পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
খেতে বসে চিকেনের লেগ পিস সন্তানের পাতেই তুলে দেন। লোকসমক্ষে বলেই ফেলেন, ‘আমার ছেলে তো লেগ পিস ছাড়া খেতেই পারে না।’ কিংবা ধরুন, বাড়িতে একটা খেলনা এল। দুই ভাই-বোনের মধ্যে টাগ অব ওয়ার! খেলনাটি কুক্ষিগত করতে চাইছে দু’জনেই। সেই নিয়েই শুরু ঝগড়া-মারামারি। আদতে খুব ছোট ঘটনা। বহু বাড়ির চেনা ছবি। তবে এসব ছোট ঘটনার হাত ধরেই তৈরি হচ্ছে একলা বাঁচার শঙ্কা।
মনস্তত্ত্ববিদরা মনে করেন, ছোট পরিবার, একমাত্র সন্তান, ব্যস্ত বাবা-মা, সব মিলিয়েই এখনকার শিশুদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে না। এই ধাত থেকে যাচ্ছে আগামী দিনের সর্বস্তরের কাজে। তাই ছোট থেকেই ভাগ করে নেওয়ার পাঠ শেখা উচিত। স্কুলজীবনে যেমন সে তার বন্ধুদের নিয়ে খেলতে শিখবে, তেমনই পরিবারের ভিতরেও প্রতিটি সদস্যের ইচ্ছে, শখ, আনন্দকে ছোট থেকে গুরুত্ব দিতে পারবে। ‘ভাগ করে খাওয়া, ভাগ করে বাঁচতে শেখার মধ্যে সন্তানের ভবিষ্যতের মূল্যবোধ তৈরি হয়। এতে পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতাও তৈরি হয়। স্কুলের অনুষ্ঠান বা স্পোর্টসে যেমন সকলকে নিয়ে চলার মানসিকতা প্রয়োজন হয়, তেমনই পরিবারেও একসঙ্গে চলার এই মানসিকতা সন্তানের মানসিক গঠনকে প্রভাবিত করে।’ এমনটাই মত মনোবিদ ডাঃ অমিতাভ মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর কথায়, শিশুর শিক্ষা অনেকটাই নির্ভর করে অভিভাবকদের উপর। পরিবারের বাইরেও যেসব আত্মীয় আছেন, তাঁদের বিপদে বাবা-মা কতটা সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন, বাড়ির অনুষ্ঠান ও কাজে গৃহকার্যে সহায়ক মানুষটিকে শামিল করছেন কি না, ভালো রান্না হলে তিনি ভাগ পাচ্ছেন কি না এগুলি দেখেই সন্তান শেখে। অনেক সময় দেখা যায়, কিছু শিশু অন্তর্মুখী। সেক্ষেত্রে তার অভিভাবককে আরও সচেতন হতে হবে।
সন্তানের মধ্যে শেয়ার করার অভ্যেস তৈরি করতে খেয়াল রাখুন কিছু বিষয়ে।
ছোটবেলা থেকেই শিশুকে নীতিগল্প শোনান। দেশের মহাপুরুষদের গল্প, নীতিশিক্ষার কিছু গল্প, রূপকথার নানা কাহিনি শুনিয়ে তাকে বড় করলে তার মনে ভালোমানুষ হয়ে ওঠার বোধ তৈরি হবে। ভালো যা কিছু তা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার প্রবণতাও জন্মাবে।
দুই সন্তান হলে অনেক সময় বাবা-মাও তাদের মধ্যে ভেদাভেদ করেন। এমনটা চলবে না। রেষারেষি দেখা দিলে তা সামলাতে হবে।
