গুরুজনের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা ও মানসিক উদ্বেগ। কাজকর্মে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। বয়স্কদের স্বাস্থ্য সমস্যা ... বিশদ
নিঃসন্দেহে এবারের ভোটে গেরুয়া শিবিরের প্রচারের মুখ দু’জনই, ‘বিশ্বগুরু’ নরেন্দ্র মোদি ও ‘স্ট্রংম্যান’ অমিত শাহ। বাকিরা জাস্ট এলেবেলে। অমিত শাহ গত মঙ্গলবার বঙ্গে প্রচারে এসে উলুবেড়িয়ায় বলেছেন, বাংলায় জিতে এলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পরিমাণ বর্তমান এক হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১০০ করা হবে। অর্থাৎ ১০০ টাকা বাড়বে। একে কী বলবেন, কটাক্ষ, নাকি বঙ্গের ভোটে খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না দেখে চূড়ান্ত হতাশার বহিঃপ্রকাশ? প্রথম কথা, এটা বাংলার ক্ষমতা দখলের ভোট নয়। দিল্লির ভোট। আর দ্বিতীয়ত, অমিত শাহকে সবিনয়ে জানিয়ে রাখি, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পরিমাণ ১০০ টাকা বৃদ্ধির এই সস্তা প্রহসন অবিলম্বে বন্ধ করুন। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি’। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার চালু করেছেন মমতা। ভাতার পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকাও করেছেন বাংলার জননেত্রীই। এবারও লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো আরও ৬৭টি জনহিতকর প্রকল্পই বিজেপি, সিপিএমের লম্ফঝম্প বন্ধ করে দেবে। ভাতা বৃদ্ধির প্রয়োজন হলে সেই দায়িত্বটা যথাসময়ে পালন করবেন মমতাই। আপনাকে বিমানের ধুলো উড়িয়ে এসে এই স্তোকবাক্য শোনাতে হবে না। বাংলার মা-বোনেরা তৃণমূল সুপ্রিমোকে অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন এবং মানেন। ওসব নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে। আপনি বরং বঙ্গ বিজেপির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবুন। কেন্দ্রের যে দল ও সরকার আড়াই বছর যাবৎ বাংলার বকেয়া দেড় লক্ষাধিক কোটি টাকা আটকে রেখেছে, দু’বছরেরও বেশি সময় মেটায়নি ১০০ দিনের কাজের টাকা, বন্ধ করেছে আবাস যোজনার কাজ, চারদিকে শুধু বঞ্চনা আর বঞ্চনা যাদের সৌজন্যে, তার শীর্ষ নেতার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ১০০ টাকা বৃদ্ধির ঘোষণায় চিঁড়ে ভিজবে বলে মনে হয়? বরং এটাই প্রচার হবে, ভয় পেয়ে এখন বাধ্য হয়েই ঢোঁক গিলছেন শাহরা।
মনে কু ডাকার আরও কারণ আছে। চার দফার ভোটেই যদি সরকার গড়ার প্রয়োজনীয় গরিষ্ঠতা এসে গিয়ে থাকে, তবে কোনও রাষ্ট্রনেতা কি কখনও ক্যামেরার সামনে কাঁদেন কিংবা মাথা ঝোঁকান। অমিত শাহ বলেছেন, যে ৩৮০টির মতো আসনে ভোট ইতিমধ্যেই হয়েছে, তাতেই বিজেপির ঝুলিতে নিশ্চিত করে ২৭০ ঢুকে গিয়েছে! অর্থাৎ সরকার গঠন হয়েই গিয়েছে। এখনও আরও ১৬০ আসনে ভোট বাকি। বারাণসী সহ উত্তরপ্রদেশের অর্ধেক আসনে ভোট কিন্তু শেষ তিন পর্যায়ে। বিহার ও মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, দিল্লি, ঝাড়খণ্ড এবং বাংলার বহু আসনে এখনও নির্বাচন বাকি। যদি জয় মুঠোয় এসে গিয়েই থাকে, তাহলে মোদিজি বারাণসীর গঙ্গাবক্ষে একটি বেসরকারি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন কেন? নিতান্তই কি আবেগের বশে? যাঁরা তাঁর সেদিনের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চিত যে ওটা মোটেও আনন্দাশ্রু ছিল না, আত্মতৃপ্তি কিংবা আত্মসন্তুষ্টিরও নয়। তাহলে কি দেশের চিন্তায়? তাও না। রেকর্ড সংখ্যক বেকার নিয়ে কী করব? একদম নয়। তবে নিশ্চয়—গত দু’মাসে বারংবার এই বিরাট দেশের উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম এক করে ফেলেও ভোটযন্ত্রে ৪০০ থুড়ি, আড়াইশো পারেরও কোনও ইঙ্গিত না মেলার হতাশায়? বিভিন্ন