সন্তানের কর্ম সাফল্যে মানসিক প্রফুল্লতা ও সাংসারিক সুখ বৃদ্ধি। আয়ের ক্ষেত্রটি শুভ। সামাজিক কর্মে সাফল্য ... বিশদ
—জুতা-আবিষ্কার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জুতো আবিষ্কারই যেন যত নষ্টের গোড়া কথাটি কিছু মানুষের জীবনে এক কঠিন সত্য। বহুবছর যাবৎ, বিশেষ করে রাজনীতির জগতের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে ‘জুতো’ শব্দটি বিড়ম্বনারই কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, একুশ শতকে এসে জুতো আর নেহাত একটি পরিধানের বস্তু কিংবা ফ্যাশনসামগ্রী নেই—কিছু মানুষের হাতে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবেই শোভা পাচ্ছে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই অস্ত্রের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছেন কিছু রাজনীতির কারবারি।
রাজনীতিকরা আক্রান্ত হন, এটা পুরনো ব্যাপার। মহাত্মা গান্ধীর মতো মানুষেরও প্রাণ নিয়েছে এক আততায়ী। ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত বসু থেকে কংগ্রেসের ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধীসহ অনেকেরই বিরুদ্ধে এই ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এজন্য তাঁদের উত্তরসূরিরা গর্ব করে বলতে পারেন, ‘আমাদের নেতা দেশের জন্য আত্মবলিদান করেছেন।’ কিন্তু, জুতো এমন এক হীন বস্তু যে, তা যত দামিই হোক, তা দিয়ে কাউকে আক্রমণ করলে আক্রান্ত ব্যক্তি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তা প্রচার করেন না। এমনকী প্রকাশ্যে ঘটে যাওয়া কাণ্ডও, চেপে যাওয়ার সুযোগ থাকলে অনেকে তার সদ্ব্যবহারই করেন। যেমন মনে পড়ে, ২০১২ সালে গড়বেতার তৎকালীন বিধায়ক ও একদা দাপুটে সিপিএম নেতা সুশান্ত ঘোষকে জুতোপেটা করার ঘটনা। বেনাচাপড়া কঙ্কাল কাণ্ডে তাঁর শ্রীঘরবাসের বন্দোবস্ত হয়েছিল। ১৮১ দিন কারাবাসের পর সুপ্রিম কোর্ট মারফত তিনি জামিন পান সে-বছর ৭ ফেব্রুয়ারি। এরপর ৬ মার্চ মেদিনীপুর কোর্টে হাজিরা দিয়ে তিনি গাড়িতে ওঠার মুখেই এক যুবক পায়ের চটি খুলে সুশান্তকে ‘অভিনন্দন’ জানায়। ৮ ফেব্রুয়ারি ‘গণশক্তি’ কাগজ সুশান্তর মুক্তির খবর চড়িয়ে বাড়িয়ে ছেপেছিল। কিন্তু সিপিএমের সেই দৈনিক মুখপত্রই ৭ মার্চ সুশান্তকে জুতো দিয়ে নিগ্রহ সম্পর্কে টুঁ শব্দটি করেনি। কিল খেয়ে কিল হজম করার এমন দৃষ্টান্ত কমই আছে।
আবিষ্কার হওয়ার পর বহু জিনিস হারিয়ে গিয়েছে। বেশিরভাগ জিনিসেরই উপযোগিতা একটা সময়ের পর ফুরিয়ে যায়। ফলে অব্যবহারই হয় সেসব বস্তুর ভবিতব্য। আর তা থেকেই বিস্মৃতির অতলে যাওয়া। কিন্তু, জুতো এই গোত্রে পড়ে না। ৪০ হাজার বছর আগে থেকে নাকি মানুষ জুতো পরছে। আর আবিষ্কার হওয়া ইস্তকই তা চলমান। দিনকে দিন লপেটার শ্রীবৃদ্ধিও লক্ষণীয়। তাই ‘চলছে চলবে’ যে বস্তুর একমাত্র স্লোগান তাকে নিয়ে ‘অতিশয় জনপ্রিয়’ সমস্ত ব্যক্তিরই বিশেষ সতর্কতা বাঞ্ছনীয়।
প্রতিদ্বন্দ্বী একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকে জুতো দেখানো হলে, এমনকী জুতোপেটা করা হলেও তা নিয়ে মশকরা করা ঠিক নয়। কেননা, কালই তাঁর দিকে, নিদেন পক্ষে তাঁর কোনও প্রিয় নেতার দিকে ধেয়ে আসে অন্য জুতো। জুতো সত্যিই এক বিষম বস্তু!
