পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
একটা সময় ছিল যখন মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর পদবি গ্রহণ করাকেই দস্তুর বলে মেনে নিতেন। নারী তখন নেহাতই সমাজের ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’। অধিকাংশেরই পড়াশোনা সীমিত। নিজস্ব রোজগারের কথা চিন্তারও অতীত। ফলে নিজেদের পরিচয় নিয়ে ভাবনা চিন্তা তাদের কাছে ছিল বিলাসিতা। এমন সময় কখনও বাবা কখনও স্বামীর পরিচয়ে পরিচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক ঘটনা বলে মেনে নিয়েছিলেন মেয়েরা। কিন্তু দিন যত এগিয়েছে, নারীর সামাজিক অবস্থান ততই বদলে গিয়েছে। নারীশিক্ষার প্রসার ঘটেছে। এবং তার সঙ্গে নারীজীবনে এসেছে সচেতনতা। আর সেই সচেতনতা তাদের জীবনযাত্রা, চিন্তাধারা ইত্যাদিতে বিস্তর বদল ঘটিয়েছে। নারী আর প্রশ্নাতীতভাবে কোনও কিছুই মেনে নিতে নারাজ। বিয়ের পর স্বামীর পদবি গ্রহণ নিয়েও তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন। এবং স্বামীর পদবি গ্রহণ করলেও পাশাপাশি বাবার পদবিটিও বজায় রেখেছেন কিছু ক্ষেত্রে। এরও পরে একটা সময় এল যখন বিবাহিত মেয়েরা আর পদবি বদলের ঝামেলায় যেতেই চাইলেন না। পুরুষের মতোই তাঁদেরও একটাই পরিচয়, পিতৃপরিচয়। এবং এরও পরে দেখা গিয়েছে যে সন্তানের ক্ষেত্রেও বাবা ও মা দু’জনের পদবিই পাশাপাশি রাখা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হল, এই পরিচয় বা পদবি সংক্রান্ত বদলের সঙ্গে কি নারীর সামাজিক উন্নতি জড়িত?
বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সমাজতত্ত্ববিদ বুলা ভদ্র বলেন, ‘পদবি যে ব্যক্তির পরিচয়, এই ভাবনাটাই ভ্রান্ত। ব্যক্তির আসল পরিচয় তার কর্মের মাধ্যমে হওয়া উচিত। ফলে পদবি আদৌ না থাকলেই বা ক্ষতি কী? তবে পদবি বদল বা না বদলের যে সিদ্ধান্ত মেয়েরা আজ নিচ্ছেন তার সঙ্গে তাঁদের সামাজিক অবস্থান অবশ্যই জড়িত।’ তিনি আরও বলেন, ফলে উন্নত সমাজের উচিত এই ভেদাভেদ নির্মূল করে পদবি নামের বস্তুটিকেই তুলে দেওয়া।
তিনি প্রশ্ন তুলছেন, ‘মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ে মানেই কি একটা ত্যাগ? তার বাড়ি, পরিচয়, এমনকী চাকরিও কিছু ক্ষেত্রে বদলাতে হবে বিয়ের পর! তাছাড়া বিয়ের পর পদবি বদলে যাওয়া মেয়েদের কাছে খুবই লজ্জাজনক বা অপমানসূচক লাগতেই পারে। কারণ এতে প্রমাণ করা হচ্ছে যে, মেয়েরা বস্তু হিসেবে সমাজে গণ্য হন। বিয়ের আগে পর্যন্ত বাবার দায়িত্বে ছিলেন, বিয়ের পর স্বামী সেই দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। এই যে দায়িত্বগ্রহণ করা এটা সম্পূর্ণই একপাক্ষিক বলেই নারীর জন্য তা অপমানের। কারণ বিবাহিত নারীর দায়িত্ব স্বামীটি নিচ্ছেন অথচ বিবাহিত পুরুষটির দায়িত্ব কিন্তু স্ত্রীর হাতে যাচ্ছে না। তাহলে বিয়ের মধ্যে সাম্য ব্যাপারটাই থাকছে না। বরং বিয়ের মাধ্যমে মেয়েরা স্বামীর দাসত্ব স্বীকার করছেন। কিন্তু আধুনিকমনস্ক নারী এই অপমান মেনে নেবেন কেন? অতএব মেয়েরা এর বদল দাবি করলেন।’ কখনও স্বামীর পদবির পাশাপাশি বাবার পদবি রেখে, কখনও স্বামীর পদবি গ্রহণ না করে তাঁরা তাঁদের সামাজিক অস্তিত্ব সংক্রান্ত বদলের একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে চাইলেন। এর পিছনে নারীশিক্ষা এবং নারীর স্বনির্ভরতাও একটা বড় ভূমিকা
পালন করেছে।
