ব্যবসায়িক কাজকর্ম ভালো হবে। ব্যবসার প্রসারযোগও বিদ্যমান। উচ্চশিক্ষায় সন্তানের বিদেশ গমনের সুযোগ আসতে পারে। গৃহশান্তি ... বিশদ
২০১৬ সালে যখন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল শুভেচ্ছা জানাতে হোয়াইট হাউসে গিয়েছিল, তখন নাকি ইউনুসের নাম না নিয়েই ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘ঢাকার মাইক্রোফাইন্যান্সের সেই ব্যক্তি কোথায়? শুনেছি, তিনি আমাকে হারাতে চাঁদাও দিয়েছিলেন।’ সেবার ট্রাম্প হারিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটনকে। যে ক্লিনটন পরিবারের সঙ্গে ইউনুসের ঘনিষ্ঠতা সর্বজনবিদিত। সম্প্রতি বাংলাদেশের মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে মার্কিন সফরে গিয়েও বিল ক্লিনটনের ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন ইউনুস। শুধু ক্লিনটন পরিবারই নয়, ইউনুসের সঙ্গে ডেমোক্র্যাট নেতাদের সম্পর্ক বরাবরই বেশ ভালো। প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০০৯ সালে তাঁকে আমেরিকার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান দিয়েছিলেন। সম্প্রতি রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে তাঁর উচ্ছ্বসিত ছবিতেও সেই প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম যাই দাবি করুন না কেন, অতীত বলছে, এই মহম্মদ ইউনুসই ট্রাম্প সম্পর্কে বলেছিলেন, তাঁদের দু’জনের রাজনৈতিক মতাদর্শ একেবারে আলাদা। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হয়েই, আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্ত উঁচু পাঁচিলে ঘিরতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প। সেই বিষয়ে এক মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে ইউনুস বলেছিলেন, ‘দেওয়াল’ তৈরি না করে ট্রাম্পের উচিত উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ‘সেতু’ নির্মাণ করা। এহেন ট্রাম্পের জয়ে ইউনুসের মাথাব্যথার যথেষ্ট কারণও রয়েছে।
সম্প্রতি দেওয়ালি উপলক্ষে নিজের সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশ নিয়ে সরব হয়েছিলেন। সেখানে হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিয়ে কমলা-বাইডেনকে তোপ দেগেছিলেন ট্রাম্প। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ ট্রাম্প লিখেছিলেন, ‘অশান্ত বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত হচ্ছেন। সেখানে লুঠপাট চলছে। আমি এর তীব্র ভাষায় নিন্দা জানাচ্ছি। আমি ক্ষমতায় থাকলে, এমন কখনও হতো না। কমলা হ্যারিস ও জো বাইডেন আমেরিকায় এবং বিশ্বজুড়ে হিন্দুদের গুরুত্ব দেননি। ...আমরা আপনাদের স্বাধীনতার জন্য লড়ব। আমার প্রশাসনের অধীনে ভারত ও আমার ভালো বন্ধু নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও সুসম্পর্ক আরও মজবুত করব।’ এর অর্থ নিশ্চিত বুঝতে অসুবিধে হয়নি বাংলাদেশের কেয়ারটেকার সরকারের। গত আগস্ট মাসে, হাসিনার বিদায়ের পরই, জো বাইডেনকে ফোন করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। সেই উদ্বেগকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি বাইডেন প্রশাসন। সেদিন ট্রাম্পের মতো কোনও জোরালো বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি বাইডেনকে। ট্রাম্পের টুইট থেকে স্পষ্ট, তাঁর প্রশাসন অন্তত বাইডেনের সময়ের মতো চোখ বন্ধ করে থাকবে না। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন কংগ্রেসম্যান রাজা কৃষ্ণমূর্তিও ইতিমধ্যে বাংলাদেশি হিন্দুদের সুরক্ষার জন্য মার্কিন প্রশাসনের কাজে আর্জি জানিয়েছেন। ট্রাম্প যাতে এ বিষয়ে কড়া হস্তক্ষেপ করেন সে জন্যও প্রতিনিয়ত উদ্যোগ নিচ্ছেন।