জুতো নিয়ে আছে বিভ্রান্তিও। এই প্রসঙ্গে ২০২২-এর একটি ঘটনা স্মরণীয়। ‘ভারত জোড়ো
যাত্রা’য় রাহুল গান্ধী রাজস্থানের আলোয়ারে তখন, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আর তাঁর সামনে ঝুঁকে জুতোর ফিতে বাঁধছেন প্রাক্তন মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং আলওয়ার। এই ভিডিও টুইট করে বিজেপির অমিত মালব্য দাবি করেন, রাহুলের জুতোর ফিতে বেঁধে দিচ্ছেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা! এই তুমুল বিতর্কের কংগ্রেসি জবাব মিলল, নিজেরই জুতোর ফিতে বাঁধছিলেন জিতেন্দ্র। পরে জিতেন্দ্রও একই কথা জানান। এই ‘অবমাননাকর’ মন্তব্যের জন্য মালব্যকে ক্ষমা চাইতে হবে বলেও দাবি করেন তিনি।
গত ৯ সেপ্টেম্বেরর ঘটনা। ঝাড়খণ্ড সফরে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী সতীশচন্দ্র দুবে। সেখানে একটি নামী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার উচ্চ পদস্থ কর্তা মন্ত্রীর জুতো সরিয়ে দিচ্ছেন, এমন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই বিতর্কিত ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, একজন দুবের পাজামা ঠিক করে দিচ্ছেন এবং অন্য একজন তাঁর জুতো সরাচ্ছেন। ‘লজ্জার বিষয়’টি শেয়ার করে কংগ্রেস অভিযোগ করে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মকর্তারা নিজেদের দুর্নীতি আড়াল করার জন্য নাকি ওইভাবে মন্ত্রীকে খুশি করেছেন।
গত ২ অক্টোবরের ঘটনা। জমি কেলেঙ্কারিতে এমনিতেই বিপদে রয়েছেন কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া। বেঙ্গালুরুতে গান্ধী জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে তিনিই জড়ালেন নতুন এক অস্বস্তিকর ঘটনায়। একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায় যে, এক কংগ্রেস কর্মী এক হাতে জুতোর ফিতে বেঁধে দিচ্ছেন এবং তাঁর অন্য হাতে জাতীয় পতাকা ধরা।
বিতর্কিত মন্তব্যে কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয়
সিংয়ের জুড়ি মেলা ভার। মধ্যপ্রদেশে ভোটের মুখে পুরনো কথায় প্রধানমন্ত্রীকে খোঁচা দেন তিনি। দিগ্বিজয় প্রশ্ন তুলে দেন নরেন্দ্র মোদির ‘রামভক্তি’ নিয়ে (২০১৮ সালের ২৩ জুলাই)। তাঁর দাবি ছিল, প্রধানমন্ত্রী নাকি আগের বছর জুতো পায়ে আরতি করেছিলেন! অতএব, মোদি আদৌ রামভক্ত নন, তাঁর সবটাই ভড়ং। রামলীলা ময়দানে জুতো পায়ে শ্রীরামচন্দ্রের আরতি করে আসলে ভগবানকে অপমানই করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
অবশ্য জুতোর বিড়ম্বনা রাজনীতির কারবারিদের জন্য এক্সক্লুসিভ নয়, তা পুলিসেরও। গত সেপ্টেম্বরের কাহিনি। পুলিসকে লক্ষ্য করে জুতো ছুড়ে গ্রেপ্তার হন শ্রীরামপুরের এক বিজেপি নেত্রী। চুঁচুড়ায় বিজেপির ‘ডিএম অফিস চলো’ কর্মসূচি ছিল। কিন্তু পুলিস বিজেপি কর্মীদের আটকাতেই ওই ক্রুদ্ধ মহিলা পুলিসকে জুতো ছুড়ে মারেন।
বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় একবার রেলভ্রমণে বেরিয়ে এক সাহেবকে কীভাবে জব্দ করেছিলেন, সে তো প্রবাদ। তাঁর জুতো ফেলে দেওয়ার জবাবে সাহেবের কোট জানালা দিয়ে হাপিশ করার হিম্মত দেখিয়েছিলেন আশুতোষ। আমার জুতো কোথায়? আশুতোষের প্রশ্নের উত্তরে সাহেব মুচকি হেসে বলেছিল, ‘হাওয়া খেতে গিয়েছে।’ পরে খোওয়া যাওয়া কোট খুঁজে না পেয়ে সাহেবের প্রশ্ন ছিল, আমার কোট কোথায়? আশুতোষের পাল্টা ও মোক্ষম জবাব ছিল, ‘আমার জুতো খুঁজতে বেরিয়েছে!’
