ব্যবসায়িক কাজকর্ম ভালো হবে। ব্যবসার প্রসারযোগও বিদ্যমান। উচ্চশিক্ষায় সন্তানের বিদেশ গমনের সুযোগ আসতে পারে। গৃহশান্তি ... বিশদ
১২ হাজার কিলোমিটার দূরে এই দুনিয়ার আধুনিকতম প্রাচুর্যে ভরা দেশের মাটিতে রক্ষণশীলতাকে ঢাল করে ভোটে জিতে আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসা মোটেও কম কথা নয়। ট্রাম্প সাহেব সেটাই করে দেখিয়েছেন। একজনের স্লোগান ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’। সঙ্গে ধর্মীয় বিভাজন এবং বিরোধী কংগ্রেসের ইতিহাসকে মুছে দেওয়ার সাতশো ফিকির। উল্টোপিঠে ট্রাম্পের হাতিয়ার, ‘মেক অ্যামেরিকা গ্রেট এগেন’। যুদ্ধ নিয়ে গত চার বছর ডেমোক্র্যাটদের সিদ্ধান্তহীনতায় এমনিতেই মার্কিন নাগরিকরা বাইডেন প্রশাসনের উপর ক্ষুব্ধ ছিল। নির্বাচনে সেই ক্ষোভেরই বিস্ফোরণ হল কৃষ্ণাঙ্গ নারী কমলার বিরুদ্ধে। আর্ন্তজাতিক মঞ্চে হোয়াইট হাউসের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ফেরানোর তুরুপের তাসেই আমেরিকার রং আজ লাল। ভেবে দেখুন, এক দশক আগে মনমোহন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রেও বিজেপি’র তুরুপের তাস ছিল ‘দুর্বল প্রধানমন্ত্রী’ আর নয়। ‘হাউডি মোদি’ এবং ‘নমস্তে ট্রাম্প’ মিলে মিশে একাকার! গেরুয়া মোদিজির মতোই জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে অগ্রসর হন রিপাবলিকান নেতাও। প্রতিশ্রুতি দেন, অভিবাসন নীতিকে আরও কঠোর করে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের বহিষ্কারের। সেই একরোখা ঝাঁঝালো মনোভাবে তিনি হিটলারের আদর্শেই যেন অনুপ্রাণিত। দোসর রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি। আরও কঠোর শুল্ক নীতির হাতছানি। শুধুই কষ্টকল্পিত স্বপ্ন ফেরি করে লোকজনকে বুঁদ করে দেওয়ার মহতী আয়োজন। গড়পড়তা নাগরিকদের মন জিততে বারংবার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ হুঙ্কার। যদিও বাজারি রাজনীতিতে এসবই শেষ পর্যন্ত কথার কথা হয়েই থেকে যায়, বাস্তবায়িত হয় না মোটেই। বছরে দু’কোটি লোকের চাকরি যেমন এই ভারতে শতাব্দীর সেরা ধাপ্পা, তেমনই অভিবাসন নীতি, মেক্সিকানদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাও স্রেফ ভোটে জেতার টোপ। নির্বাচন আসে যায়। রাজ্যপাট চলে আপন পাগলপারা গতিতে। কী দিল্লি, কী ওয়াশিংটন ভোটের বাজারে দেওয়া কথা বড় একটা কেউ রাখেন না! সবাই অপেক্ষা করে পরবর্তী বিমান আক্রমণের জন্য, এটাই শিক্ষিত দুনিয়ার দস্তুর!
