সন্তানের কর্ম সাফল্যে মানসিক প্রফুল্লতা ও সাংসারিক সুখ বৃদ্ধি। আয়ের ক্ষেত্রটি শুভ। সামাজিক কর্মে সাফল্য ... বিশদ
ইতিহাস জানাচ্ছে, আওয়ামি লিগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিলের ‘৩০ এপ্রিলের ডেডলাইন’ নিয়ে তখন রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল উত্তপ্ত। ২০০৪ সালের ২২ মার্চ বাংলাদেশের খবরের কাগজের শিরোনাম ছিল: ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সরকারের পতন। খবরে বলা হয়, আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যেই ক্ষমতাসীন জোট সরকারের পতন ঘটবে বলে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করে বলেছেন, একমাত্র আল্লা ছাড়া কোনও শক্তি এই সরকারের পতন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
এরপর গোটা বাংলাদেশে ‘জলিলের ট্রাম্প কার্ড’ কথাটি মুখে মুখে ফিরতে থাকে। পতনের ভয়ে চক্রান্ত শুরু করে বিএনপি-জামাত জোট সরকার। আর তারপরই ১ এপ্রিল গভীর রাতে ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ে। ২ এপ্রিল ঢাকা থেকে উড়ে চট্টগ্রামে যান রাষ্ট্রমন্ত্রী বাবর। সঙ্গে পুলিসের তৎকালীন শীর্ষকর্তা শহুদুল হক, নবগঠিত র্যাবের প্রধান আনোয়ারুল ইকবাল। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাবর বলেছিলেন, বিরোধী দল ৩০ এপ্রিল সরকার হটানোর যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে, তার সঙ্গে এই অস্ত্র উদ্ধারের যোগসূত্রের ব্যাপারটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না (সূত্র: প্রথম আলো, ৩ এপ্রিল, ২০০৪)। তাঁর এই মন্তব্য ভাসিয়ে দেওয়ার পর বিএনপির নেতারা অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় আওয়ামি লিগকে অভিযুক্ত করে বক্তব্য-বিবৃতি দিতে থাকেন। যদিও শুরু থেকেই এই অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনার তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়া চালাতে পুলিস অফিসারদের অনীহা ছিল। অস্ত্র আটকের ৩৬ ঘণ্টা পর কারও নাম উল্লেখ না করে পুলিস কর্ণফুলি থানায় দু’টি মামলা করেছিল মাত্র। আসলে আওয়ামি লিগের গায়ে কালি মাখাতে এটাই ছিল বাবরের খেলা!
বাবরের দাপট এমনই ছিল যে, তাঁর কথায় এক সময় নেত্রকোনার কোণায় কোণায় বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খেত। সেখানে কায়েম করেছিলেন ভয়ঙ্কর এক ত্রাসের রাজত্ব। মদন-মোহনগঞ্জ-খালিয়াজুরি উপজেলা নিয়ে গঠিত নেত্রকোনা-৪ আসন। ২০০১ সালে ওই আসন থেকে বিএনপির টিকিটে নির্বাচিত হয়েছিলেন ‘ক্যাসিও বাবর’ নামে সুপরিচিত লুৎফুজ্জামান বাবর। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের মন্ত্রিসভায় পেয়েছিলেন অতিগুরুত্বপূর্ণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্ব। রাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও এককভাবে ওই মন্ত্রক চালাতেন তিনিই। আর হত্যা, ত্রাস, লুটপাট, দুর্নীতি, হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলাসহ গোটা নেত্রকোনাকে জর্জরিত করেছিল বাবর গ্যাং। ওই সময় বাবরের ইন্ধনে হিন্দু পরিবারের বিশাল সম্পক্তি দখল হয়ে যায়।
জাতীয় পার্টির সরকারের আমল থেকে বাবর বেপরোয়া চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। বাবরের ঢাকা-ব্যাঙ্কক রুটে লাগেজ ব্যবসা ছিল। সেইসময় ‘লাগেজ বাবর’ নামেও পরিচিত ছিলেন। বাবর জাপানি ঘড়ি ক্যাসিও’র ছত্রছায়ায় লাগেজ ব্যবসাটি করতেন। ব্যাঙ্কক থেকে আসা ক্যাসিও ঘড়ি বর্ডার দিয়ে ভারতে পাচার করতেন। রাজশাহী বর্ডারে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। সেই সময় এরশাদ ক্ষমতায় থাকায় রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনওভাবে পার পেয়ে যান। একবার নয়, একাধিকবার। বাবরের ইতিহাস গোটাটাই কালো। তাঁর রোজগারের সমস্তটাই অবৈধ। এরশাদের পতনের পর কথিত আছে বাবর খালেদা জিয়াকে একটা জিপ উপহার দিয়েছিলেন। এবং একজন নেতার সঙ্গে লেনদেন করে বিএনপি থেকে মনোনয়ন বাগিয়ে নেন। সেটা ১৯৯১ সাল। সেবার ভোটে জিতলেও ১৯৯৬-এ আবার হেরে যান। যদিও চার বছর পর আবার ফিরে আসেন বাবর। বিএনপিতে যোগ দেওয়ার পর তাঁর যাবতীয় কলঙ্ক ঢাকা পড়ে যায়। হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। এই সময়ই তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময়ই মগবাজারের শীর্ষ জঙ্গি আরমানের সঙ্গে একত্রিত হয়ে সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেই আমলে তাঁর নাম হয়েছিল ‘ক্রসফায়ারের জনক’। বাবর বলতেন ‘অপরাধ জগতে আমি আগন্তুক নই’।
