সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
মেয়েটির পরিচয় শুধু নয়, তাঁকে মনে করে রেখেছিলেন গিরিশচন্দ্র। তাঁর গলায় সবরকম সুর খেলা করে, তাঁর দীঘল চেহারাটিও রঙ্গমঞ্চে চোখে পড়ার মতো। অথচ এতদিন মেয়েটি শুনে এসেছে, সে তেঠেঙে লম্বা, তার দ্বারা নায়িকার চরিত্র হওয়ার নয়।
কিছুদিনের মধ্যেই নাগেন্দ্রভূষণ মুখোপাধ্যায় মিনার্ভা থিয়েটারে অধ্যক্ষ পদের জন্য ডেকে পাঠালেন গিরিশচন্দ্রকে। এই নাগেন্দ্রভূষণ ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুরের দৌহিত্র। গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের খালি জমি তিনি লিজ নিলেন সিমলার মহেন্দ্রনাথ দাসের কাছ থেকে। স্টার থিয়েটার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তখন গিরিশচন্দ্রের মনোমালিন্য চরমে। মামলা চলছে। ঠিক এই সুযোগটির প্রতীক্ষায় ছিলেন গিরিশ। স্টার থিয়েটারের ঔদ্ধত্য আর অপমানের জবাব দিতে তিনি এসে দায়িত্ব নিলেন মিনার্ভার। অনুবাদ করতে শুরু করলেন শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’। নাট্যসমালোচকেরা বলেন, এর আগেও ম্যাকবেথের অনুবাদ হয়েছে, তার পরেও হয়েছে। কিন্তু বাংলা রঙ্গমঞ্চের অভিনয়ের উপযোগী যে অনুবাদ সেদিন গিরিশচন্দ্র করেছেন, তা ছিল তাঁর সেরা কাজ। নিষ্ঠা আর পরিশ্রম— সবটা তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন ম্যাকবেথের অনুবাদে।
মহলা শুরু হল। ‘লেডি ম্যাকবেথ’ চরিত্রটি দেওয়া হল তখনকার স্বনামধন্য অভিনেত্রী প্রমোদাসুন্দরীকে। শুরু হল তাঁর তালিম। কিন্তু গিরিশচন্দ্র সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না কিছুতেই। একদিন রাতে রিহার্সাল শেষে বাড়ি ফেরার সময় তাঁর মনে পড়ল সেই মেয়েটির কথা। সিটি থিয়েটারের অভিনেত্রী। তিনকড়ি দাসী। সিটি থিয়েটারের চল্লিশ টাকা মাইনের তিনকড়ি একদিন দুপুরে গিরিশচন্দ্রের ডাকে তিরিশ টাকা মাইনেতে এককথায় চলে এলেন মিনার্ভায়। এক বছরের চুক্তি। নিঃশব্দে একলব্যের মতো শুরু হল তাঁর শিক্ষা। অথচ নতুন নাটক ‘ম্যাকবেথ’-এ তিনকড়ির কোনও ভূমিকা নেই। তিনি প্রতিদিন আসতেন, আবার মহলার শেষে চুপচাপ বাড়ি ফিরে যেতেন।
একটি ভূমিকা একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে দেওয়ার পরে তাঁর কাছ থেকে সেটি কেড়ে নেওয়া নিতান্তই অভদ্রতা।
প্রমোদার অভিনয় পছন্দ হয়নি গিরিশচন্দ্রের। সেইজন্যই তিনকড়িকে নিয়ে আসা। কিন্তু প্রমোদার পার্ট তিনকড়িকে দিলে সে যদি প্রমোদার চেয়েও খারাপ অভিনয় করে, তবে তো মহাবিপদ। প্রমোদা নিশ্চয়ই পরে আর সেই পার্ট করতে চাইবে না। তবুও নাটকের স্বার্থে একটা সুযোগ নিলেন গিরিশচন্দ্র। তাঁর অভিজ্ঞ চোখ বুঝে নিয়েছিল, মহলার ঘরে বসে ওই নতুন মেয়েটি একাগ্রচিত্তে শিখে নিচ্ছে যাবতীয় কলাকৌশল। গিরিশচন্দ্র বারবার ভুল সংশোধন করছেন প্রমোদার। একসময় বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘নাঃ তোর দ্বারা এ পার্ট হবার কোনও আশা নেই’। মিনার্ভা থিয়েটারের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীকে ভরা মহলাকক্ষে সবার সামনে এই অভিযোগ হজম করতে হল। কারণ, যিনি বলছেন, তাঁর নাম গিরিশচন্দ্র। সকলে স্তম্ভিত। গিরিশ গম্ভীর হয়ে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর বলেন, ‘এর দ্বারা যখন এ পার্ট হল না, তখন যে নতুন অভিনেত্রীটি এসেছে, তাকে ডাকো দেখি, তার দ্বারা একবার চেষ্টা করে দেখা যাক কতদূর কী দাঁড়ায়।’
উঠে দাঁড়ালেন তিনকড়ি। গিরিশ বলেন, ‘বলো দেখি একটুখানি, কেমন বলতে পারো।’ তিনকড়ি জীবনের এই শ্রেষ্ঠ সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। প্রখর বুদ্ধিমতী তিনি। তখনই সর্বসমক্ষে কিছু না বলে ঠিক এক রাত সময় চাইলেন গিরিশচন্দ্রের কাছে। আর সেই একটি রাতের মধ্যে গিরিশচন্দ্রের শেখানো সমস্ত কৌশল সহ মুখস্থ করে ফেললেন লেডি ম্যাকবেথের ট্র্যাজিক সংলাপ।
পরদিন উপচে পড়া মহলার ঘরে তিনকড়ির অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন স্বয়ং গিরিশচন্দ্র। ছ’নম্বর বিডন স্ট্রিটের মিনার্ভা থিয়েটারে ১৮৯৩ সালের ২৮ জানুয়ারি শনিবার বাংলা রঙ্গমঞ্চ পেল এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীকে। অনেকেই মনে রাখেননি, লেডি ম্যাকবেথের ভূমিকায় সেদিন অসাধারণ অভিনয় করলেন অনেকের চোখে ‘অশিক্ষিতা, বারাঙ্গনা’ তিনকড়ি দাসী। শুধু তাই নয়, পরবর্তী আরও বহু বছর গিরিশচন্দ্রের সাহচর্যে, শিক্ষায় নিজেকে প্রমাণ করেছেন তিনকড়ি। কিন্তু লেডি ম্যাকবেথের ট্র্যাজিক চরিত্রে এক বাঙালি মেয়ের সেই প্রথম রঙ্গমঞ্চ জয়।
অঙ্কন : সুব্রত মাজী