মেয়েরা যত শিক্ষিত হয়েছেন ততই তাঁরা সচেতন হয়েছেন। নিজেদের সামাজিক অবস্থান বিষয়ে ওয়াকিবহাল হয়েছেন। এবং এই সচেতনতাই তাঁদের প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করেছে। মেয়েমানুষের খোলস ছেড়ে তাঁরা ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। সমাজতত্ত্ববিদ জানালেন, ‘মেয়েরা যখন এতটা এগিয়েছেন তখন পদবি রাখার দরকারই বা কী? তাহলেই আর এই ভেদাভেদ, ব্যক্তি বনাম বস্তুর সংঘাত, পিতৃতন্ত্র কিছুই থাকবে না। বিভিন্ন উন্নত দেশে এটাকেই সাংবিধানিক নিয়ম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আমাদের দেশেও তাই করা উচিত। শ্রীমদ্ভাগবত গীতায় আছে, কর্মের উপরেই আমাদের অধিকার, ফলের আশা না করেই কাজ করা উচিত। সেই কর্মই তাহলে আমাদের পরিচয় হয়ে উঠুক। পেশাই হোক পরিচয়।’
আর একটা সমাধানও রয়েছে জানালেন বুলা ভদ্র, ‘পদবিকে ঐচ্ছিক করে দেওয়া হোক। মেয়েরা চাইলে পদবি রাখবেন, না চাইলে রাখবেন না। সেক্ষেত্রে তাঁরা বাবা মায়ের পদবি না নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনও পদবিও নিতে পারে। তবে তার মাধ্যমে কোনও সুবিধে গ্রহণ (সংরক্ষণমূলক) করতে তাঁরা পারবেন না। এমন নিয়ম যদি চালু করা যায় তাহলে সেটা সবচেয়ে ভালো উপায় মেয়েদের ব্যক্তি হিসেবে সমাজে চিহ্নিত করার।’ তিনি বললেন, ‘আইসল্যান্ড এমন এক দেশ যে লিঙ্গসাম্যের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। সেখানে কারও পরিচয়ে কোনও পদবি নেই। ফলে আইসল্যান্ডে যদি এই প্রথা চালু করা যায়, তাহলে আমাদের দেশেই বা তা করা যাবে না কেন?’
তবে এই যে পদবি বদল না করা, এটা যে শুধুই মেয়েদের অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে হচ্ছে তা কিন্তু নয়, জানালেন সমাজতত্ত্ববিদ। বরং মেয়েটির মানসিকতাও এর পিছনে একটা বড় কারণ।
তিনি বললেন, ‘যখন একটি মেয়ে বিয়ের পরেও সমাজসিদ্ধ নিয়মে পদবি না বদলে বাবার পদবি কায়েম রাখেন, তখন ধরে নিতে হয় যে তাঁর মধ্যে কোথাও প্রবল মনের জোর কাজ করছে। মেয়েটির পারিপার্শ্বিক, তাঁর বড় হওয়া ইত্যাদির উপরেও তাঁর এই সিদ্ধান্ত নির্ভর করে। যদি মেয়েটি নিজের বাড়িতে খোলামেলা পরিবেশ দেখে অভ্যস্ত হন, নারীর অধিকারের প্রাধান্য দেখতে পান, তাহলে অচিরেই তাঁর মনে স্বনির্ভরতার যুক্তি কাজ করবে। এবং তিনি স্বাধীনভাবে এই ধরনের পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে। অবশ্যই নারীশিক্ষা এবং সচেতনতা একটা বড় ভূমিকা পালন করে এই ধরনের
সিদ্ধান্তের পিছনে।’
আর সন্তান? তাকে বাবা এবং মা দু’জনের পদবি দেওয়ার মাধ্যমে কি মায়ের অধিকার জোরদার করছেন মেয়েরা? বুলা ভদ্র বলেন, ‘এটা খুবই হাস্যকর একটা ব্যাপার। কারণ এইভাবে চললে একটা প্রজন্ম আসবে যাদের নামের পিছনে পঞ্চাশটা পদবি থাকবে। সেটা কি
আদৌ কাম্য?
এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মেয়েদের এই ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখা উচিত।’ তিনি মনে করেন, ‘সন্তানের উপর মায়ের অধিকারের জন্য বিভিন্ন আইন রয়েছে। তার মাধ্যমেই সে অধিকার জোরদার করা যায়। পিতৃ এবং মাতৃপরিচয় পাশাপাশি রেখে মায়ের অধিকার শক্ত হয় না, বরং শিশুটিকে বিড়ম্বনায় ফেলা হয়।’ তাই সমাজতত্ত্ববিদের মতে, ‘পদবি জিনিসটাকেই তুলে দিন। পরিচয়ের আদিতে ব্যক্তির নাম ও তার কর্ম উঠে আসুক। তবেই আমরা উন্নত দেশের সচেতন নাগরিক হয়ে উঠতে পারব।’