মোগল আমল থেকে আদালতের কর্মী ও উকিল প্রভৃতির পোশাক নির্দিষ্ট ছিল। প্রথম ব্রিটিশ যুগেও বহাল ছিল সেসব। ছাড় ছিল কেবল ‘জজ পণ্ডিত’-দের বেলা। তাঁরা খাটো ধুতি, খালি গায়ে চাদর এবং পায়ে খড়ম অথবা তালপাতার চটি—এই চিরাচরিত বাঙালি পোশাকই পরতেন। তাঁদের মাথা থাকত অনাবৃত। হিন্দু আইনের ব্যাখ্যাতা হিসেবে আদালতে এই জজ পণ্ডিতদের বিশেষ সম্মানও ছিল। কিন্তু হঠাৎই এক সাহেব বিচারকের কাছে তাঁদের
পোশাক বেমানান ঠেকল। তিনি নির্দেশ দিলেন, পণ্ডিতরা পাদুকা/খড়ম/তালপাতার চটি পরে আদালতে ঢুকতে পারবেন না। পণ্ডিতরা এতে রুষ্টই হলেন এবং দেশবাসীও ব্যাপারটাকে তাঁদের প্রতি অসম্মান বলে ধরে নিল। ক্ষোভের খবর পৌঁছল গভর্নর জেনারেল অব্দি। ব্যাপারটা তাঁর কাছেও অবাঞ্ছিত মনে হল। তিনি এর দ্রুত প্রতিবিধানে উদ্যোগী হলেন। নিজ নিজ মতামত প্রসঙ্গে সদর দেওয়ানি আদালত মন্তব্য করল যে, দেশীয় ব্যক্তিদের এই প্রাচীন অভ্যাসের দ্বারা কোনোভাবেই আদালতের অবমাননা হয় না এবং কোনোরূপ অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায় না বিচারকের প্রতিও। অতঃপর, ১৮০২ সালের ২ সেপ্টেম্বর গভর্নর জেনারেল এক বিজ্ঞপ্তি জারিসহ নির্দেশ দিলেন যে, দেশীয় ব্যক্তিরা পূর্বের নিয়মেই জুতো পরে আদালতে যাতায়াত করবেন। ভবিষ্যতে এই ধরনের অবিবেচক আদেশ না-দেওয়ার ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সতর্ক করা হল। জজ পণ্ডিতদের বিরাট জয়ই ছিল সেটি।
বছর দুই আগের কথা (১৯.০৮.২২)। জুতো মারার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র তৈরি করে রাজনীতির কারবারিদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের প্রতিবাদী জনগণ। ওই যন্ত্রের দড়িতে টান পড়লেই জুতোর বাড়ি পড়বে নেতাদের গালে! ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যাচ্ছিল, সমানে চপেটাঘাত চলছে সে-দেশের জোট সরকারের তিন নেতার (প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, পিপিপির সভাপতি আসিফ আলি জারদারি এবং জমিয়তে উলেমা-এ-ইসলাম এফ প্রধান ফজল-উর-রহমান) ছবিতে। ভারতীয় সেনার এক অবসরপ্রাপ্ত কর্তা ওই ছবি শেয়ার করে ক্যাপশন লেখেন, ‘পাকিস্তানে স্টার্ট আপ ইকোসিস্টেম সত্যিই যুগোপযোগী। বিশুদ্ধ দেশের সর্বশেষ উদ্ভাবন।’
শিশুরাষ্ট্র বাংলাদেশ নিজেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ঘোষণা করেছিল। তার দাম মেটাতে হয়েছিল স্বাধীনতার ভগীরথ শেখ মুজিবুর রহমানকে। ঢাকার ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে সপরিবারে (দুই কন্যা হাসিনা ও রেহানা বেঁচে যান দৈবক্রমে) নিহত হন তিনি। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন সেনানায়ক জিয়াউর রহমান। মুজিবহত্যায় যে-বিদেশি শক্তির মদত ছিল বলে সন্দেহ, মানবাধিকারের ধ্বজাধারী সেই রাষ্ট্রের পক্ষেও সেনাশাসককে মেনে নেওয়া কঠিন হচ্ছিল। তাই গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে চাপাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন জিয়াউর। ‘ইসলামিক উম্মা’র জিগির তুলে তিনি বেরিয়ে পড়েন ‘বন্ধুদেশ’ সফরে। পাকিস্তান, সৌদি আরব, লিবিয়া প্রভৃতি দরাজ হাতে ‘দিল’ উপহার দেওয়ারই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নাকি। কিন্তু কার্যকালে কী মিলেছিল? বাঙালি জিয়া পাকিস্তান আমলে (গত শতকের ষাটের দশক) পাঞ্জাবি জিয়াউল হকের অধীনে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের ক্যাপ্টেন ছিলেন। মুজিব-হত্যার পর দুই দেশ দুই জিয়ার খপ্পরে পড়ে। বাঙালি জিয়া ভেবেছিলেন, এই মওকায় পাক রাজকোষ থেকে বিপুল অর্থ আদায় করবেন। জবাবে পাকিস্তানের সেনাশাসক যা বলেছিলেন, বাংলাদেশকে তার চেয়ে বেশি অপমান আর কেউ করতে পারবে না। পাঞ্জাবি জিয়া মিষ্টি করে বলেছিলেন, ‘তোমাদের ফৌজের জন্য আমাদের ৫০ হাজার জোড়া জুতো-মোজা মজুত আছে, নেবে কি?’
হায় বাংলাদেশ, আজও সেই পাকিস্তানের প্রেমের লায়লা! আর নেকড়ের গুহা থেকে স্বাধীনতার আলোয় উত্তরণ যার হাত ধরে, সেই ভারতই আজ পয়লা নম্বর শত্রু! এদেশের সর্বনাশের এই নিশ্চয় শুরু ...।