ব্যবসায়িক কাজকর্ম ভালো হবে। ব্যবসার প্রসারযোগও বিদ্যমান। উচ্চশিক্ষায় সন্তানের বিদেশ গমনের সুযোগ আসতে পারে। গৃহশান্তি ... বিশদ
ম্যাচ দেখে চরম বিরক্ত হয়েছিলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নাকি ঘন ঘন হাই তুলেছিলেন। তাঁর অফিসারদের ডেকে ‘ফুয়েরার’ সাফ বলে দিয়েছিলেন, জার্মানির মতো আর্য দেশে ক্রিকেটের মতো অনার্য ও ‘অজার্মান’ খেলা যেন আর না হয়। সেই থেকে নাকি জার্মানিতে আর ক্রিকেট জনপ্রিয়তা পায়নি। যদিও এই গল্প কতটা সত্যি, তা আজও জানা যায়নি।
তবে ব্রিটিশ লেখক জন সিম্পশনের ‘আনরিলায়েবল সোর্স: হাউ দ্য টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ওয়াজ রিপোর্টেড’ (২০১০) বইটি এক ভিন্ন স্বাদের তথ্য দিয়েছে। সিম্পশনের বইটি মূলত বিশ শতকের সাংবাদিকতার উপর লেখা। এখানে তিনি ১৯৩০ সালে ডেইলি মিরর–এ প্রকাশিত তৎকালীন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য অলিভার লকার-ল্যাম্পসনের একটি লেখাকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ওলিভার লকার-ল্যাম্পসন ছিলেন ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর অফিসার। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের রক্ষণশীল দলের রাজনীতিবিদ। ১৯১০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রভাবশালী সাংসদ ছিলেন। ইউরোপে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর অবস্থানের কারণে তিনি হিটলারের নজরে আসেন। হিটলারও বলশেভিকবিরোধী হওয়ায় লেম্পসন তাঁর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তবে এই মধুচন্দ্রিমা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। হিটলারের বিভিন্ন ফ্যাসিস্ট সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে ইহুদিবিরোধী অবস্থানের কারণে লেম্পসন একসময় হিটলারের পাশ থেকে সরে দাঁড়ান। লেম্পসন যখন হিটলারের অনুরাগী ছিলেন, তখন হিটলারকে নিয়ে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯৩০-র ৩০ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের দ্য ডেইলি মিরর পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়। লেখাটির শিরোনাম ছিল, ‘অ্যাডলফ হিটলার অ্যাজ আই নো হিম।’
লেম্পসন সেই লেখায় উল্লেখ করেন, দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ জার্মানিতে তিনি কয়েকজন ব্রিটিশ সেনা অফিসারের দেখা পান। ততদিনে হিটলার জার্মানের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই সেনা অফিসারদের সঙ্গে আলোচনায় হিটলারের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। ওই সেনা অফিসারদের মধ্যে কয়েকজন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন চিকিৎসার জন্য জার্মানির এক সামরিক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। হিটলারও সেই সময় যুদ্ধাহত অবস্থায় সেই হাসপাতালে ভর্তি। ব্রিটিশ অফিসাররা মাঝেমধ্যেই হাসপাতাল চত্বরে নিজেদের মধ্যে ক্রিকেট খেলতেন। নজর এড়ায়নি হিটলারের। আচমকা একদিন যুদ্ধবন্দি ব্রিটিশ অফিসারদের কাছে এসে ক্রিকেট খেলার প্রস্তাব রাখেন। তবে ক্রিকেট খেলার নিয়মকানুন শিখিয়ে দিতে হবে তাঁদেরই। সেই মতো প্রস্তুতি নেবে টিম হিটলার। এমন প্রস্তাব শুনে ব্রিটিশ সেনা অফিসাররা কিছুটা আশ্চর্য হলেও তাঁকে স্বাগত জানান।
এরপর বেশ কিছুদিন হিটলার বেপাত্তা। হঠাৎ একদিন উদয় হয়ে তিনি ব্রিটিশ অফিসারদের জানান, তাঁর টিম খেলার জন্য প্রস্তুত। যথাসময়ে খেলা হল। তবে ম্যাচটা কবে, কোথায় হয়েছিল, ফলাফল কী হয়েছিল, হিটলারের ব্যাটিং অর্ডার কী ছিল, তিনি কত রান করেছিলেন— এসব তথ্য কালের গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে। অধিকাংশ মানুষের ধারণা, হিটলার অভিজ্ঞ ইংরেজদের কাছে এই খেলায় পরাজিত হয়েছিলেন। শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন নিজে। কিন্তু হিটলার হঠাৎ ক্রিকেট খেলতে উৎসাহী হয়েছিলেন কেন? ওলিভার লকার-লেম্পসনের ধারণা, আসলে ক্রিকেট খেলাকে জার্মান সেনাদের প্রশিক্ষণের কাজে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা ভাবছিলেন হিটলার। কীভাবে এই জনপ্রিয় খেলাকে নিজের কাজে লাগানো যায়, এজন্য ক্রিকেট নিয়ে গবেষণাও চালিয়েছেন। কিন্তু সেই ম্যাচ খেলার পর ক্রিকেট হিটলারকে আর আকর্ষণ করেনি। তাঁর উপলব্ধি, বিনোদনপ্রিয় ব্রিটিশদের জন্য ক্রিকেটর ‘বেসিক’ নিয়মকানুনসহ খেলাটি নিঃসন্দেহে খুব ভালো। কিন্তু ক্রিকেট ঠিক ‘পুরুষোচিত’ খেলা নয়। ক্রিকেট আমুদে ইংরেজদের জন্যই। সিরিয়াস মানসিকতার জার্মানদের জন্য বেমানান। নাৎসি বাহিনীর জন্য তো নয়ই!