ভারতের মতো গরিব দেশের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু সমীহ জাগানো শিক্ষিত ধনী প্রগতিশীল আমেরিকা! এত বছরেও সেখানে একজন মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন না? এই নির্বাচনেও পুরোদস্তুর লিঙ্গ বৈষম্য (‘জেন্ডার বায়াস’) ট্রাম্পের পক্ষে গিয়েছে। ডোনাল্ড তিনবার লড়াই করেছেন। ২০১৬, ২০২০ ও ২০২৪। দু’-দু’বার দুই ডেমোক্র্যাট মহিলা হিলারি ক্লিন্টন ও কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে তিনি বড় ব্যবধানে জয়ী। হেরেছেন শুধু একবারই, চার বছর আগে। সেবার প্রতিপক্ষ কোনও মহিলা ছিলেন না, সুপুরুষ ডেমোক্র্যাট জো বাইডেন। আবারও প্রমাণ হল এতটা এগিয়েও একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাকে সর্বোচ্চ পদে মেনে নেওয়ার মতো উদার হতে পারেনি মার্কিন সমাজ। প্রযুক্তি দাপট বাড়িয়েছে, গণতন্ত্র ও পুঁজির দাপটে উন্নতির একের পর এক মাইলস্টোন চোখ ধাঁধিয়েছে। কিন্তু প্রদীপের তলার নিকষ অন্ধকারের মতোই রক্ষণশীলতার নাগপাশে আজও আগাগোড়া বন্দি তথাকথিত ঝাঁ চকচকে মার্কিন মুলুক। নারীর সমান অধিকার সেখানেও শুধু কথার কথা।
সত্যিমিথ্যে জানি না! নিন্দুকেরা বলে, ভারতে তিনি স্বমহিমায় আছেন বলেই নাকি বিশেষ কয়েকজন বাছাই করা শিল্পপতির রমরমা। সেই সুবাদেই দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ মাত্র কয়েকজনের কব্জায়। ১৪২ কোটির জনসংখ্যার ভারতের আনাচে-কানাচে সেই গুঞ্জন। আদানি, আম্বানিদের রমরমা নিয়ে তোপ দাগেন স্বয়ং বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী। হরেক কিসিমের অনিয়মের অভিযোগ সামনে আনেন। তাতে উত্তাল হয় সংসদ পর্যন্ত। আর সদ্য সমাপ্ত মার্কিন নির্বাচনেও বিপুল জয়ের নজির সৃষ্টি করে জয়ী রিপাবলিকান প্রার্থী তাঁর গাঢ় লাল রঙের আভায় ভেসে ধন্যবাদ জানান মার্কিন ধনকুবের শিল্পপতি এলন মাস্ককে। যিনি এই সেদিনও নিজমুখে বলতেন, তিনি অর্ধেক ডেমোক্র্যাট, অর্ধেক রিপাবলিকান। তিনিই নাকি হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের অন্যতম প্রধান কাণ্ডারী। এর আগের নির্বাচনে তিনি বাইডেনের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু প্রচারে ডোনাল্ডের উপর প্রাণঘাতী হামলার পর থেকেই সকাল-সন্ধ্যা ট্রাম্প শিবিরে। মার্কিন মিডিয়ায় কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, রিপাবলিকানদের প্রচারে তিনি নাকি দৈনিক ১ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন। তা এহেন বন্ধুর নাম জয়ী প্রেসিডেন্ট নেবেন, জয়ের খবর চাউর হতেই মাস্কের চার বছরের ছেলেকে পর্যন্ত হবু প্রেসিডেন্টের পাশে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দেখা যাবে, তাতে আর আশ্চর্য কী?
লোকে বলে, ধর্মে ও জিরাফে থাকা এমন রঙিন প্রেসিডেন্ট আমেরিকা বিশেষ দেখেনি। দেশের ৪৭তম রাষ্ট্রপ্রধান ৩০টির বেশি অপরাধে অভিযুক্ত, আছে যৌন হেনস্তার মারাত্মক সব মামলাও। এক নয়, একাধিক। তবু মিন মিন করে নয়, অভিবাসী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি কড়া ভাষায় আক্রমণ এবং যুদ্ধ নিয়ে স্পষ্ট নীতির জন্যই মার্কিন সমাজ কালো চামড়ার মহিলাকে ছেড়ে তাঁকে বেছে নিয়েছে। বিশেষ করে ইজরায়েল ও ইউক্রেন প্রশ্নে কড়া ভূমিকার আভাস রিপাবলিকান জয়কে সহজ করেছে। প্রথম অভিনন্দন এসেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ইজরায়েলের রাষ্ট্রপ্রধান নেতানিয়াহু এবং সৌদি আরবের মহম্মদ বিন সলমনের থেকে। আর সব শেষ শুভেচ্ছাটা এসেছে পুতিনের অফিস থেকে, ৪৮ ঘণ্টারও পর। জেলেনস্কি কি প্রমাদ গুনছেন? কারণ অস্ত্র সরবরাহের প্রতিশ্রুতির সঙ্গেই ট্রাম্পের তোপ, পুতিনের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসতে হবে ইউক্রেনকে।
