পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি কর্মে ব্যস্ততা। ব্যবসা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগের পরিকল্পনা। ... বিশদ
কাজে ব্যস্ত মহিলা। ছুটে বেড়ানো মহিলা। বাচ্চার পিছনে মহিলা। মাথা নিচু করা মহিলা। ক্রন্দনরত মহিলা। মহিলাদের নানা মুহূর্ত খুঁজতে গিয়ে এমন কত চেনা ছবি ধরা পড়ে। কিন্তু বিশ্রামরত মহিলা? অবসরযাপনে একা মহিলা? আনন্দে হারিয়ে যাওয়া মহিলা? ঘন ঘন দেখেছেন এমন ছবি? সামাজিক মাধ্যমে আজকাল অনেক প্রশ্নের সঙ্গে ঘুরছে কথাগুলো। প্রজন্মের পর প্রজন্ম দেখতেই ভুলে গিয়েছে এই ছবি। বলা ভালো, এমন ছবি দেখার চোখ বা খোঁজার চোখ তৈরিই হয়নি সমাজে। কারণ এমন মুহূর্ত তৈরি হোক, সেটাই সমাজ কখনও চায়নি। তাই মেয়েদের মননে ছোট থেকেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যতটুকু প্রয়োজন তার বাইরে বিশ্রাম নয়। কাজে কাটুক বেলা। নইলে সংসার উচ্ছন্নে যাবে। যুগ যুগ ধরে সংসারের হাল ধরে রেখেছে তো মেয়েরাই। মাথায় এই মহিমার ভার বইতে বইতে চলে আসে বার্ধক্য। তখন শরীর এমনিই অচল। বসে পড়ার দিন। কিন্তু কাজের মাঝে মেয়েদের অবসরযাপন নিয়ে ভাবনা থাকে কি?
বাড়ির কর্তাটি কর্তা হওয়ার আগে ছোট থেকে দেখে এসেছেন তাঁর মা একা সংসার ধরে রেখেছেন কী নিপুণভাবে। তাই কর্তা হওয়ার পরে তাঁর মা এবং তিনি দু’জনেই প্রত্যাশী হয়ে থাকেন, পরবর্তী বধূটিও একই ভূমিকায় দড় হবে। বাড়ির লোকের হাজারো বায়নাক্কা সামলাবে, আধুনিক যুগের মেয়ে হলে অফিস সেরে সংসারে ডুব দেবে ঘড়ির কাঁটা মেনে, সঙ্গে সন্তানের পড়াশোনা দেখার উপরি দায়িত্ব। বাচ্চারা তো মায়ের কাছেই পড়বে, অলিখিত নিয়ম।
অবসর আর কীভাবে পাবে সেই মেয়েটি? শরীরকে বিশ্রাম দিতে যতটুকু দরকার, সেইটুকু তো সে পাচ্ছে। এটাই তো অনেক। অবসরের মুহূর্ত না পেলেও তার মাথার পরতে পরতে অনেক চিন্তা খেলা করে। সে কোথা থেকে যেন সাহস পেয়ে যায়।
***
তার ভাবনায় দেখা হয় একটা অন্য পৃথিবীর সঙ্গে। সেই পৃথিবীতে আরও অনেক মেয়ে। অনেক রকম তাদের লড়াই। সে জানে, যুদ্ধের সঙ্গে পৃথিবী আজ থেকে ঘর করছে না। যুদ্ধ এখন অভ্যাস। সে একসময়ে গানে শুনেছে, ‘উপসাগরীয় যুদ্ধ টিভিতে দেখে খেয়েছে মানুষ রাতের খাবার রোজ...।’ ফিরে এসেছে সেই বেলা। এখন পৃথিবীর এক প্রান্তে যুদ্ধ হয়, আর এক প্রান্তে তড়িৎ গতিতে সে খবর পৌঁছয়। কিন্তু সে খবরে কারও দৈনন্দিন জীবনে একফোঁটা আঁচ পড়ে না।
যুদ্ধটা গাজায় হচ্ছে। অনেক মানুষ বেঘর। অনেক শিশুর ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে। মেয়েদের আর মায়েদের অবসর নেই। অবসরের কথা তাদের মাথাতেও আসে না আর। আছে শুধু দুর্ভাবনা আর অসহায়তা। যুদ্ধহীন পৃথিবীর অন্য অংশে বাস করা মেয়েটির মতোই। তাই সে ওই দুনিয়ার মেয়েদের কথা জানতে চায়। তাদের অবস্থার সামনে নিজেকে বসায় আর ভাবে, আমার মাথার ওপরে ছাদ আছে। বাড়িতে খাবার আছে। অসুখ হলে কেউ হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার আছে। এত ‘আছে’-র ভিড়ে কিছু কিছু ‘নেই’-কে তো মেনে নেওয়াই যায়।