প্রদেশে এবং অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে মানুষের মন পড়ে নিয়েছেন তিনি। অভিনয়ের বাইরে থেকে চাপানো রংকে আরও ফুটিয়ে তুলতে কান্না রাজনৈতিক নেতাদের চিরসঙ্গী। কিন্তু পরপর তিনবার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি পাকা হওয়ার পরও চোখে জল দেখে বুঝতে বাকি থাকে না, এত চড়া সুরের প্রচারের পরও তিনি আদ্যন্ত হতাশ, নিঃসঙ্গ—একাকিত্বই তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাঁকে। আর সেই কারণেই তাঁর দশ বছরের শাসনকালের সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নোট বাতিল নিয়ে কোনও জনসভায় টুঁ শব্দটিও করেননি তিনি।
কেন হতাশা? শুরু হয়েছিল উন্নয়নের ঢাক বাজিয়ে আর ৪০০ পারের গল্প শুনিয়ে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বুঝতে পারলেন—উন্নয়ন, বিকাশে হবে না। হিন্দু-মুসলমান মোটা দাগের নোংরা খেলা ছাড়া বিশেষ সুবিধে হবে না। এজন্যই আমদানি করেছেন, সংখ্যালঘুদের বেশি বাচ্চা এবং মঙ্গলসূত্রের গল্প। সঙ্গে জুড়লেন মিথ্যে ন্যারেটিভ, কংগ্রেস এলে সব টাকা পয়সা, সোনাদানা হিন্দুদের কাছ থেকে কেড়ে দিয়ে দেওয়া হবে মুসলমানদের। এই নিদান নাকি মনমোহনজি দিয়ে গিয়েছেন। লোকে চমকাল, ভয়ও পেল খানিকটা। শত হলেও দেশের প্রধানমন্ত্রী বলে কথা। কিন্তু তার তিন সপ্তাহ পরে আবার সুর বদল। এখন বলছেন, মুসলমানদের কথা তিনি একবারও বলেননি। বেশি বাচ্চা বলতে গরিব মানুষের কথা বুঝিয়েছেন। সবাই অবাক! মোদিজির হলটা কী? কোনও খারাপ খবর এসেছে? এমনও বলছেন, ‘যদি হিন্দু-মুসলিম করি, তাহলে সামাজিক জীবনে থাকার যোগ্যতা হারাব।’ যদি তাই হয়, তাহলে তো অনেক আগেই আপনি সেই যোগ্যতা হারিয়ে বসে আছেন।
মোদির মুখে উঠে এসেছে গুজরাত দাঙ্গার কথা। বলছেন, ‘আমার অনেক মুসলিম বন্ধু আছে।’ এ তো বিড়াল বলছে, মাছ খাব না! ‘২০০২ সালের পর আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করার অনেক চেষ্টা হয়েছিল। ঈদের দিন আমরা বাড়িতে রান্না করতাম না। আশপাশের মুসলিম প্রতিবেশীদের কাছ থেকে খাবার আসত।’ খুব ভালো কথা। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘ভোট ব্যাঙ্কের জন্য কাজ করি না। আমি বিশ্বাস করি, সব কা সাথ, সব কা বিকাশে।’ এ তো প্রধানমন্ত্রী নন, শরৎচন্দ্রের সাক্ষাৎ ‘ছিনাথ বহুরূপী’!
কিন্তু বাস্তব হল, মোদিজির মুখে এই কথা বাংলার মানুষের হজম হচ্ছে না। আমাদের স্মৃতি বড্ড দুর্বল। খুব বেশিদিন অনেকেই কিছু মনে রাখেন না। তার সুযোগ নেন রাজনীতিকরা। আজ এক কথা বলেন, কাল অন্য কথা। কথার ভুলভুলাইয়ায় চোরকাঁটায় আটকে যান গরিব জনগণ। কিন্তু গত রবিবার বারাকপুর লোকসভা আসনের এক জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী যে কথাগুলি বলেছিলেন, তার স্মৃতি এখনও টাটকা। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এখানে তৃণমূল নেতারা বলছেন হিন্দুদের ভাগীরথীতে ছুড়ে ফেলে দেবেন। চোয়াল শক্ত করে প্রধানমন্ত্রী এরপরই বলেন, ‘এত হিম্মত? এত সাহস?’ তাঁর দাবি, ‘বাংলায় মমতার রাজত্বে হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী এও বলেছিলেন, ‘ইন্ডি জোট এলে তফসিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ তুলে দেবে। ওরা বলছে, পুরো সংরক্ষণ মুসলমানদের দেওয়া হোক।’ প্রশ্ন ছুড়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আপনারা এটা মেনে নেবেন তো? দেশের দলিত, আদিবাসী ও অনগ্রসর শ্রেণি এই অন্যায় সহ্য করবে কি?’ এই প্রসঙ্গেই কর্ণাটকের উদাহরণ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কর্ণাটকে ওবিসিদের প্রাপ্য সংরক্ষণ গোটাটাই মুসলমানদের দিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস। বাংলার ভাই বোনেদের খুব সতর্ক থাকতে হবে।’