আর নয়াদিল্লি? ফল বেরতেই নরেন্দ্র মোদি যেন ফিরে পেয়েছেন টেক্সাসের সেই উনিশ সালের ফেলে আসা রাত। কেন? কারণ আমেরিকা ও ভারত, দু’দেশেরই এই মুহূর্তে প্রধান প্রতিপক্ষ চীন। অস্ত্র, প্রযুক্তি ও অর্থনীতির দৌড়ে বেজিং আজ আমেরিকাকে ব্যাকফুটে ফেলছে। ভারতের চারপাশেও ক্ষমতার নতুন অক্ষরেখা তৈরির চেষ্টা চলছে। তাই হোয়াইট হাউসের আজ ভারতকে এতটা প্রয়োজন। আর নয়াদিল্লি সম্প্রতি ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ থেকে চীনা ফৌজ প্রত্যাহার নিয়ে যে চুক্তি করেছে তা লঙ্ঘিত হলে পেন্টাগনকে পাশে পাওয়ার আশা করছে। ভারতকে খুশি করতে ইতিমধ্যেই দিল্লির কূটনৈতিক শত্রু কানাডার জাস্টিন ট্রুডো সরকারকেও তোপ দাগা শুরু হয়েছে ট্রাম্প শিবির থেকে। ‘আপনার দিন শেষ, আর ক্ষমতায় ফিরতে পারবেন না’ বলে হুঙ্কার দিয়েছেন এলন মাস্ক। কিন্তু ট্রাম্পের এই প্রত্যাবর্তন সত্যিই কি ভারতকে সবক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দেবে? আগেরবার নয়াদিল্লির তীব্র আপত্তিতেই পাকিস্তানকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য স্থগিত করে দিয়েছিল ওয়াশিংটন। জয়েশ প্রধান পাকিস্তানি জঙ্গি মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক জঙ্গিও ঘোষণা করা হয়েছিল ইসলামাবাদ ও তার মেন্টর চীনের অস্বস্তি বাড়িয়ে। এবারও ট্রাম্পের এই প্রত্যাবর্তন দিল্লি-আমেরিকার অস্ত্র সমঝোতা ও বাণিজ্যিক আদান-প্রদান বাড়াতে সাহায্য করবে বলেই একটি মহলের আশা। চীনের দৌরাত্ম্যও কিছুটা কমবে। তবে শুল্ক বিধি কঠোর হলে আদৌ বাণিজ্যিক অগ্রগতি কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সংশয় থাকছেই। তবে সব ছাপিয়ে ভারতের কৌশলগত চাহিদা নিঃসন্দেহে প্রতিবেশী বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। মার্কিন মুলুকের ফল বেরতেই ক্রমশ অস্বস্তি বাড়ছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ইউনুসের। জামাতের বাড়বাড়ন্ত ছেঁটে অতঃপর আওয়ামি লিগ নেত্রীর অভিশাপের প্রহর কি কাটবে? তার উত্তর আপাতত ভবিষ্যতের গর্ভে।
সংশয়ের কারণ ট্রাম্প মানুষটা আগাগোড়া বিতর্কিত এবং অপ্রত্যাশিত। রুড, আনপ্রেডিক্টেবল! সাত ও আটের দশকে তিনি গুরু হিসেবে কাছে পেয়েছিলেন কুখ্যাত আইনজীবী রয় কোনকে। যিনি রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ট্রাম্পের জীবনচক্রকে সীমাহীন ক্ষমতা, প্রচার এবং মোকদ্দমার কঠিন পথে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ক্যাসিনোর চাকা আজও ট্রাম্পের জীবন ভাবনাকে পরিচালিত করে। ট্রাম্প তাঁর ‘গুরু’র কাছেই শিখেছিলেন প্রতারণা-চাতুর্য, দাম্ভিক আচরণ, উদ্ধত অহংকার এবং হার না মেনে যেকোনও মূল্যে জয় হাসিলের ঠিকানা খুঁজে বের করার জটিল পাটিগণিত ও রসায়ন। আজ আমাদের চোখে ধরা পড়া ট্রাম্পের নাছোড়বান্দা আগ্রাসী চেহারাও সেই শিক্ষারই ফসল।
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন সবশেষে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে বলেছেন, ট্রাম্প অনেক কথা বলছেন। দেখতে হবে তার কতটা বাস্তবায়িত হয় পৃথিবীর মাটিতে। একই কথা প্রযোজ্য ভারতের জন্যও। মুখে ঝুলে থাকা মৃদু হাসির আড়ালে ট্রাম্প কিন্তু পাক্কা ব্যবসায়ী।
তবে সব শেষে একটা কথা বলতেই হবে, পৃথিবী যত আধুনিক হচ্ছে পাল্লা দিয়ে সবক্ষেত্রেই চরমপন্থীদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। শিক্ষা, সৌজন্য, ধীরে ধীরে বিনয়ের সঙ্গে চিরাচরিত ঢঙে কথা বলা আজ দুনিয়াজুড়ে হেরোদের বিজ্ঞাপন! জয়ীরা আছেন সোচ্চারে, উল্লাসে, অহঙ্কারে এবং বিতর্কের উস্কানিতে। খতমের নেশায়। একেই কি বলে উন্নয়নের সাইড এফেক্ট?