শান্ত বিশ্বের মেয়েটি চেয়ে চেয়ে দেখে, ওই প্রান্তে মেয়েদের বাড়িঘর নেই। মাঝে মাঝে আশ্রয় শিবিরও গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। এবেলা কাছের মানুষটা আছে, হয়তো বা বেলাশেষে তার সঙ্গে আর দেখা হল না। তারপর দেখা হবেই না আর কোনওদিন। গাজার মেয়েদের এখন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার ভাবনাটাকেও নির্লজ্জ স্বার্থপর মনে হয়। বাচ্চাদের মুখে দেওয়ার জন্য সেই মায়েদের হাতে কিছু নেই। অপরাধবোধ নিয়ে বাঁচা সেই মাকে ঘিরে থাকে বিষণ্ণতার প্রাচীর। চিন্তায় চিন্তায় বদলে যাচ্ছে তার শরীরের দিনলিপি।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম থেকে খবর আসছে, গাজার বহু মহিলা এত উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন যে তাদের ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে স্বাভাবিক তো কেবল যুদ্ধটুকুই। বাকি সব ‘স্বাভাবিক’ বহুদিন হল পাততাড়ি গুটিয়েছে গাজার মাটি থেকে। ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রসঙ্ঘের একটি হিসেব বলছে, গত বছর অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে সেখানে ৫০ হাজার মহিলা ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিনে ১৮৩ জন করে মহিলা মা হয়েছেন ঠিকই। এই সন্তানদের ১৫ শতাংশ কোনও না কোনও সমস্যা নিয়ে বড় হবে। মায়েরা সন্তানের জন্ম দিয়ে শুধুই কাঁদছেন। এই বাস্তব মেনে শৈশব বেড়ে উঠছে গাজায়। কোনও মা বলছেন, ‘এই অবস্থায় কারও জন্মানো উচিত নয়!’ এই মায়েরা বাচ্চাকে দুধটুকুও মুখে তুলে দিতে পারছেন না। কারণ তাঁরা নিজেরাও খেতে পাচ্ছেন না কিছুই। সি সেকশন করা মায়েদের সেলাইয়ের যত্ন নেওয়ার পথ বন্ধ। সেখান থেকে তৈরি হচ্ছে সংক্রমণ। একের পর এক বোমবর্ষণে ধূলিসাৎ হচ্ছে বাড়িঘর। চতুর্দিকে শুধু ধুলোর স্তূপ। সদ্যোজাত শ্বাসটুকুও নিতে পারছে না ঠিক করে। যাঁদের শিশু এখনও ভূমিষ্ঠ হয়নি, তাঁরা আতঙ্কের প্রহর গুনছেন। নাড়ি ছিন্ন হওয়ার পরে যে অন্ধকার পৃথিবী তাঁর সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে আছে, সেখানে কারও বাঁচার কথা নয়। অথচ তাঁর হাতে কোনও উপায় নেই। কারণ তাঁর পালিয়ে যাওয়ার পথ নেই। এই মায়েরা জানেন, চারপাশে কোনও কিছুই আর নিরাপদে নেই।
***
এই সব মুহূর্ত অনিঃশেষ পর্বের মতো ঘুরে ঘুরে ধরা পড়ছে শান্ত বিশ্বের মেয়েটির চোখের তারায়। সারাক্ষণ ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছে সে। অবসর তার চাই না। পরিবার নিয়ে সুস্থভাবে বেঁচেবর্তে থাকাটাই যখন এত দামি, তখন অবসরের বিলাসিতা নিয়ে কী করবে সে? দিনের শেষে সব যুগে সব বিশ্বের মেয়েরাই নিজের আরামের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে বাকি পরিবারকেই। অবসরযাপন তাই তাদের কাছে এখনও অর্থহীন।