পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক মতান্তর, কলহে মনে হতাশা। কাজকর্ম ভালো হবে। আয় বাড়বে। ... বিশদ
স্টেশনের নাম গিরি ময়দান। লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে সেদিন ট্রেনটা দিনে দুপুরে হঠাৎই স্লো হয়ে গেল। পাশের বাজার এলাকা থেকে চিৎকার করে উঠল লোকজন। গেল গেল রব। ট্রেন স্লো হতে হতে থেমেও গেল। কিন্তু তাতে কি শেষরক্ষা হল? বাঁচানো গেল আত্মহত্যা করতে আসা মানুষটিকে?
ট্রেনের ড্রাইভারের কেবিনে তখন নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে পড়েছেন ড্রাইভার। চিৎকারের শব্দ এড়িয়ে যেতে কানে হাত চাপা দিলেন। চশমাটা খুলে মুখ মুছে নিলেন একবার। তাঁকে যে স্বাভাবিক হতেই হবে। এতগুলো মানুষের নিরাপত্তা তাঁর হাতে। তাঁকে তো মন শক্ত করে ট্রেন চালাতেই হবে।
হঠাৎই ‘বেঁচে আছে... বেঁচে আছে...’ চিৎকার ক্ষীণভাবে কানে এল তাঁর। দমবন্ধ করে রাখা পরিস্থিতিতে ওই চিৎকার যেন একরাশ ঠান্ডা হাওয়ার মতো। সেই হাওয়ার স্পর্শে মনে সাহস পেলেন দীপান্বিতা দাস। পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ট্রেন নিয়ে এগলেন গন্তব্যে। খড়্গপুরের বাড়ি থেকে এই ঘটনা শোনাচ্ছিলেন দক্ষিণ পূর্ব রেলের যাত্রীবাহী ট্রেনের একমাত্র মহিলা ড্রাইভার। ফোনের আবহে তখন ট্রেনের হুইসল।
‘যেটা বলছিলাম সেটা মাস দুয়েক আগের ঘটনা।
গিরি ময়দান স্টেশনের কাছে একজন আত্মহত্যা করতে এসেছিলেন। ট্রেনে এরকম হয়। খুব খারাপ লাগে। কিন্তু সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম। গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম। একটা লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে হালকা ধাক্কা লেগে আমার গাড়িটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম মারা গিয়েছেন। কিন্তু সবাই বলছে, দিদি তোমার জন্য বেঁচে গেল লোকটা’, হাসলেন দীপান্বিতা। কিন্তু সব পরিস্থিতিতে তিনি বিজয়ী হবেন, তা তো হতে পারে না। ‘আমার ট্রেনের সামনে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো আমাদের জীবনে সাধারণ ঘটনা হিসেবেই দেখতে হয়। কিন্তু প্রচণ্ড টেনশন হয়। নিজেদের এত খারাপ লাগে বলে বোঝাতে পারব না। ঘটনার রেশ থেকে বেরিয়ে আসতে দু’-তিন দিন সময় লেগে যায়। হয়তো আমি এটা করলে বেঁচে যেত, ওটা করতে পারতাম, এগুলো মনে হয়। এটা ছাড়া আমার বাকি চাকরিটা খুব ভালো’, বললেন তিনি।
ছোট থেকে দিদি এবং বোনের সঙ্গে বাবা, মায়ের মেজ মেয়ে দীপান্বিতা মেদিনীপুর টাউনে বড় হয়েছেন। তাঁর বাবা মেদিনীপুর কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন। মা সামলাতেন বাড়ি। ‘আমার মনে হয়, তিন বোন হওয়ার জন্য ট্রেন ড্রাইভারের মতো পেশা, যেখানে মেয়েদের সংখ্যা খুব কম, সেখানে কাজ করতে সুবিধে হয়েছে,’ বললেন তিনি। কেন এমন ভাবনা? তাঁর উত্তর, ‘আসলে ছোট থেকে এখানে যাবে না, ওটা করবে না, এসব শুনে মানুষ হইনি। বাইরের কাজগুলো আমিই করতাম।’
কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে প্রথম পা রাখা দীপান্বিতার। গত প্রায় ২০ বছর ধরে ভারতীয় রেলে কাজ করছেন তিনি। গত এক বছর চালাচ্ছেন যাত্রীবাহী ট্রেন। এর শুরু কীভাবে? তিনি বলেন, ‘অ্যাসিসট্যান্ট লোকো পাইলট হিসেবে আমার চাকরি শুরু হয়। ১০ বছর সেই কাজ করার পর লোকো পাইলট হিসেবে ১০ বছর কাজ করেছি। তখন মালগাড়ি চালাতে হতো। ‘গুডস’ ট্রেনের অ্যাসিসট্যান্ট লোকো পাইলট ছিলাম বহুদিন। তখন ট্রেন নিয়ে অনেক দূরে দূরে যেতে হতো।’ ট্রেন চালানো আপনার পেশা হবে, এ নিয়ে ছোট থেকে কোনও ভাবনা ছিল? স্পষ্ট জবাব দিলেন, ‘না। পাকেচক্রেই এই কাজটা শুরু করি। প্রথম যখন সুযোগ পেলাম, সবাই বাধা দিল। বলল, পারবি না। আমি বলেছিলাম, চেষ্টা করে দেখিই না। ওই চেষ্টা করতে করতেই হয়ে গিয়েছে। বাড়ির লোকও আপত্তি করেছিল। বাবার বন্ধুরা বলেছিল, এটা তো ছেলেদের চাকরি, মেয়েদের নয়। বাবাও দ্বিধায় ছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, করবি? আমি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে কলকাতায় থাকতাম। একটা কোম্পানিতে কাজ করতাম। ভাবলাম, করে দেখি।’
