সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
ঘটনা এক: কোনও ঝগড়া-অশান্তি নয়। শ্রীময়ীর মেডিক্যাল টেস্টের রিপোর্টটাই গোলমাল করে দিল সবকিছু। অর্ঘ্যর সঙ্গে ব্রেক আপ হয়ে গেল। ইউটেরাসে সিস্ট আছে জানতে পেরে বদলে গেল অর্ঘ্যর হাবভাব। ফোন করলে সাড়া নেই, মেসেজের উত্তর নেই, দেখাও নেই। শেষে বলল ওর মা কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। পরবর্তী সময়ে সন্তানসম্ভাবনায় যদি সমস্যা হয়। অর্ঘ্যর এমন অবিবেচক, হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর কথাবার্তায় অপমানে বোবা হয়ে গিয়েছিল শ্রী।
ঘটনা দুই: সদ্যবিবাহিতা কৃতীর দু’চোখে অনেক স্বপ্ন। কৃতী ভেবেছিল বিয়ের পরে তাতে ছেদ পড়বে না। অথচ শ্বশুরবাড়ি এসে কিছুদিন কাটতে না কাটতেই স্বপ্নভঙ্গ। উঠতে বসতে বাক্যবাণ— মা কি বাপের বাড়িতে কিছুই শেখায়নি? নিজের মত জানাতে চাইলেই শিক্ষা সহবতের অভাব! এ যেন প্রতি মুহূর্তের অগ্নিপরীক্ষা। সদ্য ছেড়ে আসা বাবা-মা আর পরিবারকে নিয়ে কু’কথা শুনতে শুনতে অপমানের পাহাড় জমে গিয়েছিল কৃতীর মনে।
ঘটনা তিন: সুখবরটা শোনার পর থেকে অনন্যার আদর-আহ্লাদের শেষ নেই শ্বশুরবাড়িতে। তাল কাটল সাধের দিন দুপুরে। লোকাচার অনুযায়ী প্রদীপ আর নোড়া ঝুড়িচাপা রাখা ছিল। অনন্যা প্রদীপ ধরেছিল যার অর্থ মেয়ে হবে তাঁর। তখনই আত্মীয়-স্বজনদের টীকাটিপ্পনি, শাশুড়ি-পিসি শাশুড়ির মুখ কালো। নিমেষে বাড়ির আবহাওয়া বদলে গেল। এরপর নার্সিংহোমে শ্বশুরবাড়ির কাউকে উপস্থিত না দেখে সে বুঝে গিয়েছিল কন্যাসন্তানই এসেছে। একা মৈনাক মেঘকালো হাসিহীন মুখ নিয়ে দূরে দাঁড়িয়েছিল। মুহূর্তের ফারাকে তার আদর সোহাগ সব শেষ।
ঘটনা চার: রান্না মনমতো না হলে পঁচিশ বছর সংসার সামলানো শোভনাকে শুনতে হয়— এত দাম দিয়ে বাজারে করলাম আর সে রান্নার এমন ছিরি! ছুটির দুপুরটাই মাটি। তারপরে ধেয়ে আসে চিরাচরিত অমোঘ বাণী— ‘আসলে ঘরে বসে থাক তো, রোজগার তো আর করো না। অর্থের মূল্য বুঝবে কী করে?’ লজ্জায়, অপমানে মাটিতে মিশে যান শোভনা।
অনন্যা, কৃতী, শ্রীময়ী বা শোভনার মতো বহু নারীই নিরন্তর অপমানের শিকার। এই বিষয়ে কী বলছেন মনস্তত্ত্বের চিকিৎসকেরা? মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইন্দ্রাণী চট্টোপাধ্যায়ের মতে, আমাদের সমাজে কিছু ধারণা বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে। এখনও কোনও মহিলার কালো রং, হঠাৎ হওয়া কোনও অসুখ অথবা দুর্ঘটনা সেই মহিলার লজ্জা হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ আজও নারীর রূপের বিচার হয়, গুণের নয়। অতএব আজও নারীকে ভোগ্যবস্তু হিসেবেই দেখার প্রবণতা সমাজে। পাশাপাশি পুরুষের গায়ের রং বা চেহারা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। আমাদের সমাজের পরিবর্তনটা খুবই বাহ্যিক। স্মার্ট ফোন হাতে থাকলেই তো স্মার্ট হওয়া যায় না।
ইন্দ্রাণীর মতে, সমাজের অদ্ভুত সংস্কারগুলোকে কিছুতেই সরিয়ে রাখা যাচ্ছে না। উদাহরণ দিয়েই বলা যায়, আজও কন্যাসন্তান হলে বাবা মা তার বিয়ের চিন্তায় টাকা জমান। দম্পতি খুব আধুনিক হলেও কোথায় যেন একটা অশান্তির কাঁটা রয়ে যায় তাঁদের মনে। আগের থেকে হয়তো এই মনোভাব এখন কিছুটা কমেছে। তবে তা শহুরে সমাজে অনেকাংশে সীমাবদ্ধ। তাই আমাদের মানসিকতা বদলানোর জন্য শিক্ষার প্রয়োগ ও প্রসার দরকার। মানুষকে সচেতন করতে হবে। এখনও গ্রামেগঞ্জে ষোলো সতেরো বছরে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। পণ দেওয়া-নেওয়াও আকছার চলে। এখনও মহিলাদের সাজপোশাক নিয়ে কটাক্ষ স্বাভাবিত ব্যাপার। এই ধরনের বিষয়গুলোই আমাদের চিন্তায় প্রভাব ফেলে। সমাজের এই অবক্ষয়ের শিকার হতে হয় মেয়েদের।
এর সঙ্গেই এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আরও একটা জানালেন। তাঁর দাবি, মেয়েদের মধ্যেও একাত্মতার অভাব রয়েছে। ‘যখন কোনও নারী নির্যাতিত হয়, তখনও মেয়েরা একজোট হতে পারে না। ফলে সমাজের সব স্তরে নারী জাগরণ কোথায়? নারীর সঙ্গে আর এক নারীর মনের বন্ধনই বা কোথায়? পুত্র ও কন্যাসন্তানের মধ্যে বিভেদ তো মায়েরই সৃষ্টি। তাহলে এক নারীই তো অন্য নারীর বিরুদ্ধাচারণ করছেন। আর সেই কারণে শেষমেশ মেয়েদের লড়াইটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এত উন্নতির পরেও মেয়েরা সঠিক মর্যাদা পাচ্ছেন না।’
ইন্দ্রাণী জানিয়েছেন, প্রতিনিয়ত সেই মানসিক নির্যাতন থেকে ক্রমশ অবসাদের জালে পড়েন মেয়েরা। তাঁর কথায়, ‘শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের চাই সহযোগী ও সহমর্মী মানুষজন ও যথার্থ সামাজিক পরিবেশ। পুরুষতন্ত্র তো পরের কথা। আগে তো মেয়েরা মেয়েদের পাশে এসে দাঁড়াক।’
পরিশেষে একটাই কথা বলার, মানসিক নির্যাতন সমাজের সব স্তরেরই একটা ব্যাধি। যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়, বেশিরভাগ মানুষই শারীরিক নির্যাতনকে অপরাধ বলে মনে করেন। কিন্তু মানসিক নির্যাতনকে নয়। কেননা শারীরিক নিগ্রহের চিহ্ন থেকে যায়। কিন্তু মানসিক নির্যাতনে নারীর মনে যে কী ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে, তা আমাদের সমাজ দেখেও দেখে না।