি সেই ঠাকুরদাস, যিনি একসঙ্গে চারটি পৃথক বিদ্যাসুন্দর লিখেছিলেন। পাঁচালি গানেও তাঁর উপস্থিতি নজরে পড়ে। তবে এই ধারায় একচ্ছত্র নায়ক ছিলেন দাশরথী রায়।
দাশরথী ছিলেন খুবই উচ্চবর্ণের এবং বড় বংশের ছেলে। সেখান থেকে একসময় যেন তাঁর জীবনটা হারিয়ে যাচ্ছিল কোনও এক কানা নদীর বাঁকে। সে এক অপমানের এবং দগ্ধ সময়ের উপকথা। তাঁর জন্ম ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দের এদিক ওদিক হবে। কাটোয়ার কাছে বাঁধমুড়ায় তাঁর বাড়ি। ছেলেবেলায় পড়াশোনায় তাঁর মন বসত না। তেমন পড়াশোনাও শেখেননি। তবে মুখে মুখে ছড়া, পদ্য তৈরি করতে পারতেন। ছেলেবেলায় পাঠশালায় পড়া না পারায় গুরুমশায় দিলেন কয়েক ঘা বেতের বাড়ি। সেই বেত খাওয়ার দুঃখে তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘দয়া কর গুরু মহাশয় মোর পানে, / অত প্রহারে বুঝি বাঁচিব না প্রাণে।’ কিছুটা সংস্কৃত এবং কিছুটা ইংরেজি শিখতে পেরেছিলেন মাত্র। কিন্তু পাঁচালি গান রচনার ক্ষেত্রে তিনি যে পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন, তাতে বোঝা যায়, পুঁথি এবং শাস্ত্র সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল যথেষ্ট। কিছুটা ইংরেজি জানার জন্য প্রথম জীবনে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশম কুঠিতে চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই চাকরি তাঁর ভালো লাগত না। তাঁর মন তখন শুধু ছড়া, কবিতা আর গান বাঁধে। বাল্য ও যৌবনের অনেকটা সময় তিনি ছিলেন পীলা নামক গ্রামে। সেখানে ছিল তাঁর মামা রামজীবন চক্রবর্তীর বাড়ি। এই পীলা গ্রামই ছিল তাঁর খ্যাতি-অখ্যাতির পীঠস্থান। সেখানে এক কবি ছিলেন। তাঁর নাম নীলকণ্ঠ হালদার। তাঁর পালাগানে তিনি অকথা কুকথা ব্যবহার করে মানুষের বিনোদনের খোরাক জোগাতেন। সে গান শুনে প্রশ্ন জাগল দাশরথীর মনে। এই কী তবে আদর্শ গানের নমুনা! তাঁর মনই বলল, হতে পারে না। এ গান কখনও মানুষের মনে চিরস্থায়ী হতে পারে না। ভালো গান লেখা দরকার। মানুষের মনে যে গান অনেকদিন থাকবে। লোকে সে গান শুনে বলবে, এই হল দাশরথী রায়ের পাঁচালি।
ভাবলেন এক, আর জীবন তাঁকে নিয়ে গেল অন্য এক ধারায়। সেই গ্রামেই ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেশমকুঠি। সেখানে অনেক মেয়েই কাজ করত। এই সব মেয়ে মূলত সমাজের নিম্নশ্রেণীর থেকে আসত। সকালে তারা কাজ করত রেশমকুঠিতে আর রাতে তারা দেহ ব্যবসা করত। এইরকমই একটি মেয়ের নাম ছিল অক্ষয়া বাইতিনী। লোকে তাঁকে বলত অকাবাঈ। বাইতিনী পদবী শুনে মনে করা হয় অক্ষয়া ছিলেন চর্মকার শ্রেণীভুক্ত কোনও পরিবারের মেয়ে। অক্ষয়া ছিলেন স্বামীপরিত্যক্তা। দাশরথী রায়ের জীবনীকার চন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অকাবাঈয়ের রূপ নিয়ে অনেক শব্দ খরচ করে গিয়েছেন। তার থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে। ‘কৃষ্ণকলেবরে চাকচিক্যের অভাব ছিল না।’ তার গানের গলাও ছিল বেশ ভালো। তাই বেশ কিছু দলে অকাবাঈ কবির গান করতেন। অকাবাঈয়ের সঙ্গে পরিচয় হল দাশরথীর। অকাবাঈয়ের গান শুনে তিনি মুগ্ধ হলেন। মুগ্ধ হলেন তাঁর রূপেও। অকার ডাকে দাশরথী ঢুকে গেলেন কবির দলে। তাঁর কাজ হল গাওনদারদের তাৎক্ষণিক কথার জোগান দেওয়া। আসরে গায়ক যখন ঘুরে ঘুরে গান করতেন, তখন বাঁধনদার হয়ে তার পাশে পাশে ঘুরে গানের কথা তৈরি করে তাঁকে বলতে হত। সেই কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে সুরারোপ করে গায়ক গাইতেন।
কবিগানের নেশায় যখন দাশরথী সৃষ্টির আনন্দ সাগরে ভাসছেন, যখন অকাবাঈয়ের সংস্পর্শ তাঁর কাছে জীবনের এক অনিবার্য সম্পদ বলে মনে হচ্ছে। এনিয়ে তখন চারিদিক থেকে নানা গঞ্জনা এবং অকথা কুকথা শুরু হয়ে গেল। সে ছিল তাঁর লজ্জা, তাঁর অপমান। সবাই বলতে লাগল, ‘বড় ঘরের ছেলে এতটাই রূপোন্মাদ হয়ে গেল যে, তার আর ভালোমন্দ বোধ রইল না। একটা ছোটলোক মেয়ের সঙ্গে এমন ঢলাঢলি! ছি, ছি ছি!’ শুধু সমাজ নয়, তাঁর পরিবার থেকেও তিনি বিতাড়িত হলেন। যেটুকু যন্ত্রণা মনের মধ্যে জমত, তা দূর হয়ে যেত অকাবাঈয়ের সঙ্গে কথা বললে। সমাজ তো শুধু দাশু রায়কেই দোষারোপ করত না। কুকথায় বিদ্ধ হতেন অকাবাঈও। একদিন অকাবাঈ তাঁকে বললেন, ‘রায়, তুমি ফিরে যাও। আমার জন্য এত কলঙ্ক তুমি মেখো না। তোমার কলঙ্ক তো আমার পাপ থেকেই।’
দাশরথী বললেন, ‘আমাকে ছেড়ে অকা তুই বাঁচতে পারবি?’
অকা বললেন, জানি রায় সে খুব কষ্টের। কিন্তু আমাকে পারতেই হবে। তোমাকে ভালবাসি কিনা।’
দাশরথী বললেন, ‘আমি গেলে তুই কী করে বাঁচবি অকা?’
অকা বললেন, ‘আমার কথা ভেবো না রায়। আমি ভিক্ষে করে বাঁচব। আমার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তুমি আমারই থাকবে। কিন্তু তোমার এমন দশা আমি সহ্য করতে পারব না। তুমি অনেক বড় কবি হবে রায়। কিন্তু আমার কাছে থাকলে তুমি সব হারাবে। যাও রায়। তোমার সামনে অনেক বড় কাজ।’
দাশরথী বললেন, ‘তোকে আমি বাঁধমুড়ায় নিয়ে যাব অকা।’
অকা বললেন, ‘সে হয় না রায়, আমার এ মুখ তোমার বাড়ির লোকেদের কি আমি দেখাতে পারি!’
দাশরথী চুপ করে থাকেন। কোন কথা বলতে পারেন না। একটু পরে তিনি গান ধরলেন, ‘দোষ কারো নয় গো মা , আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা...’
চোখের জলে ভাসেন অকা। দাশু রায়ও ব্যথায় কাতর হয়ে ওঠেন। অন্ধকার রাত্রি আরও অন্ধকারে ডুবল দুটি ব্যথিত প্রাণের অস্ফুট কান্নায়।