‘গত বছর জানুয়ারি মাসে আমার সঙ্গে সৌমিত্র পালের বিয়ে হয়। অামাদের ছিল ‘অ্যারেঞ্জড লাভ’। একটি ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে আমাদের আলাপ। সেও এক গল্পই বটে, ক্রমশ প্রকাশ্য। আমার শ্বশুরবাড়ি গৌহাটিতে। লকডাউনের ঠিক আগে আমরা গৌহাটি এসে আটকে যাই। প্রথমদিকে বেশ লাগছিল। অন্য পরিবেশে কর্মহীন জীবনটা উপভোগই করছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম ফেরা অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে তখন ডিপ্রেশন শুরু হল। সৌমিত্রর সঙ্গে ঝগড়া করতাম, ফাঁকা রাস্তাঘাট দেখে কান্নাকাটি করতাম...। এরকম কিছুদিন কাটার পর ডিপ্রেশন কাটানোর জন্য লাগাতার সিনেমা দেখতে শুরু করলাম। তাতেও তেমন কাজ হচ্ছে না দেখে মেডিটেশন করলাম কিছু দিন। তারপর ইউকুলেলে বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখলাম। এইভাবে অবসাদও অনেকটাই বাগে এনে ফেলেছি। এখন আর যখন তখন মনখারাপ হয় না। তবে তার জন্য দেড় আঙুলে একটি প্রাণের অবদান সবচেয়ে বেশি। হ্যাঁ, আমার ছোট্ট কন্যা সন্তানটির কথাই বলছি। আমার কোল আলো করে আমার মেয়ে এসেছে ঘরে। ব্যস, সব ডিেপ্রশন নিমেষে গায়েব। এখন ওকে নিয়েই সময় কেটে যাচ্ছে।’ প্রায় এক নাগাড়েই বললেন অভিনেত্রী অঙ্কিতা মজুমদার পাল। আজ আমরা তাঁরই মুখোমুখি।
• দুর্গা পুজো কেমন কাটল?
•• বিয়ের পর এটা আমার দ্বিতীয় পুজো। ষষ্ঠী, সপ্তমী বাবা মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে অষ্টমীর সকালে অঞ্জলি দিয়ে বিকেলে গৌহাটি এসেছিলাম শ্বশুরবাড়ি। আজ এখানে লক্ষ্মীপুজো, তাই গৌহাটিতেই রয়েছি। গতবছর প্রতিটা মুহূর্ত খুব মজা করেছি। এ বছর তার কিছুই হল না। আমি যেহেতু এবছর মা হয়েছি, তাই আমাকে বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। এখনও আমরা বাড়িতে গৃহকাজে সাহায্যকারী কাউকে ঢোকাইনি, ভরসা হচ্ছে না।
• তার মানে পুরো পুজোটা বাড়িতে বসেই কেটেছে?
• হ্যাঁ, আমার শ্বশুরবাড়ির কমপ্লেক্সে প্রতিবছর দুর্গাপুজো হয়, এ বছর করোনার কারণে সেটাও হয়নি। যদি পুজোটা  হতো তাহলে হয়তো আমি একবার হলেও মায়ের মুখটা দর্শন করে আসতাম। ঘরে বসে ঢাকের আওয়াজ শুনতাম, পুজো পুজো ভাব হতো মনের মধ্যে। কিন্তু এবছর কখন যে পুজো এল আর কখন চলে গেল সেটাই বুঝতে পারলাম না।
• পুজোর শপিং করেছিলেন?
• শপিং প্রচুর করেছি, তবে সেটা দুর্গাপুজোর জন্য নয়। শপিং করতে আমি খুব ভালোবাসি। আগেই বললাম লকডাউন আর প্রেগন্যান্সি মিলিয়ে একটু অবসাদে ভুগছিলাম। সেটা কাটাতেও আমি শপিং করেছি। এখনও করছি। তবে সবই অনলাইন। আগে কোনওদিন আমি অনলাইনে শপিং করিনি, এ বছরই প্রথম শুরু করলাম। এখন এটাই আমার নেশায় পরিণত হয়েছে।
• আপনার শ্বশুরবাড়ির লক্ষ্মীপুজোর গল্প বলুন।
• আমার শ্বশুরবাড়িতে লক্ষ্মীপুজো বেশ ভালোভাবে হয়। গতবছর লক্ষ্মীপুজোতে আমি এখানে ছিলাম, তাই গত বছরই আমার জীবনের প্রথম নিজের হাতে করা লক্ষ্মীপুজো ছিল। তার আগে বাপের বাড়িতে মা-ই লক্ষ্মীপুজো করতেন। আমি একটু আলপনা দিতাম, মাকে একটু সাহায্য করতাম, ওই পর্যন্ত। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে প্রথমবারই লক্ষ্মীপুজোর পুরো দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়েছিল। আর আমি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সবকিছু সামলেছিলাম। নাড়ু বানিয়েছিলাম, আলপনা দিয়েছিলাম, যদিও শাশুড়ি মা সবকিছু দেখিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু পুজোর এত দায়িত্ব পেয়ে আমার দারুণ লেগেছিল। আমি পাঁচালিও পড়েছিলাম।
• আপনার সঙ্গে সৌমিত্রর পরিচয়ের গল্পটা বলবেন বলছিলেন...।
• আমি আর সৌমিত্র একই ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে বিয়ের জন্য প্রোফাইল খুলেছিলাম। রিলেশনশিপ ম্যানেজারের মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ হয়। তারপর আমাদের ফোনে কথাবার্তা হয়, আলাপ হয় এবং বিয়ে।