দ্বিতীয় সন্তান আসার পর প্রথম সন্তানের মধ্যে কিছুটা ‘নিরাপত্তাহীনতা’ দেখা যায়। তা থেকেও ভাই-বোনের অভিমান, রেষারেষি তৈরি হয়। প্রথম সন্তান যে আপনাদের কাছে খুব আদরের তা বোঝাতে হবে। দুই সন্তানের পোশাক, খাবার ও সুযোগ-সুবিধের মধ্যে ফারাক তৈরি করবেন না। তাতে সন্তানরাও নিজেদের বঞ্চিত ভাববে না।
সন্তানদের জন্য যেমন পুজোর জামা-কাপড় কিনবেন, তেমন একটি জামা বাড়ির গৃহকার্যে সহায়ক মানুষটির সন্তানের জন্যও কিনুন। সন্তানের সামনেই নতুন পোশাকটি দিন। তাতে তার মধ্যে জিনিসপত্র দেওয়ার বোধ জন্মাবে।
সপ্তাহে একটা দিন সকলে মিলে একসঙ্গে সময় কাটান। সে রেস্তরাঁও হতে পারে, একসঙ্গে সিনেমা বা কোনও আত্মীয়ের বাড়ি এমনকী, পাড়ার কাছে ঘুরে আসাও হতে পারে। বাড়িতেও ‘ফ্যামিলি টাইম’ কাটান।
স্কুলের বন্ধুর প্রয়োজনে ‘খাতা ওকে দিবি না’, ‘টিফিন ভাগ করে খাবি না’ এসব শেখাবেন না। এতে মিথ্যে বলার প্রবণতা ও জটিলতা তৈরি হয়।
সন্তানের সঙ্গে কারও তুলনা করবেন না। তুলনা করলে তার নিজেকে নিয়েই হীনম্মন্যতা তৈরি হবে। সন্তানের দক্ষতা নিয়ে প্রশংসা করুন।
কাছাকাছি বয়সের দুই সন্তান থাকলে ও তাদের পছন্দ একইরকম হলে টুকটাক কিছু জিনিস একটি করে কিনুন। বলে দিন, সেগুলো যখন যার প্রয়োজন, তখন সে ব্যবহার করবে। চিপস, চকোলেটের মতো লোভনীয় খাবার একটি করেই কিনে দিন ও ভাগ করে খেতে বলুন। এতে বাচ্চা দিয়ে খেতে শিখবে।
বাচ্চার জন্মদিনের একটা বেলা অন্তত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা অনাথ আশ্রমের শিশুদের সঙ্গে কাটান। বাকি একবেলা পরিবার ও বন্ধুদের জন্য বরাদ্দ থাক।
বাড়িতে ভালো খাবার রান্না করলে বা নিত্য খাওয়াদাওয়ায় মাছের বড় টুকরো, চিকেনের লেগ পিস অনেক পরিবারেই শুধু সন্তানের পাতে দেওয়া হয়। এই অভ্যাসে রাশ টানুন। ঘুরিয়েফিরিয়ে সকলের পাতে যাক। এতে সন্তান শিখবে ভালো জিনিস সকলেরই প্রাপ্য, মিলেমিশে নেওয়াটাই জীবনের শিক্ষা।
শিশুর মধ্যে ছোট থেকেই একটি অধিকারবোধ তৈরি হয়। তাই তার প্রিয় কিছু জিনিস সে কারও সঙ্গে ভাগ করতে চায় না। এমন হলে তাকে জোর না করে ধীরেসুস্থে বোঝান। গ্রুপওয়র্কের শিক্ষাও এখানে খুব জরুরি। বাড়ির টুকটাক কাজে শিশুকে শামিল করুন।
‘ওকে দিলে তোমার কমে যাবে’, এটা না শিখিয়ে ‘ওকে দিলে ওরও একটা হয়’ এমন বোধ শেখান। ওর জন্য কিনে আনা খাবার জিনিস বাড়ির সকলের সঙ্গে ভাগ করে খেতে বলুন। অল্প অল্প ভাগ নিলেও তা নিন। কেউ কিছু উপহার দিলে আনন্দ প্রকাশ করতে শেখান। ওকেও উপহার দেওয়ার অভ্যাস করান। এইভাবেই উপহার দেওয়া, শেয়ার করে নেওয়ার আনন্দ পাবে ও। এমনই কিছু স্বভাব ছোট থেকে তৈরি হলে সকলকে নিয়ে বাঁচার আনন্দ উপভোগ করবে সন্তান।