শুধু তাই-ই নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন স্বয়ং শেখ হাসিনা। প্রথমে চিঠি পাঠিয়ে সদ্যনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তারপর সরাসরি ফোনে কথা বলেছেন শেখ হাসিনা! আর দু’ক্ষেত্রেই নিজেকে ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী’ বলেছেন হাসিনা। ট্রাম্পের সঙ্গে হাসিনার কথোপকথনের কথা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় মধ্যরাতেই তড়িঘড়ি করে ইউনুসের কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এরপরই দেশে আওয়ামি লিগের সভা-সমাবেশ নিয়ে এই কড়া পদক্ষেপের কথা জানান ইউনুসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম। ততক্ষণে বাংলাদেশের প্রতিটি অলি-গলি এবং আম জনতার মধ্যেও জল্পনা, ট্রাম্পের হাত ধরেই হয়তো ফের মসনদে ফিরতে পারেন শেখ হাসিনা। অন্তত সেই স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে আওয়ামি লিগও। আর সেই স্বপ্ন ভাঙতেই তৎপর ইউনুস প্রশাসন। গদিচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে ফেরাতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড কর্নার নোটিস জারি করার পরিকল্পনা করেছে ইউনুস প্রশাসন। শুধু তাই নয়, আওয়ামি লিগের সমস্ত পলাতক নেতাদের বিরুদ্ধেই এই নোটিস জারি করা হবে। একথা জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। অথচ, অক্টোবরের শেষের দিকে আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ‘ফিনানশিয়াল টাইমস্’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও ইউনুস তাঁর অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান জানিয়ে বলেছিলেন, এখনই হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরানোর কোনও ভাবনা নেই তাঁদের। তাহলে হঠাৎ সেই অবস্থানের পরিবর্তন কেন? এর পিছনে কী এক এবং একমাত্র কারণ ট্রাম্পের জয়? যা নিয়ে চিন্তার ভাঁজ মহম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারের কপালে।
তাহলে কি বড় কোনও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে চলেছে মহম্মদ ইউনুস প্রশাসন এবং বাংলাদেশ? বাংলাদেশের কিছু বিশ্লেষক বলার চেষ্টা করছেন, ট্রাম্প নির্বাচনের ঠিক ছ’দিন আগে যে কথাগুলি বলেছিলেন, সেটা আমেরিকার প্রায় ২৬ লক্ষ হিন্দু ভোটারকে আকৃষ্ট করার কৌশল মাত্র। আবার অনেকে বলছেন, ট্রাম্পের এই বক্তব্যটি আমেরিকার হিন্দু ফেডারেশনের তৈরি খসড়া। তারাই এই বিষয়ে ট্রাম্পকে দিয়ে বলিয়েছে। আগামী নির্বাচনে তাঁকে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে। এই প্রবাসী বাংলাদেশিরা ডোমোক্র্যাট দল পাল্টে ট্রাম্পকে সমর্থন জানানো প্রাক্তন কংগ্রেসওম্যান তুলসি গ্যাবার্ডের নামও বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছেন। যিনি ডানপন্থী কট্টর হিন্দুবাদী হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ নিয়ে এখন এহসান জুয়েলদের মতো যে প্রবাসী সাংবাদিকরা উদ্বিগ্ন, তাঁদের অনেকেই মনে করেন, কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামি লিগের ঘনিষ্ঠতা ঐতিহাসিক। তাই মোদি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিবিদদের মধ্যে উল্লাস দেখা গিয়েছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন শেখ হাসিনার সঙ্গে মোদির বোধ হয় খুব একটা জমবে না। কিন্তু আওয়ামি লিগের ব্যাপারে ভারতের বিদেশনীতি একচুলও নড়েনি। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে কংগ্রেসের চেয়ে মোদি সরকার শেখ হাসিনার জন্য আরও বেশি ভূমিকা রেখেছেন এবং রাজনীতিতে ঐকমত্যের ভিত্তিতেই ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। ভারতকে চটিয়ে বাংলাদেশে অনেক কিছু করতে চাইলেও করতে পারে না আমেরিকা। আবার বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত কঠোর অবস্থান নিতে চাইলেও সেটা আটকে আছে আমেরিকার মনোভাবের কারণে। সেখানে পরিবর্তন আসতে পারে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায়।