লেম্পসন লেখেন, ক্রিকেটের প্রশান্ত মেজাজ ছাড়া এর আরও কিছু ত্রুটি হিটলারের নজরে আসে। হিটলারের মতে, ক্রিকেটের আদর্শ হওয়া উচিত ‘ক্রিকেট’ আর ‘ব্লিৎজক্রিগ’-এর সমন্বয়ে ‘ব্ল্যিজক্রিকেট’। ব্লিৎজক্রিগ-এর অর্থ নাৎসি দর্শন অনুযায়ী ‘তড়িৎগতির যুদ্ধ’। শত্রুপক্ষকে মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা দিতে জার্মানির সামরিক কৌশল। হিটলার জার্মানদের জন্য ক্রিকেট খেলার নিয়মকানুন বদলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অপুরুষোচিত, অজার্মান চিহ্নিত করে ‘প্যাড’ নামে ক্রিকেটের অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গটির ব্যবহার বন্ধ করতে চেয়েছিলেন! সাড়ে পাঁচ থেকে পৌনে ছয় আউন্স ওজনের এবং ২২.৩৮ সেমি থেকে ২২.৮৬ সেমি পরিধির ক্রিকেট বলটিকেও তিনি অজার্মানসুলভ ভাবতেন। তাই আরও একটু বড় আর আরও একটু শক্ত বল ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন! আর এমন হলে, খেলা শেষে ব্যাটসম্যানদের পায়ের ক’টি হাড় যে অবশিষ্ট থাকত, কে জানে! শুধু কি তা–ই, অত বড় ও ভারি বলের ভার বোলাররাই বা বইতেন কীভাবে, কে জানে! এই নাৎসিপ্রধান ক্রিকেটের জন্য একটি মোটো তৈরি করেছিলেন, জার্মান উচ্চারণে সেটি হল: ‘ওনে হাস্ট, ওনে রাস্ট’। বাংলায় যার ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায়: ‘তাড়াহুড়ো নেই, কিন্তু অবিরাম’। আরামসে খেলতে থাকো, খেলতেই থাকো। তিনি পাঁচদিন ধরে খেলা ও দফায় দফায় চা-বিরতি কিংবা লাঞ্চব্রেক বদলে দিতে চাইলেন। কিন্তু হিটলারের ধারণাগুলি তৎকালীন ক্রিকেট বিশ্বে কোনও প্রভাব ফেলেনি। চারশো বছর ধরে ইংরেজদের হাতে, তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠা ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তো ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফলে যা হওয়ার তাই হল, হিটলারের ফর্মুলা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা পরাজয় স্বীকার করে নিলে ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়। বিজয়ী ব্রিটিশরা যুদ্ধবিরতির পর বেশ কিছুদিনের জন্য জার্মানির বিভিন্ন জায়গায় ঘাঁটি গাড়ে। সময় কাটানোর জন্য ক্রিকেটপাগল ইংরেজরা প্রথম দিকে ছাউনি ও তার আশপাশে নিজেদের মধ্যে, আর পরবর্তীতে স্থানীয়দের সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচ খেলত। ফলে এই সময় হিটলারের উত্থানের পাশাপাশি জার্মানিতে ক্রিকেটেরও উত্থান লক্ষ করা যায়। তবে ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতার শীর্ষে আসার পর বিভিন্ন কারণে ক্রিকেটের দ্রুত পতন শুরু হয়।
হিটলারের ক্রিকেট দর্শনের এখানেই হয়তো সমাপ্তি টানা যেত, যদি না ক্রিকেট বোদ্ধা জর্জ অরওয়েল হিটলার ও তাঁর পারিষদের ভয়াবহ ক্রিকেট উদাসীনতা বা রূঢ় অর্থে বিরোধিতার ব্যাখ্যা না দিতেন। অরওয়েল লিখছেন, হিটলার ক্রিকেটের নিয়মকানুন শিখেছিলেন, খেলাটি অনুশীলন করেছিলেন, ম্যাচও খেলেছিলেন এবং শেষে রায় দিয়েছিলেন, খেলাটি যথেষ্ট পুরুষালি নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ব্রিটিশ বিদ্বেষ যত বাড়তে থাকে, ততই বাড়তে থাকে ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রতি অরুচিও। ক্রিকেট এর মধ্যে অন্যতম।