• আলাপ আর বিয়ে ব্যস! মাঝের ঘটনাগুলো একটু বলুন।
• প্রাথমিক আলাপের পর আমরা দু’জনে কথা বলা শুরু করি। প্রথম দিন শ্যুটিং চলছিল তাই ওকে বেশি সময় দিতে পারিনি। পরে ফোন করব বলেও আর ফোন করা হয়নি। এদিকে সৌমিত্র আমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করেছিল, তারপর যখন দেখল আমি আর ফোন করলাম না, তখন ভেবেছিল আমি হয়তো বিয়েতে রাজি নই। তাই ভদ্রতা করে সম্পর্ক শেষ করার জন্য গুডবাই নোট পাঠাল। সেটা দেখে তো আমার মাথায় হাত। বুঝলাম খুব ভুল হয়েছে। তখন আমি ওকে ফোন করলাম, এবং তারপরেই  ফোনে আমাদের কথাবার্তা এগতে থাকে। তৃতীয় দিন ফোনে কথা বলার সময় আমি যখন আমার অভিনয় জীবনের স্ট্রাগলের কথা ওকে বলছিলাম, তখনই ও আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ফোনে এমন সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে আমাদের কথাবার্তা বাড়তে থাকে, দেখা হয়, দু’জন দু’জনকে ভালোভাবে বুঝতে পারি, জানতে পারি। আর তখনই হয়তো প্রেমেও পড়ে গিয়েছিলাম। কে জানে? যাই হোক, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি  আমাদের আলাপ হয় আর ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি বিয়ে।
• হানিমুন পর্ব কেমন ছিল?
• এটা আমার জীবনের একটা সুন্দর পর্ব। হানিমুন বলতে যেটা বোঝায় সেটা আমাদের একদমই হয়নি। আমরা আমাদের স্বপ্নের ডেস্টিনেশন সুইজারল্যান্ডে হানিমুন করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ট্যুরিস্টের মতো। সুইজারল্যান্ডের মতো সুন্দর জায়গা হেঁটে চলে উপভোগ না করলে মজা নেই। তাই আমরা খুব হেঁটেছি, ট্রেনে চড়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করেছি। আমরা একটা জায়গায়, একটাই রিসর্টে থেকে দিনগুলো কাটাইনি। বরং প্রচুর ঘুরেছি। জায়গাটা দম্পতিদের জন্য কত সুন্দর আর গুরুত্বপূর্ণ তা অনুভব করেছি। এটা আমার জীবনের বেস্ট পার্ট।
• এখন মেয়ে নিয়ে কেমন কাটছে দিনগুলো?
• সেটা এককথায়  প্রকাশ করা যাবে না। আমার মনে হয়, মা না হলে এই অনুভূতি বোঝা অসম্ভব। আমি নিজেও কোনওদিন ভাবিনি যে এই অনুভূতি এত সুন্দর হতে পারে। আমি যখন সন্তানসম্ভবা ছিলাম তখন আমার মধ্যে অনেক ইমোশন তৈরি হয়। আমি আগের থেকে অনেক বেশি ম্যাচিওরড হয়েছি। কিন্তু যেদিন আমার ডেলিভারি হল, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে বিশেষ। প্রতিদিন আমার মেয়ে একটু একটু করে বড় হচ্ছে আর আমি ওর বড় হয়ে ওঠাটা উপভোগ করছি। দিনগুলো অসাধারণ কাটছে। মেয়ে এসে যেন আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছে। আমি আর আগের মতো নেই। আমার ভুবন জুড়ে শুধু‌ই সে।
• আপনার মেয়ের নাম কী রাখলেন?
• আমার মেয়ের নাম আরুণ্য পাল। আরুণ্য অর্থাৎ সূর্যের প্রথম কিরণ।
• কবে থেকে আবার অভিনয়ে ফিরছেন?
• বিয়ের পরে আশালতা-তে আমার শেষ অভিনয়।  ওটা সান বাংলায় দেখানো হতো। তারপরেও অনেকগুলো কাজ আমার ঝুলিতে ছিল, কিন্তু সেগুলো শুরু হওয়ার আগেই লকডাউন হয়ে গেল। অভিনয়টাকে আমি খুব মিস করি। আশা করা যায় সামনের বছর আবারও কাজ শুরু করতে পারব।
• মাতৃত্ব আর অভিনয় কী ভাবে ব্যালান্স করবেন?
• আরে আগে তো কাজ শুরু করি। তারপর ওসব নিয়ে ভাবা যাবে। তবে চেষ্টা করব দু’টোই একসঙ্গে ব্যালান্স করার। কারণ দু’টোই আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। দু’টোর কোনওটাই আমি ছাড়তে পারব না। বাচ্চার সঙ্গে সময় কাটানো যেমন ছাড়তে পারব না, তেমনই অভিনয়ও ছাড়তে পারব না। তবে এক এক সময় এক একটা জিনিসকে বেশি গুরুত্ব দেব। যেমন এই মুহূর্তে ফোকাস আমার মেয়ে। ওকে নিয়েই আমার সময় কাটছে। কাজ তো আসবে যাবে, কিন্তু আমার মেয়ের ছোটবেলার মুহূর্তগুলো আর ফিরে পাব না।
সাক্ষাৎকার: কাকলি পাল বিশ্বাস