পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
কেন বেপরোয়া
প্রথমেই বুঝতে হবে, বেপরোয়া মনোভাব বা ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা কখন তৈরি হয়? কোনও একটা পরিস্থিতিতে সহিষ্ণুতার অভাব দেখা দিলে এটা তৈরি হতে পারে। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বললেন, ধরা যাক কোনও একটা কাজ করতে কারও ইচ্ছে করছে। এক্ষেত্রে দুটো জিনিস সক্রিয় হবে। এর মধ্যে প্রথমটা হচ্ছে, ইচ্ছে বা টেম্পটেশন। কিন্তু ইচ্ছে হলেও আমি একটু ধৈর্য ধরে দেখি, এই প্রবণতাও আসতে পারে। দ্বিতীয়ত, আমার মাথার মধ্যে কার্যকারণ কাজ করবে অর্থাৎ যুক্তিসম্মত ভাবনাচিন্তা থাকবে। এই দুটোর অভাব হলেই ঝুঁকি নেওয়া বা বেপরোয়া মনোভাব তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
এখন বেশিরভাগ শিশুই যৌথ পরিবার ছেড়ে অণু পরিবারে বড় হয়ে উঠছে। যৌথ পরিবারে নানা বয়সের বিভিন্ন মানুষ থাকতেন। তাঁদের হরেক মতামত থাকত। সেখানে বাচ্চা দেখত, তার বাবা-মাকে অনেক ক্ষেত্রে আপস করে চলতে হচ্ছে। অথবা অনেকটাই মানিয়ে চলতে হচ্ছে। সেই জায়গাগুলো এখন উধাও হয়ে গিয়েছে। অণু পরিবারে আছে শুধু মা এবং বাবা, যারা নিজের বাচ্চাকে ঘিরে সবরকম স্বপ্ন দেখেন। এই স্বপ্নের ঘোরে বাচ্চাকে বড় করে তোলার মধ্যে বেশ কিছু ফাঁক রয়ে যায়। এই ফাঁকের মধ্যেই পড়ছে ধৈর্য রাখার বিষয়টি।
মা-বাবার ভূমিকা
শিশুর ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার সময় আজকাল অধিকাংশ ক্ষেত্রে মা-বাবা ব্যতীত আর কোনও অভিভাবক থাকেন না বাড়িতে। পায়েল জানাচ্ছেন, যদি কখনও কোনও সংসারে আরও বড় কেউ থাকেন, তাঁদের বক্তব্য সেভাবে গুরুত্ব পায় না। এবার অভিভাবকহীন বাড়িতে মা-বাবাও রাগ হলে বাচ্চাকে যা খুশি বলে দিচ্ছেন। নিজেদের মধ্যে গার্হস্থ্য অশান্তি লাগামছাড়া হয়ে উঠছে। বাচ্চার সামনেই তাঁরা সহ্যক্ষমতা বা সহিষ্ণুতা হারিয়ে ফেলছেন। বাচ্চারা এই ধরনের দৃশ্যপট দেখে দেখে বড় হচ্ছে। এতে রাগ করলে কী কী আচরণ করা যায়, তার একটা সম্যক ধারণা শিশুটি বাড়ির লোকের কাছ থেকেই পেয়ে যাচ্ছে। একজন বাচ্চা হয়তো দেখছে, রাগ হলে কাউকে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করা যায়। থাপ্পড় মারা যায় বা গলা চেপে ধরা যায়— এই ছবিগুলো মনের মধ্যে রেখে সে বড় হয়ে উঠছে।
এর সঙ্গে বাচ্চা যা চাইছে, অভিভাবকরা তৎক্ষণাৎ সেটা হাজির করছেন তার সামনে। ধরা যাক, একটা গাড়ি, সেটা কিনলেও হয়, না কিনলেও হয়। কিন্তু সেটা কিনে দেওয়াই হল। বাচ্চাটি হয়তো দু’দিনের বেশি সেটা হাতে নিয়েও দেখল না। এই যে চাওয়ামাত্র পেয়ে যাওয়া— এতে তার মধ্যে একটা তাৎক্ষণিক পরিতৃপ্তি তৈরি হয়। অতএব দুটো জিনিস ঘটল। এক, তার মধ্যে ধৈর্যের অভাব তৈরি হল। দুই, তার কোনও ইচ্ছে জাগলে সেটা অপেক্ষার কোনও পর্বে নিয়ে যেতে আমরা দিচ্ছিই না। চাইলেই শিশু সেটা পেয়ে যাচ্ছে।
যুক্তিবোধ
এবার এই পরিস্থিতিতে যুক্তিসম্মত ভাবনা বা ‘লজিক্যাল রিজনিং’-এর পরিসরটাও কমে যাচ্ছে। সেটা কীভাবে হচ্ছে, বিশদে জানালেন পায়েল। তাঁর কথায়, ‘বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা এখন অত্যন্ত বেশি ‘প্রোটেক্টিভ’। বাচ্চার সব মুশকিল আমরাই আসান করে দেব, এমন একটা ভাবনা তাঁদের মধ্যে কাজ করে। এই কারণে বাচ্চার সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁরা নাক গলান। আজকাল স্কুলে স্কুলে সব অভিভাবকের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি হয়েছে। সেখানে একটি বাচ্চা অন্য বাচ্চাকে কোনও কারণে যদি সামান্য আঘাত করে থাকে, তা নিয়ে বাবা-মায়েরা ওই গ্রুপে আক্রমণাত্মক হয়ে গিয়ে ভয়ঙ্কর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। বিষয়টা কদর্য রূপ নেয়। এতে কোনও যুক্তিসম্মত ভাবনা কাজ করছে না। বাচ্চা এতে কী বুঝছে? আমি সবসময় নিরাপদে আছি। যাই করি না কেন, বাবা-মা সামলে নেবেন। অথচ আমি কেন ভুলটা করলাম, কেন মারলাম বা কেন মার খেলাম— এমন কোনও প্রশ্ন তার মনে তৈরিই হচ্ছে না। এইরকম কোনও পরিস্থিতি তৈরি হলে সেটা থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসব, সমাধান কীভাবে করব এসবও সে ভাবতে শিখছে না। ফলে কার্যকারণ সম্পর্ক না বুঝেই একটা শিশু বয়ঃসন্ধিতে পা রাখছে।
বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের নিজেদের সমস্যা কিছুটা হলেও নিজেদের সামলাতে দিতে হবে। কারণ বাবা-মা সমাধান তৈরি করে দিলে বাচ্চা কখনও তার মাথা খাটাবে না। এতে তার বিশ্লেষণী ক্ষমতা তৈরি হবে না। এবার যখনই শিশুটির রাগ হচ্ছে বা তার মতের সঙ্গে কিছু মিলছে না, তখন সে বেপরোয়া হয়ে পড়ছে। এর মধ্যে চলে আসছে আত্মহত্যা করার মতো চরম পদক্ষেপও। তার মধ্যে যেহেতু কার্যকারণ বোধ কাজ করছে না, সে তখন ভাবছে, না পাওয়ার থেকে মৃত্যুও শ্রেয়। কিশোরকালে ক্লাস এইট বা নাইনের যে পড়ুয়া এই মারাত্মক পরিণতির দিকে হাঁটা শুরু করে, তার বীজ তৈরি হয়েছে তিন-চার বছর বয়স থেকেই। বাবা-মায়ের ভূমিকা এখানেই প্রশ্নের মুখে।’
ছোট থেকে মা-বাবা এগুলো অনুসরণ না করলে বড় হতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়তে পারে কোনও কোনও বাচ্চা। তখন? এরকম হলে ঠিকমতো কাউন্সেলিং-এর কথা ভাবতে হবে, জানালেন পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট। তাঁর মতে, এটা বাবা-মা এবং বাচ্চা দু’জনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাচ্চার চিন্তার স্তরকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে বোঝাতে হবে। ধরা যাক, কেউ হাত কেটে আত্মহনন করতে গিয়েছিল, তাকে বোঝাতে হবে সেটার জন্য সে কী কী হারাতে পারে। তার সামনে কত উজ্জ্বল পথ রয়েছে।
বাবা-মায়েরও কাউন্সেলিং দরকার। কারণ যে বাচ্চা এমন আচরণ করেছে, তার বড় হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপট কী ছিল জানতে হবে। হতে পারে সেখানে অতিরিক্ত শাসন ছিল অথবা না-বলা অনেক কথা ছিল। আবার এমনও হতে পারে বাবা-মায়ের লাগামছাড়া জীবনযাপন ছিল। এটা পরীক্ষিতভাবে দেখে সেটা পর্যালোচনা করতে হবে।
প্রথমত, ছোট থেকে বাচ্চাদের বোঝাতে হবে, চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে কিছু পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ অপেক্ষা করার গুরুত্ব তাকে বোঝাতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মা-বাবার লাগামছাড়া আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অর্থাৎ চরম শাসন অথবা অতিরিক্ত স্নেহ নয়। দাম্পত্য কলহেও রাশ টানুন। সন্তান আসার আগেই বাবা-মাকে এই নিয়ন্ত্রণরেখা তৈরি করে রাখতে হবে। বাচ্চা যখন খুব ছোট, তখন থেকেই ‘ফ্যামিলি রুলবুক’ তৈরি করতে হবে। ঠিক করে নিতে হবে কোন কোন আচরণ বাচ্চার সামনে করা যাবে না।
তৃতীয়ত, বাচ্চাকে সহজ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে হবে যে কেন কিছু কিছু কাজ করা যাবে না। ধরা যাক, বাচ্চা যখন বড় হচ্ছে, বন্ধুদের সঙ্গে হয়তো ঝগড়াঝাঁটি থেকে মারামারি করল, বা সে কোনও কারণে দেখা গেল অন্ধকার ঘরে গিয়ে একা বসে রইল, কেউ আবার বিনা কারণে বৈদ্যুতিক তার ও সুইচে হাত দিচ্ছে। এগুলো যে সঠিক নয়, তা সংলাপের মাধ্যমে ধাপে ধাপে বোঝাতে হবে। মনে রাখবেন, এই বাচ্চারা আলফা জেনারেশন। যুক্তি ছাড়া মানবে না অর্থাৎ ওদের শুধু বললে হবে না, ‘এটা করিস না।’ ওরা শুনবেই না। তথ্য, যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে। এগুলো বুঝলে লাগামছাড়া ঝুঁকি নেওয়ার আগে ওরা পাঁচবার ভাববে। এই বিষয়গুলো অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে বলেই আজকাল শিশুদের এতরকম সমস্যা হচ্ছে, বললেন তিনি। মোবাইলে শর্ট ক্লিপস দেখার অভ্যেসও একইভাবে বিপজ্জনক। এর সঙ্গে ব্যবসায়িক দিক জড়িয়ে, তা বাচ্চারা বোঝে না। বাবা-মাকে বোঝাতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মাও বিষয়টা জানেন না। ফলে রিলস-এ যা হচ্ছে তা-ই কপি করার প্রবণতা তৈরি হয়।