উত্তম বিদ্যালাভের যোগ আছে। কাজকর্মে উন্নতি ও কাজে আনন্দলাভ। অর্থাগমের উত্তম যোগ। ... বিশদ
এই যেমন রিপাবলিকান পার্টির রাজনৈতিক শাখায় পরিণত হওয়া ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (মাগা) আন্দোলন। এই বিভ্রান্তিকর আন্দোলনের লাগাতার প্রচার চালিয়ে গিয়েছে আমেরিকার রক্ষণশীল মিডিয়াগুলি। যার প্রবক্তা ডোনাল্ড ট্রাম্প। যাঁর ক্ষমতায় ফিরে আসা মানে আমেরিকার জন্য বিপর্যয়। এটা জেনেও ভোট প্রচারের সময় প্রতিটা সমীক্ষায় ট্রাম্পের জনসমর্থন দেখিয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। ভোটের ফলাফলে তা আরও ছাপিয়ে গিয়েছে। চৌত্রিশটি ফৌজদারি অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আমেরিকানরা ট্রাম্পকে ছুড়ে ফেলে দেননি। বরং বাইডেনের যুদ্ধনীতির তীব্র বিরোধিতা করে দূরে ঠেলে দিয়েছেন ডেমোক্র্যাটদেরই। আসলে আপনি মানুন বা না মানুন, আমেরিকানদের মোহগ্রস্ত করে নিজের দিকে টানার ক্ষমতা তৈরি করে ফেলেছে ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ আন্দোলন। তাতে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর মতো শক্তিশালী মিডিয়াও চিড় ধরাতে পারেনি।
ভোট প্রচারে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের গায়ে ‘ফ্যাসিবাদী’ তকমা লাগিয়ে একের পর এক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে দীর্ঘতম সময় ধরে দায়িত্বে থাকা চিফ অব স্টাফ জন কেলি তাদের সাংবাদিককে জানিয়েছেন, তাঁর সাবেক বস (ট্রাম্প) মনে করেন, ‘হিটলার কিছু ভালো কাজও করেছেন। তিনি অ্যাডলফ হিটলারের মতো কয়েকজন জেনারেল চান।’ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ আরও লিখেছে, খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ রবার্ট প্যাক্সটন একসময় ট্রাম্পের গায়ে ফ্যাসিবাদের তকমা লাগানোকে ফ্যাসিজমের অতিরঞ্জিত ব্যবহার বলে মনে করতেন। কিন্তু ‘ট্রাম্পিজম’-এর মুখোমুখি হয়ে তিনি তাঁর মত বদলে ফেলেছেন। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এই রকম একের পর এক নিবন্ধে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, ট্রাম্প ‘মূলত ফ্যাসিস্ট’। তিনি দৃশ্যতই আত্মসর্বস্ব এবং অন্তঃসারশূন্য একজন মানুষ। গণতন্ত্রের তোয়াক্কা করেন না। কথাবার্তা অসংলগ্ন এবং নানা বিদ্বেষে ভরপুর। তাতেও আমেরিকানদের কিছু যায় আসেনি। উল্টে ট্রাম্পের অভিবাসন নীতিকেই তাঁরা সমর্থন করেছেন। ট্রাম্প বলেই রেখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ভোটে জিতলে পরের দিন থেকেই অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কার শুরু করব’! আর নিউ ইয়র্ক টাইমস ও এনবিসি টিভির নাম আলাদা করে চিহ্নিত করে বলেছেন, ‘দাঁড়াও, দেখতে থাকো তোমাদের কী অবস্থা করি।’
‘দ্য লিঙ্কন’ প্রজেক্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা রিড গ্যালেন বলছেন, আমেরিকানরা প্রায় ৫০ বছর ধরে প্রয়াত রাশ লিম্বোর (প্রভাবশালী আমেরিকান রেডিও ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার, যিনি আমেরিকায় ডানপন্থী চিন্তাধারা প্রচার করতেন) ঘৃণামূলক কথাবার্তা শুনেছেন। এবং প্রায় ৩০ বছর ধরে ফক্স নিউজের একঘেয়ে মুখগুলিকে মিথ্যা ছড়াতে এবং বিভেদ উস্কে দেওয়ার প্রচেষ্টা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ফলে ট্রাম্পের উগ্র ও বিষাক্ত বক্তব্যে আজ আর আমেরিকান ভোটারদের মনে দাগ ফেলে না। বরং ট্রাম্পের উত্থানে প্রতিষ্ঠিত রিপাবলিকান নেতারাই ছিটকে গিয়েছেন। ট্রাম্পের নেতৃত্বে ‘কনজারভেটিভ’ আন্দোলন তাদের সর্বনিকৃষ্ট প্রবৃত্তির প্রকাশ ঘটানোর প্ল্যাটফর্ম পেয়ে গিয়েছে। রক্ষণশীল মিডিয়ায় ট্রাম্প স্থায়ী মঞ্চ পেয়ে গিয়েছেন। তিনি শুধু একটি স্লোগানের মাধ্যমে স্বপ্ন বিক্রি করে গিয়েছেন— ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’! কী ভাবে? বাইরে থেকে জিনিসপত্রের আমদানিতে শুল্ক বসাও, যাতে দেশের শিল্পকে বাঁচানো যায়। অভিবাসন কমাও। মেক্সিকো থেকে বেআইনি অভিবাসন রুখতে প্রাচীর তোলো। কমলা হ্যারিসের সঙ্গে মুখোমুখি বিতর্কে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘সাধারণ আমেরিকান কী স্বপ্ন দেখেন, তা আমি জানি। এবং সেই স্বপ্ন কীভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে, আমি তা-ও জানি’।
২০১৫ সালে ট্রাম্প যেদিন ট্রাম্প টাওয়ারের সেই ‘স্বর্ণালি’ এসকেলেটরে নেমে এসে নিজের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীপদের কথা ঘোষণা করেছিলেন, সেদিন থেকে কনজারভেটিভ আন্দোলন ও মিডিয়ার গতিপথে একটি মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। ২০১৬ সালে মূলত আমেরিকার তথ্যজগৎকে কব্জা করার মাধ্যমে ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছিলেন। রাজনীতির ময়দানে বিতর্ক আর ট্রাম্পকে যেন সমান্তরাল রেখায় এগিয়েছে। ঘৃণাভাষণ থেকে শুরু করে বিপক্ষের রাজনীতিকদের কুরুচিকর ভাষায় আক্রমণ। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নাগরিকত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। তাঁর বক্তব্য যতই অযৌক্তিক বা অদ্ভুত হোক না কেন, সেই বক্তব্যকে স্বাভাবিক বলে প্রচার করা হয়েছিল। এমনকী এসব বক্তব্যের ‘সত্যতা’র প্রশংসাও করা হয়েছিল। ট্রাম্প কনজারভেটিভ প্রচারমাধ্যমে প্রায় সীমাহীন সম্প্রচারের সময় পেয়েছিলেন। শুধু কনজারভেটিভ মিডিয়াই ট্রাম্পের দিকে জনসাধারণের দৃষ্টি স্থির রেখেছিল, তা নয়। ‘যদি হানাহানি হয়, তাহলে সেটিই প্রধান খবর’— নিউজ রিপোর্টিংয়ের এই মৌলিক নীতি অনুসরণ করে প্রথাগত মিডিয়াও ট্রাম্প ও তাঁর ‘মাগা’ আন্দোলনের জনপ্রিয়তা নিয়ে নিয়মিত খবর প্রকাশ করেছে। তৎকালীন সিবিএস টেলিভিশন চ্যানেলের চেয়ারম্যান লেস মুনভেস ২০১৬ সালে বলেছিলেন, ট্রাম্পের রাজনৈতিক কেরিয়ার ‘আমেরিকার জন্য ভালো নয়’, কিন্তু তাঁকে এয়ারটাইম দেওয়া ‘মিডিয়া কোম্পানির জন্য খুব লাভজনক’। ট্রাম্পের পক্ষে এইসব মিডিয়ার টানা প্রচার গেঁথে গিয়েছে অর্ধেক আমেরিকানদের মগজে। আর ডেমোক্র্যাটিক পার্টিও ভোটারদের থেকে দূরে সরে গিয়েছে। এমনকী বাম-ঘেঁষা শ্রমজীবী, দরিদ্র, অশ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যেও পরিষ্কার ভাঙন ধরেছে।
প্রবীণ হোয়াইট হাউস পর্যবেক্ষক পিটার বেকার লিখেছেন, ট্রাম্পের ভাষণগুলি দিন দিন আরও অশালীন হয়ে উঠছে। ‘ট্রাম্প শুধু ২০২৪ সালেই চার অক্ষরের অশ্লীল শব্দ জনসমক্ষে উচ্চারণ করেছেন অন্তত ১ হাজার ৭৮৭ বার।’ তাঁর বিশ্লেষণ অনুসারে, ট্রাম্প ২০১৬ সালের চেয়ে ৬৯ শতাংশ বেশি এই ভাষা ব্যবহার করছেন। তিনি কমলা হ্যারিসকে ‘নোংরা ভাইস প্রেসিডেন্ট’ বলতেও ছাড়েননি। এই বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, তিনি যা যা বলেছেন, তার অর্থ কী, তা তিনি ভালোভাবেই জানেন। আসলে ট্রাম্প জেনে গিয়েছেন, আমেরিকান সমাজ কোন ভাষায় কথা বোঝে!
