মরশুমি রোগের ভোগান্তিতে স্বাস্থ্যহানির যোগ প্রবল। কাজকর্মে কিছুটা আলস্য ভাব আসতে পারে। বিদ্যায় উন্নতির যোগ। ... বিশদ
কপিল শর্মার সঙ্গে চন্দ্রবাবু নাইডুর মিল কোথায়? দু’জনেই টিআরপি বাঁচানোর জন্য (কুর্সি বললেও ভুল নয়) চেষ্টা এবং অপেক্ষা, দুটোই শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারেন।
কপিল শর্মার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির মিল কোথায়? দু’জনের কাছেই মার্কেটিংটা শেষ কথা।
শিরোনামে কপিল শর্মা। এমনিতেই সঞ্চালনা এবং কমেডির জন্য যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছেন তিনি। এবার একটু বাড়তি শিরোনাম দখল করেছেন কপিল। অমৃতসরের সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা যুবক। স্ট্যান্ড আপ কমেডি করেছেন, বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক শো’তে অংশ নিয়েছেন, তারপর ধীরে ধীরে তৈরি করেছেন নিজের জায়গা। কী পারেন, সেটা তাঁর জাহির করার বিষয় নয়। বরং দুর্বলতাকেই এনক্যাশ করেন কপিল। তিনি ইংরেজি ভালো বোঝেন না। এলিট ক্লাসের লোকজনের সঙ্গে নিয়মিত ওঠা-বসা করেন, অথচ বুঝিয়ে দেন তিনি ওঁদের গোত্রের নন। দামি ব্র্যান্ডের পোশাক পরেন, কিন্তু পাবলিককে দেখান যে, তিনি সে সবের নামই জানেন না। বলিউডে থেকেও নিজেকে ছোট এবং ভিন্ন দেখানোটাও যে জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হতে পারে, সেটা প্রমাণ করেছেন কপিল শর্মা। ইদানীং তাঁকে নিয়ে বিতর্ক কেন? রবি ঠাকুরকে নিয়ে মশকরা করেছেন তিনি। নিজের শোয়ে বসে ‘একলা চলো রে’ গানটিকে খিল্লির পর্যায়ে নামিয়েছেন। পাশে বসে অভিনেত্রী কাজল (রক্তে বাঙালি, যদিও বেড়ে ওঠায় নয়) খিল খিল করে হেসেওছেন। তাতেই বেজায় ক্ষিপ্ত বাঙালির ইন্টেলেকচুয়াল মহল। প্রতিবাদের ঝড় উঠছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, কপিল শর্মা আসলে পুরো চিত্রনাট্যই সাজিয়েছেন নিজের শোয়ের কথা ভেবে। যাঁরা তাঁর অনুষ্ঠান দেখেন, তাঁদের নিয়ে কপিল চিন্তিত নন। বরং ইন্টেলেকচুয়াল যে শ্রেণি তাঁর সঞ্চালনা এবং অনুষ্ঠানকে ‘লঘু’ বলে মনে করে দূরে সরিয়ে রাখেন, তাঁদের টেনে এনেছেন তিনি। বিতর্কের নামে তাঁরা চ্যানেল বা ওটিটিতে কপিল শর্মাকে দেখছেন। অর্থাৎ, পুরোটাই মার্কেটিং পলিসি। গত ১০ বছর ধরে এই নীতিই আমরা দেখে আসছি নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতার অলিন্দে। উরি হামলা হোক, নোট বাতিল বা মঙ্গলসূত্র... এক একটি ইস্যুকে পাবলিকের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিয়েছেন মোদিজি। কেউ ধন্য ধন্য করেছে, কেউ আবার দুয়ো দিয়েছে। কিন্তু মোদ্দা ব্যাপার হল, প্রত্যেকেই তাকে শুনেছে। গুরুত্ব দিয়ে। এটাই তাঁর সাফল্য। এটাই মার্কেটিং পলিসি। প্রত্যেকের মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ো। বসার ঘর থেকে রান্নাঘরে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত তাই আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অথরিটি নিয়ে প্রশ্ন