দেশ পুনর্গঠনের জন্য, আমেরিকার কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার। পালা বদলের পর ঢাকায় এসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও উন্নয়নে সহায়তার পাশাপাশি, অতিরিক্ত ২০ কোটি ২০ লক্ষ মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাইডেনের প্রশাসনের প্রতিনিধিদল। কিন্তু ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ায় তিনি দু’দেশের সম্পর্কের বর্তমান কাঠামোকে সমর্থন করবেন বলে মনে করেন না আমেরিকার ইউলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ, মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি জানিয়েছেন, ট্রাম্প মনে করেন আমেরিকার এই মানবিক সহযোগিতা আসলে অর্থ অপচয়। গোটা বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়েও তাঁর প্রশাসন সম্ভবত খুব একটা আগ্রহী হবে না। রোহিঙ্গাদের জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের যে সাহায্য পায় বাংলাদেশ, তারও সিংহভাগ দেয় আমেরিকাই। ট্রাম্প সেই অর্থেও কাট-ছাঁট করতে পারেন। ফলে ট্রাম্পের বাংলাদেশ নীতি নিয়েও আশঙ্কা ও উদ্বেগের আবহ ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে। ঢাকার আশঙ্কা একটাই, নরেন্দ্র মোদি ৩.০ ও ডোনাল্ড ট্রাম্প ২.০ যখন সমান্তরালে চলবে, তখন আমেরিকা-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে ভারত
ঢুকে পড়তেই পারে। সেই ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে ইউনুস সরকারের সম্পর্ক স্বাভাবিক না হলে, বিপদে পড়বে বাংলাদেশই। এক কথায় বাংলাদেশের পক্ষে আর ভারতকে অবজ্ঞা করা সম্ভব নয়। উল্টে বাংলাদেশের ভারত নির্ভরতা আরও বাড়বে। ফলে ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখছে ঢাকা!
দিল্লির পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি বা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি (পাকিস্তান ছাড়া) নিয়ে ট্রাম্প আগেও বিশেষ মাথা ঘামাননি, এবারেও তার ব্যতিক্রম হবে না। ট্রাম্পের অতীত ট্র্যাক রেকর্ড অন্তত তাই-ই বলছে! ভারতের কূটনীতিবিদদের মতে, ‘যতই বলা হোক আমেরিকায় ক্ষমতার পালাবদল হলেও সে দেশের বিদেশনীতির ক্ষেত্রে একটা ধারাবাহিকতা ও ‘বাইপার্টিজান’ ঐকমত্য থাকে, আমরা সবাই জানি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে সে কথাটা সত্যি নয়।’
ফলে বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশ নিয়ে যে
পরিমাণ ‘আগ্রহ’ ও ‘গরজ’ দেখিয়েছে, ট্রাম্প জমানায় তার ছিটেফোঁটাও দেখা যাবে না। এর কারণটাও সহজ— ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে এরকম ‘হস্তক্ষেপে’র পিছনে অর্থ ঢালাকে অপচয় বলেই ধরা হয়!
সাংবাদিক ভিকি নানজাপ্পা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিনই (৫ নভেম্বর) আরএসএসের মুখপাত্র ‘দ্য অর্গানাইজারে’ একটি নিবন্ধ লেখেন। যাতে স্পষ্ট পূর্বাভাস ছিল, হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিরে আসা মানে বাংলাদেশের ইউনুস সরকারের জন্য সব দিক থেকেই অত্যন্ত দুরূহ পরিস্থিতির জন্ম দেবে। তাঁর ভাষায়, সেটা হবে ‘আ ডেভিল অ্যান্ড দ্য ডিপ সি!’ ভিকি লিখেছেন, বাংলাদেশকে হয়তো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়তে হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, ট্রাম্প জমানায় বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহাল তবিয়তে নিজের দেশে ফিরেও যেতে পারেন। এর কোনও কিছুই বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অজানা নয়।
তবে, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরে আওয়ামি লিগের হাল ধরতে হলে, খুব জটিল ‘জিগস পাজলে’র অনেক টুকরোকে খাপে খাপে মিলতে হবে।
ট্রাম্পের জয় হয়তো এই পাজলের বড়জোর একটা কোনাকে মেলাতে পারে। কিন্তু পুরো হেঁয়ালির সমাধান এখনও দূর-অস্ত।
আসলে সবটাই নির্ভর করছে ট্রাম্প-মোদির সম্পর্কের রসায়নে!