দ্বিতীয় যাত্রার ট্রাম্পের প্রশাসনের জন্য একটি দীর্ঘ ও বিস্তারিত ‘প্লে বুক’ বা নীলনকশা তৈরি করেছে রক্ষণশীল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন। এর নাম ‘প্রজেক্ট ২০২৫’। যার মূল কথা, ট্রাম্প কড়া শুল্ক চাপিয়ে আমদানি-রফতানির বারোটা বাজাবেন, বিদেশিদের দেশছাড়া করবেন, আমেরিকাকে করে তুলবেন অন্তর্মুখী। ট্রাম্প মনে করেন, পরিবেশের ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার তত্ত্ব একটা ভাঁওতা। ট্রাম্প চান, আমেরিকা জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির ভেক ছেড়ে ফিরে যাক উৎপাদন নির্ভর অর্থনীতিতে। সেখানে ডিগ্রিধারীদের সিলিকন ভ্যালি নয়, মধ্য পশ্চিমের ধসে-পড়া শিল্পাঞ্চল আবার রমরম করে উঠুক। একসময় পেনসিলভেনিয়া, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের আপস্টেট নিউ ইয়র্ক অঞ্চল, ওহায়ো, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ইন্ডিয়ানা, মিশিগান অঞ্চলগুলির চালিকাশক্তি ছিল ইস্পাত আর গাড়ি তৈরির শিল্প। সেই জন্যই এই প্রদেশগুলির নামকরণ হয়েছিল ইস্পাত-বেল্ট। গত শতকের আশির দশকের গোড়ায় অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে আমেরিকার ইস্পাত শিল্প বড় ধাক্কা খায়। অনেক ইস্পাত সংস্থা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। ইস্পাতের এই পতন মূলত জাপান থেকে সস্তায় ইস্পাত আমদানির কারণে। জাপানে শ্রমের খরচ আমেরিকা থেকে কম। ইস্পাত-বেল্ট হয়ে ওঠে মরচে-বেল্ট। প্রচুর মানুষ চাকরি হারান। যাঁরা কর্মচ্যুত হন, তাঁরা মূলত শ্রমিক শ্রেণি। নব্বইয়ের দশকে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের হাত ধরে আমেরিকা ফের ঘুরে দাঁড়ালেও অবস্থা বদলায়নি ইস্পাত-বেল্টের মানুষের। অধিকাংশ মানুষ তাঁদের কর্মহীনতার জন্য অভিবাসীদের দোষ দেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প এই মানুষদের কাছেই ‘গড’। বিদেশিদের শায়েস্তা করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে— এমন আকাশকুসুম ধারণা ট্রাম্প সমর্থকদের মনে বদ্ধমূল। একইসঙ্গে ট্রাম্পের সমর্থনের পিছনে রয়েছে অশিক্ষা, বর্ণবিদ্বেষ, জাত্যভিমান, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবও।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, ক্ষমতায় এসে তিনি প্রথম শিক্ষা দপ্তর বাতিল করবেন। আমেরিকার দক্ষিণপন্থী ও খ্রিস্টবাদীরা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন, এ দেশে ক্লাসরুমে যা শিক্ষা দেওয়া হয় বা যা পড়ানো হয়, তা দেশের মূল্যবোধবিরোধী। আসলে তারা মূল্যবোধ বলতে খ্রিস্টধর্মের কথাই বুঝিয়ে থাকে। এদের চাপের মুখে হাজার হাজার বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, পাবলিক লাইব্রেরি থেকে সেসব বই ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে আসা মানে এই খ্রিস্টবাদীদের পোয়াবারো।
ভাবুন একবার, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলকে ‘ভুয়ো’ বলে দাবি করেছিলেন ট্রাম্প। একের পর এক মামলাও ঠুকেছিলেন। ট্রাম্পের এই অনমনীয় মনোভাবের পরেই ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে অবস্থিত আমেরিকার আইনসভায় হামলা চালান হাজার হাজার উগ্র ট্রাম্প সমর্থক। তার জন্য কোনও অনুশোচনা নয়, উল্টে ভোটপ্রচারে বলেছেন, ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হারলেও তাঁর সেদিন হাউস ছাড়া উচিত হয়নি! এহেন ট্রাম্পই ফের মার্কিন মসনদে। এই দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি গণতন্ত্রের বুলি আওড়ানো দেশের নাগরিকরাই তাঁকে ফিরিয়ে এনেছেন রাজার বেশে!
বিখ্যাত ঐতিহাসিক টিমোথি স্নাইডার মনে করিয়ে দিয়েছেন, একধাক্কায় গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় না। এর জন্য প্রয়োজন হাজারো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঘাত ও রক্তক্ষরণ। ভয়ের কথা, ট্রাম্প জমানার আরও চার বছরে এই প্রতিটি আঘাত আরও গভীর হবে।