ছিল না। ফল বেরতেই বোঝা গিয়েছে, সময় খারাপ যেতে শুরু করেছে তাঁর। তিনি বললেই সেটা বেদবাক্য হচ্ছে না। তিনি বললেই সেটা ইস্যু হচ্ছে না। কাজেই নতুন করে নজর মার্কেটিং পলিসিতে। লক্ষ করবেন, মহারাষ্ট্র-ঝাড়খণ্ডের ভোট শিয়রে আসতেই রোজগার মেলা আবার শুরু হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর কিন্তু এতদিন বন্ধই ছিল। আর এবারের রোজগার মেলায় যে ৫১ হাজার ২৪৬ জন নিয়োগপত্র পেয়েছেন, তাঁদের একটা বড় অংশই কিন্তু মহারাষ্ট্রের। প্রশ্ন হল, কেন হঠাৎ মহারাষ্ট্র নিয়ে এত মাথাব্যথা শুরু হয়েছে নরেন্দ্র মোদির? প্রধান কারণ, অথরিটি। কর্তৃত্ব। যেভাবে হোক মহারাষ্ট্র তাঁকে ধরে রাখতেই হবে। কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্যই। হরিয়ানায় বহু আসনেই খুব কম মার্জিনে জিতেছে বিজেপি। সে নিয়ে বিতর্কও কম হচ্ছে না। প্রশ্ন উঠছে তাঁর সত্যিকারের জনপ্রিয়তা নিয়ে। মারাঠা-রাজ্য যদি হেলায় জেতার মতো অবস্থায় তিনি নিয়ে যেতে না পারেন, দলের অন্দর মহলই তাঁকে বাঁকা চোখে দেখবে। এমনিতেই সঙ্ঘ তাঁর উপর আপার হ্যান্ড নিতে শুরু করেছে। সাফ বলে দিয়েছে, বিজেপিকে ‘টিকিয়ে’ রাখতে হলে উগ্র হিন্দুত্বে ফিরতেই হবে। সেই পথে হাঁটা শুরুও হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। গেরুয়া শিবিরের কোর ব্রিগেডই ২৮৮ আসনের মহারাষ্ট্রে মোদিজির উপর তেমন ভরসা রাখতে পারছে না। প্রমাণ? সভার সংখ্যা। ভোটপর্বে দেবেন্দ্র ফড়নবিশকে মহারাষ্ট্রজুড়ে ৫০টি সভার কর্মসূচি ধরানো হয়েছে। নীতিন গাদকারিকে ৪০, অমিত শাহ ২০, যোগী আদিত্যনাথ ১৫। আর নরেন্দ্র মোদি? মাত্র আটটি। এর অবশ্য একটা অন্য প্রচারও আছে—হেরে গেলেও সব দায় মোদিজির কাঁধে চাপবে না। কিন্তু তারপর? অবশ্যই অথরিটি ধাক্কা খাবে নরেন্দ্র মোদি নামক ‘মিথে’র। ঝাড়খণ্ডে জয় পেলেও সেই সাফল্য ধূসর হয়ে যাবে। পূর্বের এই রাজ্যের জন্য চেষ্টাও অবশ্য কম করেননি মোদিজি। ২০১৯ সালে ভরাডুবির পর কেন্দ্রীয় প্রকল্প হাতিয়ার করে আদিবাসী এলাকায় পেনিট্রেশন বাড়িয়ে ফেলেছেন তিনি। ওই এলাকায় বারবার গিয়েছেন, উন্নয়নের কাজে গতি এনেছেন এবং বিজেপির অবস্থান ভালো জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। মহারাষ্ট্রে অবশ্য অপারেশন লোটাসের ভারেই সব চাপা পড়েছে। নরেন্দ্র মোদি খুব ভালোভাবে জানেন, মহারাষ্ট্রে হার মানে দুই ‘প্রধান শরিকের’ (সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে) দাঁত-নখ আরও বেরিয়ে আসবে। নীতীশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডু। তাঁরা বিলক্ষণ জানেন, তাঁদের দু’টি দলের উপরই দাঁড়িয়ে রয়েছে বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির গরিমা। কর্তৃত্ব ও জনসমর্থনে ধাক্কা মানে ব্ল্যাকমেল আরও বাড়বে। আবার উঠবে প্যাকেজ ও স্টেটাসের দাবি। প্রথমেই যে বললাম, ঢলে পড়ায় নীতীশ কুমারের বড় মিল কপিল শর্মার সঙ্গে! পাল্টি খাওয়ার রাজনীতিকে কার্যত স্ট্যান্ড আপ কমেডির জায়গাতেই নিয়ে গিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদির আসন টলমল করলে তিনি যে মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’র সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করবেন না, তেমন গ্যারান্টি ঈশ্বরের পক্ষে দেওয়াও অসম্ভব। আর চন্দ্রবাবু নাইডু? তাঁর আপ্তবাক্য হল, রাজনীতির শো মাস্ট গো অন। একবার গদি খুইয়েছেন। আর কোনও ঝুঁকি তিনি নেবেন না। অন্ধ্রপ্রদেশের ‘উন্নয়ন’ এবং কুর্সি বজায় রাখার জন্য তিনি সবকিছু করতে পারেন। ঠিক যেভাবে কপিল শর্মা তাঁর শোয়ের টিআরপি বাড়িয়ে চলেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, শরিকদের মধ্যে ভাঙনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে সেই সুযোগে শক্তি বাড়াবে কংগ্রেসও। সেটা মোদিজি কখনওই চাইবেন না। ৭৫ বছরের খাঁড়া এখনই ঝুলে রয়েছে মাথার উপর। তাঁরই বানানো নিয়ম, ওই বয়সের পর কেউ বড় পদে থাকতে পারবেন না। জনপ্রিয়তায় ধস নামলে ‘মোদি’ নামের ক্যারিশমা কিন্তু নিয়মের উপর আর খাটবে না। তাই যে করে হোক মহারাষ্ট্র তাঁর চাই। এখানেও প্রতিবন্ধকতা খুব কম নয়। কীভাবে?
১) লোকসভা ভোটের ফল। দল ভাঙাভাঙির খেলা এবং শিবসেনা ও এনসিপির কোমর ভেঙে দেওয়ার পরও রীতিমতো ধস নেমেছে বিজেপি তথা এনডিএর ভোট ব্যাঙ্কে। এনডিএর ২৪ আসনের জায়গায় মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’ দখল করেছে ২৫টি। সবচেয়ে বড় কথা, উত্তর বা পশ্চিম মহারাষ্ট্র, বিদর্ভ, মারাঠাওয়াড়া ও মুম্বইয়ের এলাকাভিত্তিক ফলে কংগ্রেস ছাপিয়ে গিয়েছে বিজেপিকে। লাগাতার নেতিবাচক প্রচার, রাহুল গান্ধীকে নিয়ে রসিকতার পরও হোঁচট খেতে হয়েছে গেরুয়া বাহিনীকে। বিধানসভা নির্বাচনে এই ফলের প্রভাব যে পড়বে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে গেলে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। ২) বালাসাহেবের প্রতি মহারাষ্ট্রর আম জনতার সেন্টিমেন্ট। একনাথ সিন্ধে যতই দল ভেঙে আসুন, দলের দখল নিন না কেন... থ্যাকারে পদবির অধিকারী তিনি নন। উদ্ধব থ্যাকারে কিন্তু সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছেন এবং লাগাচ্ছেন। ৩) বিক্ষুব্ধ প্রার্থী। বিজেপিরই বহু নেতা-মন্ত্রী এবার টিকিট পাননি। এবং তাঁরা সহজে এক ইঞ্চিও জমি ছেড়ে দেবেন, সেটা হচ্ছে না। ফল? ৩৬ জন বিদ্রোহী প্রার্থী এখন মহা গোঁজ হয়ে দেখা দিয়েছে নরেন্দ্র মোদির কাছে। তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় আশঙ্কার ব্যাপার হল, অমিত শাহ বোঝানোর পরও বরফ গলছে না। আর তাই এখন মোক্ষম প্রশ্নটা হল, মহারাষ্ট্র নিয়ে মোদিজি নিজেই কনফিডেন্স ধরে রাখতে পারবেন তো?
সবাই ব্যবসা করতে নেমেছে। তা সে টিভিওয়ালা হোক, বা রাজনীতিওয়ালা। টিভিওয়ালা রবি ঠাকুরের সৃষ্টি নিয়ে ছেলেখেলা করে টিআরপি বাড়াচ্ছেন। আর রাজনীতিওয়ালা ভোটের মুখে জনসভায় দাঁড়িয়ে সেই রবি ঠাকুরের সৃষ্টিই ভুলভাল উচ্চারণে বদলে দিচ্ছেন। লক্ষ্য দু’জনেরই এক—জনতা। এটাই মার্কেটিং পলিসি। মোদিজিও তো এটাই চালিয়ে যাচ্ছেন... হিট হ্যায়, তো ফিট হ্যায়।