সমালোচকরা বলে থাকেন, ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ সেনা অফিসারদের সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচটিতে হিটলার মাত্র একটি বল খেলেছিলেন। শূন্য রানে স্টাম্পড হয়েছিলেন। তাছাড়া ১৯৩৭ সালে উস্টারশায়ার জেন্টলম্যান ক্লাব আর ১৯৩৮ সালে সমারসেট ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের কাছে সব ম্যাচেই বার্লিনের টিম হেরেছিল। ম্যাচগুলির রেজাল্ট হিটলারের মনঃপূত হওয়ার মতো ছিল না। ফলে প্রচলিত ক্রিকেটের প্রতি তাঁর হয়তো আরও কিছুটা বিতৃষ্ণা বাড়ে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, হিটলার ক্রিকেটে সফল হতে পারেননি। হিটলার বা বার্লিন জয়ী হলে ক্রিকেট বিশ্ব তো বটেই, বিশ্ব ইতিহাসেও এর প্রভাব পড়ত। ১৯৩৯ সালে হয়তো বিশ্বযুদ্ধের বদলে প্রথম বিশ্ব টেস্ট ক্রিকেট যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হতো। কিংবা হিটলারই হয়তো তার দর্শনের সঙ্গে সংগতি রেখে শর্টার ভার্সন বা শর্টেস্ট ভার্সন ক্রিকেটের জন্মদাতা হতেন। হয়তো লর্ডস থেকে ‘ক্রিকেটের মক্কা’ নুরেমবার্গে চলে আসত। তাঁর উগ্র বিশ্বজয়ের নেশাটা হয়তো ক্রিকেটের সাহায্যেই তিনি চরিতার্থ করতে পারতেন। আর ক্রিকেটও ইংরেজদের বলয় থেকে বেরিয়ে বিশ্ববলয়ে ঢুকতে পারত। ক্রিকেট বিশ্বকাপের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই তখন আট-দশ দেশের বদলে ৩২ বা ৪৮টি দেশের মধ্যে চলত। ঠিক যেমন ফুটবলের দুনিয়া এগিয়েছে...।
অথচ, ইতিহাস বলছে, ক্রিকেটের সঙ্গে জার্মানদের যোগাযোগ বহু পুরনো। ক্রিকেটের বিস্তারিত নির্দেশিকা ইংল্যান্ডে নয়, বরং ১৭৯৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল জার্মানিতে। সেই বইয়ের লেখক গুটৎজমুথজ লিখেছিলেন, ‘এই খেলাটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ইংল্যান্ডের মাধ্যমে।’ গুটৎজমুথজের প্রচার সত্ত্বেও ক্রিকেট জার্মানদের আকর্ষণ করেনি। তারা এই খেলাকে ‘ইংলিশ রোগ’ মনে করত। ১৮৯৮ সালে জার্মান জিমন্যাস্ট ও শিক্ষক কার্ল প্লান্ট লিখেছিলেন, ‘এই ফালতু ইংলিশ খেলাকে আমরা শুধু জঘন্যই বলব না, বরং এটা উদ্ভট, কুৎসিত ও বিকৃত।’ তবে, তার আগেই ১৮৯২ সালেই বার্লিনে গঠিত হয়েছিল ‘ডয়েচ ফুটবল ও ক্রিকেট বোর্ড’। বেঁচে থাকলে হিটলার হয়তো মাইন ক্যাম্পের মতো আরও একটা বই লিখতে পারতেন— মাই স্ট্রাগল উইথ ক্রিকেট!
তবে হিটলার-মুক্ত জার্মানিতে এখন দ্রুত প্রসার হচ্ছে ক্রিকেটের। জার্মানির ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান সিইও ব্রায়ান ম্যান্টল স্বপ্ন দেখছেন, অদূর ভবিষ্যতে আইসিসির ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্ট খেলবে জার্মানি। ম্যান্টলকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন মূলত জার্মানিতে শরণার্থী হয়ে আসা কিছু যুবক। এরাই জার্মানিতে ক্রিকেটের দ্রুত প্রসার ঘটাচ্ছে। জার্মানির ক্রিকেট বোর্ডের হিসেব বলছে, ২০১২ সালে দেশটিতে ৭০টি ক্রিকেট ক্লাব ছিল। আর ক্লাবগুলিতে খেলত এক হাজারের মতো ক্রিকেটার। আর বর্তমানে ২২০টি ক্লাবে রয়েছে প্রায় ৫ হাজার ক্রিকেটার।
আপনি কি জানেন, জার্মানি ক্রিকেট দলের অধিনায়ক কে? ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রযুক্তিবিদ ভেঙ্কটরমন গণেশন। একসময়ে অশ্বিন, দীনেশ কার্তিকদের সঙ্গে চেন্নাইয়ে ফার্স্ট ডিভিশন ক্রিকেটে চুটিয়ে খেলেছেন এই বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান। সেই ভেঙ্কটরমনকে ঘিরেই বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছে জার্মানি।