কাজে যত বাধা এসেছে তত জেদ বেড়েছে দীপান্বিতার। ‘এটা ছেলেদের কাজ’— বলে যত বাঁকা চোখে তাকিয়েছে সমাজ, তত যেন নিজেকে প্রমাণ করার জেদ চেপে গিয়েছিল তাঁর। ‘সম্পূর্ণ পুরুষশাসিত জায়গায় কাজ শুরু করেছিলাম। সহকর্মীদের মধ্যে মহিলা ছিলেন না। নতুন যখন কাজ শুরু করি ইঞ্জিনে মেয়েদের ওঠা বারণ ছিল। আমি ইঞ্জিনে থাকলে ওয়াকিটকিতে স্টেশন থেকে জিজ্ঞেস করা হতো, ইঞ্জিনে মেয়ে কেন? কেউই প্রশংসা করেনি। সকলে বাধাই দিত। আমার মনে হয়, তাতেই বোধহয় জেদ চেপে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম, দেখিই না, সবাই বলছে পারবি না। কী এমন কাজ যে পারব না?’ হেসে ওঠেন তিনি।
সপ্তাহে ছ’দিন খড়গপুর থেকে হাওড়া পর্যন্ত যাত্রীবাহী ট্রেন চালিয়ে যাতায়াত করেন দীপান্বিতা। ছুটি নির্দিষ্ট থাকে না। কাজের সময়সীমাও নির্দিষ্ট থাকে না। ‘৮-১০ ঘণ্টা ডিউটি করতেই হয়। খড়গপুর থেকে লোকালে হাওড়া যেতে মোটামুটি সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগে। মাঝে এক ঘণ্টা রিফ্রেশ হওয়ার সময় পাই। তারপর আবার সাড়ে তিন ঘণ্টা ফিরে আসি। আমাদের রুটে এর আগে কোনও মহিলা ড্রাইভার ছিলেন না। শিয়ালদহতে, মানে ইস্টার্ন রেলে হয়তো ছিলেন। কিন্তু সাউথ ইস্টার্ন রিজিয়নে মহিলা ট্রেনচালক আমার আগে কেউ ছিলেন না বলেই জানি,’ বললেন দীপান্বিতা।
ট্রেন ছাড়ার কয়েক মুহূর্ত আগে প্ল্যাটফর্ম ধরে উর্ধ্বশ্বাসে যাত্রীদের দৌড়। অথবা সিগন্যাল পেয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার সময়ও হয়তো কিছু যাত্রী তখনও ওঠানামা করছেন— ড্রাইভারের সিটে বসে এসব কীভাবে সামলান দীপান্বিতা? তাঁর কথায়, ‘আমাদের সজাগ থাকতে হয়। পিছনে গার্ডের সঙ্গে বেল কোডে কমিউনিকেশন হয় আমাদের। ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তটা খুব সজাগ থাকি। যাতে কোনও সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দিতে পারি। লোকালটা একাই চালাতে হয়।’ রাস্তায় সারাক্ষণ গাড়ি চালকের কানে ফোন দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু ট্রেন চালানোর ক্ষেত্রে সে অবসর নেই। ‘আমাদের ফোন সুইচ অফ থাকে। ডিউটির সম্পূর্ণ সময় ফোন বন্ধ রাখতে হয়। ইমার্জেন্সি থাকলে আলাদা কথা। এটাই আমাদের নিয়ম’, বললেন তিনি।
খড়্গপুরে স্বামী সন্তোষ কুমার প্রধান এবং দুই সন্তানকে নিয়ে দীপান্বিতার সংসার। স্বামীও রেলের অফিসার। মেয়ে আইসিএসসি পাশ করেছে এবছর। আর ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া। পারিবারিক সমর্থন দীপান্বিতা সিংহভাগই পেয়েছেন স্বামীর কাছে। তিনি বললেন, ‘ওর জন্যই আমি
কাজটা করতে পারছি। ‘পারবে না’, একথাটা কখনও ও
বলে না।’
কাজের অবসরে গল্পের বই পড়া দীপান্বিতার নেশা। গান শুনতেও ভালোবাসেন। তাঁর মতো কোনও মেয়ে যদি এই পেশায় আসতে চান, কী বলবেন? দীপান্বিতার উত্তর, ‘এই কাজে কষ্ট আছে। কিন্তু পারবে না, এমনও নয়। ডিউটিতে যাওয়া মানে বাড়ি, ছেলেমেয়েও ভুলে যেতে হয়। কারণ ওখানে এতগুলো লোকের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার হাতে। শুধু এই কথাটাই মনে থাকে। নাহলে এক সেকেন্ডে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে। মনঃসংযোগ করতেই হয়। এগুলো মনে রেখে এই কাজে আসতে হবে।’