তিনি যে আগন্তুক ছিলেন না, সেটা ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় হওয়ার পর একেবারে স্পষ্ট হয়ে যায়। অস্ত্র চোরাচালান মামলায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড ও অস্ত্র আইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আলোড়ন তুলেছিল। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আর আওয়ামি লিগ সভাপতি শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলের নেতা। ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা দুই মামলার রায় দেন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। সেই রায়ে লুৎফুজ্জামান বাবর, প্রাক্তন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। অভিযোগ ছিল, হামলায় অংশ নিয়েছিল হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশের (হুজি) জঙ্গিরা। আর এই ষড়যন্ত্রের পিছনে ছিল তৎকালীন জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড আনা হয় পাকিস্তান থেকে।
মহম্মদ ইউনুসের অধীনে তদারকি সরকার ক্ষমতায় আসার চার মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ হাইকোর্ট ‘অভিযোগ গঠনে ত্রুটির কারণ দেখিয়ে’ এই মামলার সব আসামিকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছে। আদালতের এই রায় কীসের বার্তা দিচ্ছে বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হয় না। কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন— এই দুইয়ের চাপে বাংলাদেশে আওয়ামি লিগের সরকারের পতন হয়। গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা চলে আসেন ভারতে। হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে একটাই প্রচার চলেছে— এবার মুক্ত ‘ভারতের ত্রাস’ বাবর। ‘বর্ডারের ওপারে ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে নরেন্দ্র মোদির’। ‘ভারতের কাছে একটা আতঙ্কের নাম’। যেন বাবর জেল থেকে বেরিয়ে এলে ভারত ভয়ে কুঁকড়ে যাবে। ইউনুস সরকারকে একবারও তা নিয়ে মুখ খুলতে দেখা যায়নি। বোঝাই যাচ্ছিল, দ্রুত মুক্তি পেতে চলেছেন অস্ত্র আইন মামলার আসামি, নেত্রকোনার ত্রাস লুৎফুজ্জামান বাবর। আদালতের এই রায় বাংলাদেশের ইতিহাসে লেখা থাকবে। লেখা থাকবে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের বিচারের কাহিনিও।
আর ভারত বিরোধিতার জিগির যত বাড়ছে, তত আক্রমণ নেমে আসছে সংখ্যালঘু মানুষের উপর। অন্তর্বর্তী সরকারের বিদেশবিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এখন প্রচার করা শুরু করেছেন, বাংলাদেশের গণ–অভ্যুত্থানের ঘটনায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যম অখুশি। তাই প্রমাণ করতে চাইছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন চালানো হচ্ছে এবং তালিবান ঘরানার সরকার আসতে চলেছে। এই ধরনের অপপ্রচার দুই দেশের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্বেই এখন সঙ্ঘবদ্ধভাবে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। অথচ, একবারও বলছেন না, কেন ভারত বিরোধিতার উগ্র বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে সরকারের ক্ষমতার অলিন্দে? হাসিনা সরকারের পতনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ নেমে এসেছিল কেন? শুধুমাত্র ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনার দায় কার? কেন দিনের পর দিন গোটা বাংলাদেশে অসহিষ্ণুতা বেড়েই চলেছে? কেন হুজি, জেএমবি, আনসারুল্লা বাংলা টিম, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ, শাহদত-ই-আল হিকমা, হিজবুত তাহিরি-সহ একঝাঁক জঙ্গি সংগঠনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল বাংলাদেশ? এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলিকে নিয়ে দেশ গঠন করা কি সম্ভব?
আওয়ামি লিগের জমানায় যেসব জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, এখন তারাই ফের খোলা জমিনে পা রাখতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের অস্থির রাজনীতির সুযোগ নিয়ে ইতিমধ্যে কারামুক্ত হয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আনসারুল্লা বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসিমউদ্দিন রহমানি। এমনই জইশের ১২জন, লস্কর-ই-তৈবার ৪জন, হিজবুত তাহিরির ১৫জন, আনসারুল বাংলা টিমের ১৮জন, আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্সের ৪জন, আল হিকমার ১২জন, জেএমবির ২৮জন, হুজির ২২জন জঙ্গি মুক্তি পেয়ে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এইসব জঙ্গি সংগঠনের পিছনে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের মদত রয়েছে। এরপরও কি তৌহিদ হোসেন বলবেন, বাংলাদেশে মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলা হচ্ছে?
শুধু রাষ্ট্রসঙ্ঘ কেন, আপনারা ভারত বিরোধিতার মিথ্যাচারের ঝুলি নিয়ে এই দুনিয়ার যে কোনও প্রান্তে যান না কেন ফিরতে হবে শূন্য হাতেই। কারণ, আপনারা মাত্র চার মাসেই নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা খুইয়েছেন। মৌলবাদের প্রতি নমনীয়তা আর পাকিস্তান প্রেম ইউনুস সরকারের মুখোশ খুলে দিয়েছে। দুনিয়ার কাছে এই মুখ দেখাবেন কী করে?
ভুলে যাবেন না, আগুন নিয়ে খেললে, একসময় সেই আগুনেই পুড়ে মরতে হয়!